ক্যাল্গেরীর বসন্তকাল
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ০১ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:৪৪:৩০ সকাল
বিকালে রান্নাঘরে কাজ করতে করতে হাফিজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার? বাচ্চারা কেউ আজ স্কুলে যায়নি কেন?’
পৃথিবীতে একমাত্র ওনার পক্ষেই সম্ভব এই প্রশ্নের জবাব জানার জন্য সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা। ওনার ধারণা অনুযায়ী বাড়ীঘর, সংসার, সন্তান সব আমার; আর এই সব কিছুর সাথে ওনার একমাত্র সংযোগ আমি। এখন আর অবাকও হইনা। স্বাভাবিকভাবেই বললাম, ‘আজ থেকে ওদের বসন্তকালীন ছুটি, এই সপ্তাহ পুরোটা ওরা বাসায় থাকবে’।
উনি খুব অবাক হলেন। বিস্ফারিতনেত্রে একবার আমার দিকে আরেকবার বাইরে তাকিয়ে বললেন, ‘তাই?’
অবাক হবার কারণ হোল, তখন বাইরে অঝোরে তুষারপাত হচ্ছে যা আজ সাত আটদিন হতে চলল একইহারে চলমান। এবারের শীত ছিল দীর্ঘ, প্রচন্ড শীতল এবং অত্যধিক তুষারপাতযুক্ত। শীতের শেষ সপ্তাহ তাপমাত্রা ৭-১১ সেলসিয়াসে চলে আসতেই স্তুপীকৃত তুষার গলে রাস্তাঘাট একাকার অবস্থা। ক্যাল্গেরীবাসী ভয় পেয়ে গেল, সব তুষার একসাথে গলে আবার না গতবছরের মত বন্যা হয়! এক হাজার স্বেচ্ছাসেবী নদীর পাড় থেকে ট্রাকে ভরে জমাট তুষার স্থানান্তর করল যেন বরফ গলে নদীর পানি উপচে না পড়ে। প্রায় সব বরফ গলে যাবার পর বসন্তের প্রথমদিন থেকে আবার এক সপ্তাহের তুষারপাতে প্রায় হাঁটুসমান বরফ জমে গিয়েছে। তাপমাত্রা ধাঁ করে চলে এসেছে মাইনাস ২০ সেলসিয়াসে। শীতকালে আবহাওয়া শুকনো থাকে বলে মাইনাস ৪০ সেলসিয়াসেও তেমন কষ্ট হয়না, যদি বাতাস না থাকে বা বাতাসে আর্দ্রতা না থাকে। কিন্তু এখন বাতাসে আর্দ্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকজন কেবল চোখ দু’টো বাদ দিয়ে সব ঢেকে চলাফেরা করছে, তবু চামড়া কেটে কেটে যাচ্ছে জলো বাতাসে। এখন যে তুষার ঝরছে তা আকারে শীতকালীন তুষারের চেয়ে বড়। তবে ক্যাল্গেরীর তুষার বালি বালি ধরনের, তাতেই রক্ষা, নইলে জামাকাপড় ভিজে গেলে সবাই মারা পড়ত। ভোরে যখন কাজে যাই তখন অন্ধকারে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়। আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় কোটি কোটি হীরের কুচি ঝরে ঝরে পড়ছে, অন্ধকারে তুষারস্তুপ হীরের স্তুপের মত চিক চিক করে জ্বলে। কি যে অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য!
তাপমাত্রা মাইনাস পঁচিশের নীচে গেলে আরেকটা অদ্ভুত জিনিস ঘটে। কেউ যদি এক গ্লাস পানি বাইরে ছুঁড়ে মারে তাহলে তা মাটিতে পড়ার আগেই বরফে রূপান্তরিত হয়ে ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ে! ব্যাপারটা অনেক বছর আগে দেখা একটা দৃশ্য বুঝতে সাহায্য করল। বিয়ের কিছুদিন পর কলকাতা বেড়াতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম দার্জিলিং ঘুরে আসব। দার্জিলিং গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর সুর্যোদয় এত ভাল লাগল, মনে হোল সত্যজিৎ রায় এর যে বর্ণনা দিয়েছেন এটি বাস্তবে তার চেয়েও সুন্দর। কিন্তু প্রচুর পর্যটক যাবার ফলে দার্জিলিং বলতে গেলে একটি বাজারে পরিণত হয়েছে। একটি ভারতীয় বাঙ্গালী পরিবারের সাথে কথাগুলো শেয়ার করতে তারা বলল তাহলে আমাদের সাথে সিকিম চল, ওখানে ভাল লাগবে। সিকিম আসলেই অসাধারন লেগেছে যদিও সিকিমের প্রবেশপথে ‘ভারতীয় আগ্রাসন থেকে সিকিমকে মুক্ত করার আন্দোলন’-এর অফিস আর বিশাল সাইনবোর্ড দেখে বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের সাথে আগ্রাসী আচরন করার এমন প্রচুর ইতিহাস আছে যার, তার প্রতিবেশী আমরা। তাহলে আমরা কতটুকু নিরাপদ? যাই হোক, পরদিন তিস্তা নদীর জন্মস্থান সাঙ্গু লেক দেখতে পাহাড়ে চড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। নিজের দেশেই রিফিউজি বনে যাওয়া প্রচুর সিকিমি পরিবার পাহাড়ের ঢালে ছাপড়া ঘর বানিয়ে বসবাস করছে, চট্টগ্রামের বাটালী হিলের মত। মহিলারা ঘরের বাইরে হাঁড়িতে পানি গরম করছে, তারপর সেই টগবগ করে ফুটন্ত পানি মাথায় ঢেলে গোসল করছে, আর সেই পানি মাটিতে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বরফ হয়ে যাচ্ছে! টগবগে ফুটন্ত পানি মাথায় ঢালতে দেখে আতঙ্কে শিউড়ে উঠেছিলাম তখন। সেই প্রথম আমার এমন আবহাওয়া দেখার অভিজ্ঞতা। তাই বুঝতে পারিনি পানি ঢালার আগেই তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! সারা জীবন চরম উষ্ণ আবহাওয়ায় কাটিয়ে এখানে মনে হচ্ছিল ফ্রিজারে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী এক জায়গায় দু’পাশে ফাঁকা থাকায় হু হু করে বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল, মনে হোল যেন হাড়সহ কেটে নিয়ে গেল! ব্যাস, এক ঝলক মৃদুমন্দ হাওয়া! কিন্তু এই আবহাওয়ায় একদিন বসবাস করব তা ভাবিনি কোনদিন।
এই প্রসঙ্গে আরেকটা মজার ঘটনা মনে পড়ল। মাস্টার্স পাশ করার আগে চট্টগ্রামের প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়াতাম। একবার ক্লাস ফাইভে ভূগোল পড়াতে গিয়ে ক্যাল্গেরী নামে এক শহরের প্রসঙ্গ এলো যেখানে বছরের অর্ধেক সময়ই মাইনাস তাপমাত্রা থাকে এবং শীতগ্রীষ্ম সবসময়ই তুষারপাত হতে পারে। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু যখন পড়লাম মাইনাস ৪০ সেলসিয়াস বা এর নীচে খালি হাতে ধাতব কিছু স্পর্শ করলে তা আর বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ ব্যাতীত ছুটানো যায়না, অনেক সময় চামড়া কেটে ছাড়াতে হতে পারে, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম পৃথিবীর যে জায়গায়ই যাইনা কেন, ক্যাল্গেরী জীবনেও আসবনা। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কি কিছু হয়? তাই পৃথিবীর এত জায়গা ফেলে এই ক্যাল্গেরীতেই বসবাস করছি গত পাঁচবছর!
এবারের তুষারপাত শুরু হবার আগে একদিন ঝকঝকে রোদ উঠতে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাফিজ সাহেবকে বললাম, ‘দেখেন, কি সুন্দর রোদ উঠেছে মাশাল্লাহ!’
উনি বাইরে দেখে বললেন, ‘গত সপ্তাহেও একবার রোদ উঠেছিল’।
পৃথিবীর আর যেকোন জায়গায় এই কথোপকথন শুনলে লোকে মনে করত উনি ঠাট্টা করছেন। কিন্তু এখানে এটা কেবল নিরেট বাস্তুবতা।
ক্যাল্গেরীবাসীদের মধ্যে যাদের পক্ষে সম্ভব তারা শীতে বিভিন্ন উষ্ণ স্থানে বেড়াতে যায়। ফিরে এসে হা হুতাশ করে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে আবহাওয়াজনিত ডিপ্রেশনে আত্মহত্যার মত ঘটনাও বিরল নয়। হাফিজ সাহেব তো প্রতিবার শীত এলে ক্যাল্গেরী ছেড়ে চলে যেতে চান। আবার গ্রীষ্মকাল এলে ক্যাল্গেরীর মোহনীয় সৌন্দর্য অভিভূত হয়ে শীতের কথা ভুলে যান। তবে আমি আমার জীবনপরিক্রমায় মরুভূমিতে থেকেছি, সাগরপাড়ে থেকেছি, পাহাড়ে থেকেছি, নিম্নভূমিতে থেকেছি, দাবদাহে প্রান অতিষ্ঠ হবার মত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠে ক্যাল্গেরীর ফ্রিজারে ঢুকেছি। আলহামদুলিল্লাহ, আমার এই তুষার কিংবা শীত ভালই লাগে। সবচেয়ে বড় কথা আল্লাহ স্বয়ং যা আমার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা কি কখনো আমার জন্য অমঙ্গলজনক হতে পারে? আমরা যখন মাদ্রাজ থাকতাম তখন প্রায়ই মাদ্রাজে পড়াশোনারত ছেলেমেয়েরা ওখানকার খাবার নিয়ে নালিশ করত, কিন্তু সত্যি কথা ওদের খাবার আমার খুবই পছন্দ! আমরা যখন যে অবস্থায় থাকি সেটাকেই জীবনের একেকটি উপভোগ্য অধ্যায় মনে করে অ্যাপ্রিশিয়েট করে নিলে প্রতিটি মূহূর্ত, প্রতিটি অভিজ্ঞতাই আনন্দদায়ক হতে পারে। কিন্তু এই কৃতজ্ঞতাবোধের অভাবই জীবনকে করে তোলে বিস্বাদ এবং নিরানন্দ। মাতৃভাষায় অ্যাপ্রিশিয়েট শব্দটার একটা যুৎসই প্রতিশব্দের অভাবে একবার আক্ষেপ করেছিলাম এই গুনটিই সম্ভবত আমাদের নেই। আজও মনে হচ্ছে এই শব্দটার সাথে পরিচিত হওয়া আমাদের জন্য একান্ত জরুরী। আফ্রিকার উত্তপ্ত গাছপালাবিহীন প্রান্তরে খাদ্য ও পানির অভাবে মৃত্যুপথযাত্রী শিশুটিকে খাবার জন্য অপেক্ষারত শকুনের সেই বিখ্যাত ছবিটি দেখেও কি আমরা একবার ভাবিনা আমরা কত ভাল আছি।
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৯ বার পঠিত, ৪৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
প্রথম উপস্থিতির জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ
শিতের অবস্থা তাহলে কি রকম?
তবে প্রকৃতির এই বৈচিত্রময়তাই পৃথিবীকে করে তুলেছে বাসযোগ্য। পৃথিবীর সজিব অঞ্চলগুলি সবগুলিই একটি অন্যটির থেকে আলাদা। কিন্তু মরুভুমি সবখানেই এক। আরব, সাহারা, রাজস্থান, কি আরিজোনা সবই একই রকম। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা আমাদের চারপাশের এক নিয়ামত দেখেও কৃতজ্ঞ হইনা সেই মহান সত্বার প্রতি।
ধন্যবাদ সুন্দর লিখাটির জন্য।
চমৎকার বর্ণনাসমৃদ্ধ লেখাটি বেশ ভালো লেগেছে।
আপনার ভাল লাগায় আপ্লুত হলাম আপা, আপনার লেখাও আমার খুব ভাল লাগে
তবে আপনার পরিবারের এক সদস্যের ব্যাপারে নালিশ আছে, মেধা আল্লাহ সবাইকে দেন না, যাকে দেন তার মেধার অপচয় ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ
হৃদয়ের ভেতর পিনপতন নীরবতা।
অযোগ্যকে আবারো দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিলেন। বৃথা যাবে না আশাকরি। ইনশা আল্লাহ।
আমাদের এখানে বসন্তের ছুটি শুরু হবে আগামী সপ্তাহ থেকে। কিন্তু সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে। ঠাণ্ডা কমারও কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
অনেক ভালো লাগলো লেখাটা আপু।
আপু আমি নিজে আরেকটা গল্প লেখা শুরু করেছি। আফ্রুকে দেখায় দেব আমিও কম না ওর চেয়ে।
দেখিয়ে দেয়ার কিছু নেই আপু তোমাদের মধ্যে কি প্রতিযোগিতা হতে পারে? দু'জনের স্টাইল দু'রকম। কিন্তু দু'জনেই ভাল লেখ। আমরা উভয়প্রকার লেখার স্বাদ উপভোগ করতে চাই
খুব ভাল লাগল. পরিস্থিতির শিকার হলে মানুষ অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে
বসন্তের আগমনী সঙ্গীত প্রকৃতিতে খুঁজে না পেয়ে ভাইয়ার ' তাই ? ' এবং ' গত সপ্তাহেও একবার রোদ উঠেছিল ' .... পড়ে কি যে মজা পেয়েছি !! শুকরিয়া আপু , অধরা প্রকৃতিকে আপনার লেখায় এত্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য !
আপু শেষের ছবিটার কথা আমি প্রায় ভাবি! আল্লাহ'র কোন নিয়ামতের শুকরিয়া আমরা আদায় করে শেষ করতে পারব না আসলেই। কিন্তু এই কৃতজ্ঞতাবোধের অভাবই জীবনকে করে তোলে বিস্বাদ এবং নিরানন্দ। শুধু তাই নয় আল্লাহ অকৃতজ্ঞ দের পছন্দ করেন না!
আল্লাহ আমাদের সকলকে শুকরগোজার বান্দা বান্দীতে পরিনত করে নিন! আমীন।
সুন্দর মন ছুঁয়ে যাওয়া লিখনীর জন্য আবারো শুকরিয়া, শুভাকমান রইলো
অন্তর থেকে 'আলহামদুলিল্লাহ' অনুভব করাটা অনেক বড় ব্যাপার!
আর আমি তো উপরে তাকালে দেখি আকাশটা নীল চাকতির যেন, আমাদের অবস্থা হয়ে গেছে ওই ব্যাঙের মতো। পাখিদের দেখি। আর একটু একটু করে ডানা বুনি। একদিন পাখির মত দুটো ডানা পাবো এই স্বপ্ন নিয়ে বাঁচি।
অনেকদিন পর দেখলাম তোমাকে। এবার তোমার পোস্ট দেখতে চাই
আপু কেমন আছেন? এত্তদিন পরে আসলেন? কেন, আমাদের আচরনে কষ্ট পেয়েছিলেন? তা যদি হয় নিঃশর্ত ক্ষমা চাই। আশাকরি মাফ করে দেবেন, আর নিয়মিত হবেন ব্লগে।
আপনি নাকি ফেবুতে নিয়মিত থাকেন, কিন্তু ব্লগে আসেন না। আমার আর 'আওণ' এর পক্ষথেকে সবিনয় বিষেশ অনুরোধ করছি, ব্লগে নিয়মিত লেখার জন্য। (দু'হাত জুড়ে অনুরোধ করার ইমো হবে এখানে)
@সূর্যের পাশে হারিকেন, ওয়ালাইকুম আসসালাম। আরেহ! কী যে বলেন!!
আপনার কোন আচরণে কেন কষ্ট পাবো? কিছুই বুঝলাম না।
না ভাইয়া, আমি আসলে অনলাইনেই অনিয়মিত হয়ে গেছি বেশ অনেকদিন ধরে। ব্যস্ততার অজুহাত দিবো না, সবাইই ব্যস্ত! ইচ্ছাকৃত নীরবতা বলতে পারেন। তবে লিখবো ইনশা আল্লাহ।
উৎসাহ দেওয়ার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন