বুদ্ধিমান বোকা
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ২৭ নভেম্বর, ২০১৩, ১০:১০:৪৮ সকাল
বছর দু’তিন আগে কতিপয় ব্যাক্তির ব্যাপারে আমার ননদিনি আইরিনের বক্তব্য জিজ্ঞেস করলে আরেক ননদ রিমি হাসতে হাসতে বলে, ‘আইরিন আপার মতামত মানে তো জানেন, ওর চোখে সবাই অসাধারন’। এই কথা নিয়ে আমরা সবাই হাসলাম কতক্ষণ। গতকাল দেখি আমার ছোটভাই আমার মেয়েকে বোঝাচ্ছে, ‘আমার বোনের চোখে ফুলচন্দন পড়ুক, সে কোন কিছুর মাঝেই খারাপ কিছু খুঁজে পায়না, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ জিনিসের মধ্যেও সে ভাল কিছু খুঁজে বের করে ফেলার অসাধারন ক্ষমতা রাখে’। বুঝলাম, আমার ভাইটি আমার বারো বছরের ছোট হলেও ওর ধারণা পার্থিব জ্ঞানের দিক থেকে ওর বোন ওর চেয়ে অবুঝ। তলিয়ে দেখলাম কথাটা কতটুকু সত্য। ভাবতে ভাবতে যা বুঝলাম তা হোল এটি আংশিক সত্য। আমি যখন অনার্সে পড়ি তখনো যদি কেউ বলত, ‘আমার দাদা তার নব্বই বছর বয়সে এক ওয়াক্তের নামাজও কাজা করেননি’ কিংবা ‘আমার নানী জীবনে কোনদিন কোন গুনাহ করেননি’; আমি পরিপূর্ণরূপে বিশ্বাস করতাম, মুগ্ধ হয়ে যেতাম, উপরোক্ত ব্যাক্তিবর্গকে উর্ধ্বাকাশের বাসিন্দাদের মতই ত্রুটিমুক্ত গণ্য করতাম। তবে আজ কেউ এমন কথা বললে আমি তা বিশ্বাস করবনা।
কারণ? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব ছিলেন রাসূল (সা)। তাঁর ব্যাপারে তাঁর প্রভুর বক্তব্য হোল, ‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়’ (সূরাহ তাওবাহঃ আয়াত ১২৮)। তিনি আমাদের মতই মানুষ ছিলেন, নিসঃন্দেহে অসাধারন মানুষ ছিলেন- কিন্তু আমরা যেসব আনন্দ বেদনা, সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতার অধীন তা তাঁর অপরিচিত ছিলোনা বলেই তিনি মু’মিনদের মাঝে যারা দুর্বল তাদের হেয় করার পরিবর্তে তাদের প্রতি ছিলেন স্নেহশীল, দয়াময়। খন্দকের যুদ্ধের সময় তাঁর নামাজ কাজা হয়ে যায়। সূরাহ আবাসায় আল্লাহ স্বয়ং তাঁকে একটি ত্রুটির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। মানবশ্রেষ্ঠ ব্যাক্তিটিই যদি ত্রুটির উর্ধ্বে না হয়ে থাকেন তাহলে অন্য কেউ নিজেকে ত্রুটিমুক্ত দাবী করা বা কাউকে শ্রদ্ধার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ত্রুটিমুক্ত মনে করা বোকামীরই নামান্তর। যদি আমরা ত্রুটিমুক্ত হবার ক্ষমতা রাখতাম তাহলে আমাদের পৃথিবীর জীবনটার কোন প্রয়োজনই হতনা, কেননা যে পরীক্ষায় কোন ভুল হবার সম্ভাবনা থাকেনা তাকে কি পরীক্ষা হিসেবে অভিহিত করা যায়?
আরেকটি ব্যাপারে আমার মোহভঙ্গ হয় জীবনের পথ বহুদূর পাড়ি দেয়ার পর। সৌভাগ্যক্রমে পক্ষপাত ব্যাপারটি আমার চরিত্রে ছিলোনা কখনোই। বাবার সাথে বন্ধুত্ব ছিলো বেশি, কিন্তু বাবা মায়ের সাথে অন্যায্য আচরন করে কোনদিন আমার সমর্থন পায়নি। ছোট ভাইটিকে নিজের সন্তানের মতই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি, কিন্তু বড়টির প্রতি কোন অন্যায় আচরন করে পার পায়নি সে। ইসলামে ভালবাসা এবং আনুগত্য শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য, বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা কেবলমাত্র তাঁরই জন্য, সত্য এবং মিথ্যার মাপকাঠি হিসেবেও সেটাই প্রযোজ্য যা তিনি দিয়ে দিয়েছেন। যদি আমরা পরিবারের প্রতি আনুগত্যকে সর্বোচ্চ স্থান দেই তাহলে আমরা মূলত তাই করব যা কাফিররা করেছিল, গোত্রপ্রীতির কারণে অনেকে সত্য জেনেও গ্রহন করতে পারেনি। আমার পরিবারের কেউ ভুল করলে তাকে সমর্থন দেয়া নয়, সংশোধন করাই প্রকৃত ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। বন্ধুর প্রতি ভালোবাসার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হবে আমার বন্ধুটি ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত কিনা, নইলে তাকে আমার সত্যের প্রতি আহ্বান করতে হবে, অন্যায়ের পথে তাকে সমর্থন দিয়ে তার কোন উপকার আমি করতে পারবনা বরং দু’জনেই ফেঁসে যাবার সম্ভাবনা। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে একমাত্র সত্য এবং ন্যায়কেই সমর্থন দিতে হবে যদিওবা তা আমার নিজের বিরুদ্ধে যায়। এখানেই একটা গলদ করে বসেছিলাম বহুবছর, কারণ ভালবাসা আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। এক ব্যাক্তিকে বড় ভালবাসতাম যার মাঝে কোনদিন কোন ত্রুটি চোখে পড়েনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন উপলব্ধি করলাম তিনি সবাইকেই সন্তুষ্ট রাখতে চান। দুই ব্যাক্তির মাঝে ঝগড়া হলে উভয়কেই তিনি বলবেন, ‘তুমিই ঠিক বলেছ!’ কিন্তু সত্যের মাপকাঠি তো কাউকে সন্তুষ্ট রাখার ওপর নির্ভর করতে পারেনা যিনি এই মাপকাঠি প্রণয়ন করেছেন তাঁকে ছাড়া, আর তিনি কেবল ন্যায় ছাড়া আর কিছুতে সন্তুষ্ট হন না! অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছিলাম সেদিন যেদিন বুঝতে পেরেছিলাম ‘সদা সত্য বলিব’ সংকল্প নিয়েও আমি কত বড় একটা মিথ্যাকে দেখতেই পাইনি এতদিন!
কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই। আমরা কেউ ত্রুটিমুক্ত নই, হওয়া সম্ভব না, এমনটা আমাদের সৃষ্টিকর্তাও আমাদের কাছে আশা রাখেন না- তাহলে ক্ষমার প্রয়োজন হতনা, তিনিও নিজেকে বার বার ক্ষমাশীল হিসেবে পরিচয় দিতেন না। আমাদের যা করণীয় তা হোল সত্যমিথ্যা নির্ধারন করার মত জ্ঞান সংগ্রহ করা, অতঃপর প্রাত্যহিক জীবনে সেই জ্ঞানের প্রয়োগ করা। সেখানে ভুল হবে, আমরা যে ভুল করে ভুলে যাই বার বার! কিন্তু চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে সত্যকে স্বীকার করার এবং মিথ্যাকে সংশোধন করার- নিজের ত্রুটির ব্যাপারে তো বটেই, অন্যকেও সাহায্য করতে হবে তার দুর্বলতা থেকে উত্তরণের জন্য। শেষতক যেটা আসল কথা সেটা হোল চেষ্টাটাই আসল এবং চেষ্টাটা হতে হবে আন্তরিক। আমি খুব ক্ষুদ্র ব্যাক্তি, তাই আমার চেষ্টা চৌবাচ্চার ছিদ্র আটকানোয় বেশি নিয়োজিত চৌবাচ্চা ভরার চেয়েও। নিজে দুর্বল বলেই হয়ত আমি অন্যের দুর্বলতা বুঝি। নিজের বেলা যেমন হাজারটা ত্রুটির মাঝেও একটি ভাল গুন খুঁজে নিয়ে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করি, ‘না, তোমার একটি হলেও গুন আছে, তুমি একেই বিকশিত কর’; তেমনি অন্যের শত ত্রুটি দেখেও তার মাঝে ভাল কিছু খুঁজে পাবার চেষ্টা করি যা দিয়ে তাকে উজ্জীবিত করা যায়, যা হয়ত কোন একদিন তাকে নিজেকে অতিক্রম করতে সাহায্য করবে। এর জন্য যদি কেউ আমাকে বোকা ভাবে তবে আমার বোকা হতে আপত্তি নেই।
আমার মতে, অসহিষ্ণুতাই দুর্বলতা। আমি যদি আমার আশেপাশের সবার প্রতি সহিষ্ণু হই, হয়ত আমার প্রভু আমার প্রতি দয়ার্দ্র হবেন। আর যদি সব হিসেব এখানেই চুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করি তাহলে হয়ত ব্রাউনিংয়ের কবিতার মত তিনি বলবেন, ‘Paid by the world, what dost thou owe Me?’ (The Patriot) কিন্তু একটু ধৈর্য্য আর একটু সহানুভূতি নিয়ে এই জীবনটুকু পার করে দিতে পারলে হয়ত ব্রাউনিংয়ের ‘Patriot’এর মত আমরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলতে পারব, ‘’Tis God shall repay: I am safer so’. কারণ, আমি নিশ্চিত জানি তাঁর কাছে আমার কণা পরিমাণ ভাল কাজ, কণা পরিমাণ মন্দ কাজ, কণা পরিমাণ ভাল কথা, কণা পরিমাণ মন্দ কথা, কণা পরিমাণ প্রচেষ্টা, কণা পরিমাণ অন্যায়- সবকিছুর হিসেব সংরক্ষিত আছে এবং তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘Whatever you have will end, but what is with Allah will endure. And We will surely give those who were patient their reward according to the best of what they used to do’ (সূরাহ নাহলঃ আয়াত ৯৬). তিনি যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি আমার সবচেয়ে ভাল কাজটির ওপর ভিত্তি করেই আমাকে বিচার করবেন সেক্ষেত্রে অন্যের দোষত্রুটি পর্যবেক্ষণ করার চেয়েও সেই একটি ভাল কাজ কি হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা গবেষনাই কাজ দেবে বেশি। সুতরাং, মানুষের বিচার করা আমার কাজ নয়, কারো কাছে কোন আশাও রাখিনা। যদি ভুল করে ভাল মনে করে কারো কাছে কষ্টও পাই, তাতেও ক্ষতি নেই যতক্ষণ না আমার দ্বারা কারো প্রতি অবিচার হচ্ছে। সেক্ষেত্রে হয়ত কাউকে ভাল মনে করার কারণেই পার পেয়ে যেতে পারি, আর যে আমাকে বোকা ভেবে বঞ্চিত করল সে বুদ্ধিমান হয়েও আটকে যেতে পারে!
বিষয়: বিবিধ
২৪২৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন