ঘুরে এলাম নিউ ইয়র্ক - ৭
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ১৫ নভেম্বর, ২০১৩, ০৮:১৫:২৭ সকাল
২১এ সেপ্টেম্বর
সকালে উঠে খালা তড়িঘড়ি নাস্তা বানাচ্ছেন, হাফিজ সাহেব খালাকে সাহায্য করছেন, রাদিয়া রিহামকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দুই ভাইবোন তৈরী হচ্ছে, আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছি দ্রুত হাতে- পরদিন ভোরে আমাদের ফিরতি ফ্লাইট, বাইরে থেকে ফিরতে রাত হতে পারে, তাই শুধু আজকের দিনে যা লাগবে তা ছাড়া সব বাক্সে ভরে রেখে যাচ্ছি। সবাই তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ডাউনটাউন পৌঁছতেই এক ঘন্টার বেশি লেগে যাবে।
পথে রুশাকে ইউনিভার্সিটি থেকে তোলা হোল। তারপর সোজা ডাউনটাউন। নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্ট দেখা বাকি রয়ে গিয়েছিল। মিউজিয়ামে যাবার পথে রুশা হৃদিতা শখ করল বিখ্যাত ‘হালাল গাইজ’এর শাওয়ার্মা খাবে। শাওয়ার্মা আমারও খুব প্রিয় কিন্তু বিশাল লম্বা লাইন দেখে বুঝলাম আপাতত এই শখ শিকেয় তুলে রাখতে হবে, নইলে মিউজিয়াম দেখা হবেনা। বিশ্বের সমস্ত ডাউনটাউনগুলোতে গাড়ি পার্কিংয়ের সমস্যা। মিউজিয়ামের সামনে গিয়ে দেখা গেল কোথাও গাড়ি রাখার জায়গা পাওয়া যাচ্ছেনা। খালু আমাদের নামিয়ে দিয়ে পার্কিং খুঁজতে গেলেন। আমরা টিকেট করার উদ্দেশ্যে দৌড় দিলাম।
হৃদিতা একটা গাইডেড ট্যুর পেল। এতে মিউজিয়ামের পক্ষ থেকে একজন গাইড মিউজিয়াম ঘুরে দেখাবে। ভাগ্য ভাল ট্যুর শুরু হবার একটু আগে খালা খালু মিউজিয়ামে এসে ঢুকলেন। আমরা একে একে মিশরীয়, গ্রীক, চাইনিজ, ইউরোপীয় এবং আমেরিকান সভ্যতার নিদর্শনগুলো দেখে অতঃপর গাইডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইসলামী সভ্যতার নিদর্শনসমূহ দেখতে গেলাম। পাঠক আমাকে একপেশে ভাবতে পারেন তবে চাইনিজ সভ্যতা ছাড়া বাকী সবগুলো সভ্যতার নিদর্শন আমার সভ্যতার চেয়ে অসভ্যতাই বেশি মনে হচ্ছিল- প্রাচীন সভ্যতায় কোন মূর্তির গায়ে পোশাক নেই, থাকলেও যৎসামান্য। ইউরোপীয় চিত্রকলায় ধর্মীয় চিত্রেও লোকজন নগ্ন। তবে তাদের তৈজসপত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিসে যে নান্দনিক শৈল্পিকতার ছোঁয়া তা কোনভাবেই চোখ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। যেমন অনেক বাটির হাতলগুলোও মূর্তির আকারে তৈরী, ফুলদানীর গায়ে আঁকা ছবিতে বা মূর্তিতে গল্পকথার সমাহার, কিংবা একটি সাধারন মানের হাড়ির বাইরেটাতেও সমান্তরাল রেখা টেনে শিল্পী নিজের সৌন্দর্যবোধের স্বাক্ষর রেখেছে। আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল একটি পিরামিডের ভেতরটার প্রতিকৃতি এবং পিরামিডের ভেতর যা যা পাওয়া যায় সেগুলোর কিছু কিছু নমুনা। শত শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ধারণা করে এসেছেন পিরামিড তৈরী হয়েছে নীল নদের ওপাড় থেকে পাথর এনে। তাঁরা কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না এই পাথর নদী পার করে আনা হোল কিভাবে, টনে টনে পাথর এত কষ্ট করে টেনে না এনে ওপাড়েই কেন পিরামিড তৈরী করা হোলনা, পাথরগুলিকে এমন নিখুঁত মসৃন আয়তাকার করার মত এত উন্নতমানের যন্ত্রপাতিই বা তারা পেল কোথায় কিংবা আজ অবধি পিরামিড তৈরীর জন্য পাথরকে আকৃতি দিতে ব্যাবহৃত কোন যন্ত্রপাতির হদিস মেলেনি কেন। আজ অ্যামেরিকান এবং ফরাসী বিজ্ঞানীরা আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমান করেছেন যে পিরামিড আদতেই পাথর দিয়ে তৈরী করা হয়নি বরং এগুলো মাটি দিয়ে তৈরী বিশালাকার ইট। এবার এই আয়াতটি পড়ে দেখুন তোঃ 'ফেরাউন বলল, ‘হে পারিষদবর্গ, আমি জানিনা যে আমি ব্যাতীত তোমাদের কোন উপাস্য আছে। হে হামান, তুমি ইট পোড়াও, অতঃপর আমার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মান কর যাতে আমি মূসার উপাস্যকে উঁকি মেরে দেখতে পারি’ (সূরা ক্কাসাসঃ আয়াত ৩৮)। আরবীতে ‘সারহান’ শব্দটির বাংলা করা হয় প্রাসাদ, ইংরেজীতে শব্দটিকে অনুবাদ করা হয় ‘টাওয়ার’ হিসেবে। কিন্তু আমরা জানি আদতে এটি প্রাসাদও নয়, টাওয়ারও নয়। পিরামিডের গোড়া প্রাসাদের মত প্রশস্ত এবং আগা টাওয়ারের মত সুঁচালো। এমন একটি স্থাপত্যের কথাই এখানে বলা হয়েছে যার ওপর আরোহন করে ফিরাউন আল্লাহকে দেখতে চেয়েছিল। আরবী এত সম্বৃদ্ধ একটি ভাষা যাকে অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে এর প্রকৃত ভাবার্থ অনুবাদ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এ’ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে গত সাড়ে চার হাজার বছর যাবত পিরামিডই ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্তম্ভ এবং মাত্র গত এক শতক যাবত এর চেয়ে উচ্চ সৌধ বা ভবন নির্মিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বহুদিন যাবত ভাবছিলেন শুধু মৃতের সমাধি হিসেবে এত বড় বড় সৌধ নির্মানের কি কারণ থাকতে পারে। বরং এর একটি কারণ থাকাই যুক্তিযুক্ত। আমি ভাবি, এই বিজ্ঞানীরা শত শত বছর বেকার সময় নষ্ট না করে এই একখানা আয়াত পড়লেই তো সঠিক তথ্য পেয়ে যেতেন! তবে এটাই সত্য, চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনী। আমরা যারা উত্তরাধিকারসূত্রে এই অসাধারন জ্ঞানের উৎস প্রাপ্ত হয়েছি তারা যতখানি সময় অন্যান্য সূত্র থেকে জ্ঞান আহরনের প্রচেষ্টায় ব্যায় করি তার তুলনায় কতখানি সময় এই মহান উৎসের ফল্গুধারা থেকে সুধা পানের জন্য ব্যায় হয়?
গাইড মহিলাটি প্রতিটি স্থানে একটি নির্দিষ্ট নিদর্শন নিয়ে দীর্ঘ সময় ভ্যাজর ভ্যাজর করছিল কিন্তু ওর কথা শেষ হলেই আর ঐ স্থানে বাকী কোন নমুনা দেখার সুযোগ দিচ্ছিলনা। তাই আমরা গ্রুপের সাথে থাকলেও এক জায়গায় না বসে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। তবে তাঁর কাছ থেকে একটি নতুন তথ্য জানতে পারলাম। তা হোল, গ্রীক সভ্যতার ওপর মিশরীয় সভ্যতার প্রভাব। আমাদের ইতিহাস পড়ানো হয় পরস্পর সম্পর্কহীন একেকটি অধ্যায় হিসেবে। কিন্তু আসলে তো ইতিহাস প্রতিটি জাতির সাথে অন্যান্য জাতির আদনাপ্রদানের কাহিনী। আমার মুখস্তবিদ্যা একেবারেই শূন্য। কিছুতেই সন তারিখ মনে থাকেনা। নইলে ইতিহাস পড়তে আমার এত ভাল লাগত যে হয়ত একটা চেষ্টা চালাতাম।
অন্যান্য সভ্যতায় শিল্পে মানব এবং পশুর প্রতিকৃতি উঠে এলেও চাইনিজ শিল্প মূলত প্রকৃতিনির্ভর এবং শৈল্পিক গুনাবলীতেও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। মিউজিয়ামের এই অংশটি বেশ ভাল লাগল। তাদের শিল্প যেমন মার্জিত তেমনি কিঞ্চিত অ্যাবস্ট্র্যাক্ট হবার কারণে কৌতূহলোদ্দীপকও বটে।
এবার আমরা গেলাম ইসলামী সংস্কৃতির জন্য নির্ধারিত অংশে। এখানে স্থাপত্যকলার নিদর্শন দেয়ার জন্য সম্পূর্ন একটি বৈঠকখানার প্রতিকৃতি তৈরী হয়েছে যার মধ্যখানে নীচু অংশে ফোয়ারা, চারপাশে উঁচু স্থানে গদি আর কার্পেট দিয়ে বসার ব্যাবস্থা, জানালাগুলোতে মিহি কাঠের কাজ, দেয়ালে দামী পর্দা আর কল্পনার দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি সিংহ দরজায় দাঁড়ানো আফ্রিকান প্রহরীদের। অ্যামেরিকান পর্যটকরা এই স্থাপত্য দেখে আহা উহু করতে করতে অস্থির, কিন্তু আমি যেন এর মাঝে দেখতে পাচ্ছিলাম ইসলামের অগ্রযাত্রার ধ্বংস। এত আরাম করে বসার ব্যাবস্থা করার পর কোন জাতি কি আর উঠে দাঁড়াতে পারে? ফলে আমাদের ধ্বংস শুরু হয়েছিল তখনই যখন আমাদের পূর্বপুরুষরা তাঁদের দায়িত্ব ভুলে গিয়ে আরাম আয়েশে ডুবে গিয়েছিলেন।
কিছু হস্তলিখিত কুর’আন এবং আরবী ফার্সী গ্রন্থ বা বইয়ের পৃষ্ঠা পেলাম যার মাঝে ছিল মানতেক আত ত্বাইর এবং শাহনামা। ইচ্ছে হচ্ছিল কাঁচের আবরন খুলে বইগুলো নিয়ে ছুঁয়ে দেখি, গন্ধ শুঁকি, পড়ি কিছুক্ষণ। কিন্তু এগুলো যদি আমার মত লোকজনের হাতে পড়ত তাহলে আর এই প্রজন্মের দেখার জন্য টিকতনা। যাই হোক, বুঝলাম এই মিউজিয়ামটি পুরোটা ঘুরার জন্য আমাদের অন্তত তিনটি দিন হাতে রাখা প্রয়োজন ছিল। সবাই হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও এখানেই মিউজিয়াম দেখার ইতি টানতে হোল।
সকালে খালা এত খাইয়েছিলেন যে ক্ষিদে পায়নি। তবু খালা খালু চিন্তায় অস্থির ক্ষিদে পেল কিনা। পরে আমরা সবাই একটি আফগান রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবার খেলাম। তারপর চললাম ম্যাডাম তুসোঁর যাদুঘরে।
ম্যাডাম মারি তুসোঁর জন্ম তাঁর বাবার মৃত্যুর দু’মাস পর। বিধবা মা জীবিকা নির্বাহের জন্য এক ডাক্তারের বাসায় ঝিয়ের কাজ নেন। এই ডাক্তারসাহেব মোম দিয়ে রোগীদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিকৃতি বানিয়ে ছাত্রদের দেখাতেন। ছোট্ট মারি এই কাজে বেশ দক্ষটার পরিচয় দেয়। তখন ডাক্তারসাহেব তাকে মোম দিয়ে মানুষের প্রতিকৃতি বানানো শেখাতে থাকেন এবং তাঁর মৃত্যুর সময় তাঁর নিজের এবং মারির করা প্রতিকৃতিগুলো তাকে দিয়ে যান। ফরাসী বিপ্লবের সময় বিপ্লবের পক্ষের এবং বিপক্ষের প্রচুর মানুষের মুখমন্ডলের প্রতিকৃতি তাঁর দ্বারা করানো হয় যার মধ্যে রয়েছে ষোড়ষ লুই এবং তাঁর স্ত্রী মারি আঁতোয়ানেত। বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সের টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ফ্রান্সের আরো বহু প্রতিভাবান শিল্পীদের মত মারিও তাঁর শিল্পকে উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ইংল্যান্ডে যান। বহুবছরের চেষ্টা এবং সাধনার মাধ্যমে তিনি লন্ডনে একটি মিউজিয়াম করতে সক্ষম হন এবং কালক্রমে এই দেশই তাঁর এবং তাঁর সন্তানদের আবাসস্থল হয়ে ওঠে। আজ পৃথিবীর নানান স্থানে তাঁর নামে মিউজিয়াম রয়েছে যেখানে তাঁর প্রদর্শিত পন্থায় বিভিন্ন জ্ঞানীগুনী লোকজনের আসল মাপে তাদের প্রতিকৃতি নির্মান করে প্রদর্শনীতে দেয়া হয় যেগুলো দেখে মনে হয় যেন এখনই কথা বলে উঠবে। নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে এমন একটি মিউজিয়াম রয়েছে।
মিউজিয়ামে পৌঁছে আবার সেই পার্কিংয়ের সমস্যা। খালু গেলেন গাড়ী পার্ক করতে, হাফিজ সাহেব গেলেন টিকেট করতে, সেখানে খালা আর হাফিজ সাহেবের ধস্তাধস্তি, খালা টাকা দেবেন আর হাফিজ সাহেব দিতে দেবেন না। সুস্বাস্থ্যের একটি উপকারীতা খুঁজে পেলাম, হাফিজ সাহেবের সাথে ধস্তাধস্তিতে পারতে হলে সুমো রেস্টলার হতে হবে। খালু তখনও পার্কিং পাননি। খালা নীচতলায় টিকেট নিয়ে অপেক্ষায় রইলেন, আমরা হৃদিতাকে নিয়ে ওপরতলায় চলে গেলাম। লিফটে সর্বোচ্চ তলায় উঠে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকতে হয়। প্রথম তলায় সব নায়ক নায়িকা। খুব মজা পেলাম, ম্যাডাম তুসোঁর প্রথম মূর্তি ছিল ভলটেয়ার। এককালে জ্ঞানীগুনী লোকজনের কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। ইতিহাসে আর কোন সময় মনে হয় দেহ এত গুরুত্ব পায়নি, আর যারা দেহকে পুঁজি করে উপার্জন করে তারা এখন মান মর্যাদায় সবার ওপরে! পরের ফ্লোরে ছিল হাউজ অফ হরর যেখানে ভয় পাবার মত সব মূর্তি। আমার ভয়ডর কম কিন্তু রাদিয়া আর হৃদিতার চিৎকারে মনে হোল লোকজনের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। ওখান থেকে বেরিয়ে এক জায়গায় কেবল দু’টো মূর্তি- শাহরুখ খান আর অমিতাভ বচ্চন। এরা আসলেই ব্যাবসা বোঝে। দু’খানা মাত্র মূর্তি, কিন্তু লোকজন, বিশেষ করে মহিলারা পারলে মনে হয় আবেগে বেহুঁশ হয়ে যায়। ওখান থেকে বের হয়ে কিছু ঐতিহাসিক লোকজনের মূর্তি- জর্জ ওয়াশিংটন, নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ। রুমের একপাশে দেয়ালে ওয়াইট হাউজের ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে ওবামা আর তাঁর স্ত্রীর মূর্তি, এখানেই দেখি ছবি তোলার জন্য লাইন বেশি। আমাদের গ্রুপ ওঁদের সাথে ছবি তুলল, আমি তুলে দিলাম কিন্তু আমার এদের সাথে ছবি তুলতে ইচ্ছে হোলনা। প্রথমত, আমি ছবি তুলতে পছন্দ করিনা যেহেতু ছবিতে আমাকে আমার মতই দেখায়; দ্বিতীয়ত, ওবামাকে আমার পছন্দ নয়। তবে আমি একটি মূর্তির সাথে ছবি তুললাম সাগ্রহে যেটাকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছিলনা। মহিলার উচ্চতা মাত্র পাঁচফুট, বয়স আশি, চামড়ায় প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি চুল পাকা, লম্বা কালো ম্যাক্সি পরা, মাথায় টুপি- বলুন তো তিনি কে? এটি ছিল মারি তুসোঁর মূর্তি, তাঁর নিজের হাতে তৈরী নিজের প্রতিকৃতি, তাঁর জীবনের শেষ কাজ। পরের ফ্লোরে গায়ক গায়িকা। দ্রুত পার হলাম। তার পরের ফ্লোরে আমার খুব পছন্দের একজনকে পেয়ে গেলাম। ছোটবেলায় তাঁর প্রতি আমার প্রচন্ড মায়া ছিল কারণ বেচারা সবসময় একা একা লুকিয়ে লুকিয়ে থাকত। বেচারা সহজেই রেগে যেত কিন্তু রেগে গেলেই তাঁর গায়ের রঙ সবুজ হয়ে যেত। আমি ছিলাম তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল কারণ আমারও প্রচন্ড রাগ ছিল, শুধু আমার গায়ের রঙ কালো থেকে লাল হয়ে যেত এই যা। চিনতে পেরেছেন তাকে? হুমম, ইনক্রেডিবল হাল্ক! ওর সাথে একটা ছবি তুললাম! পরের ফ্লোরে একটা জিনিস আমার খুব মজা লাগল, পথের পাশে দাঁড়ানো এক লোক, নড়ছেইনা, কাউকে জায়গা দিচ্ছেনা যাবার, অনেকক্ষণ খেয়াল করার পর বোঝা যায় আসলে ওটা মূর্তি! তারপর ওরা আমাদের একটা মুভি দেখাল, থ্রি ডি, সব সুপারহিরোদের নিয়ে একটা কার্টুন। বাচ্চারা মজা পেল কারণ সব ‘ম্যান’দের এখানে একত্রিত করা হয়েছে। তবে আমরাও মজা কম পেলাম না কারণ সুপারহিরোদের মারামারিতে আমাদের সীটের নীচে ফ্লোর কাঁপছিলো, কার্টুনে পানির ট্যাঙ্ক ফাটলে আমাদের গায়ে পানি ছিটাচ্ছিল, ওরা একজন আরেকজনকে আঘাত করতে গেলে সীটের ভেতর থেকে একটা লাঠি আমাদের পিঠে গুঁতো দিচ্ছিল, ওখানে রে মারা হলে ছাদে আলো চমকাচ্ছিল, আর ওরা বাবল ছুঁড়ে মারলে আমাদের চারপাশে সত্যিকার বুদবুদে ছেয়ে যাচ্ছিল। মুভি দেখার সচরাচর সময় পাইনা, কিন্তু এই মুভিটা মাত্র পনেরো মিনিট হলেও খুব মজা পেলাম।
ওখান থেকে বের হয়ে হাফিজ সাহেব বললেন জ্যাকসন হাইটস দেখা বাকী রয়ে গেল। ওখানে গেলে নাকি মনে হয় বাংলাদেশে এসেছেন। অবশ্য নিউ ইয়র্কের আরো বহু জায়গায় দেখেছি বাংলাদেশীরা রাস্তার ওপর জটলা পাকিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় গল্প জমিয়েছে। কিন্তু এখানে সর্বপ্রকার বাংলাদেশী মাছ এবং সব্জী পাওয়া যায়। আমরা নিতে পারব না কিছুই, কাস্টমসে সব ফেলে দেবে, কিন্তু খাদ্যরসিক খাবার দেখেও শান্তি পায়। তাই জ্যাকসন হাইটসে গেলাম, ওটুকু আর বাকী থাকবে কেন? খালু আর হাফিজ সাহেব গেলেন কেনাকাটা করতে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই আমরা আর নামলাম না। এই সুযোগে খালা আর দুই ননদিনীর সাথে গপ্প জমালাম, আমরা অধিকাংশই ঘুরাঘুরিতে থাকায় প্রথম দিন ছাড়া আর এই সুযোগ হয়ে ওঠেনি। রাস্তায় দেখলাম এক মহিলা সাদা সালোয়ার কামিজ পরে দোকানে ঢুকছেন, মনে হোল বাংলাদেশী, তাঁকে মাথাও নাড়ালাম। কিছুক্ষণ পর হাফিজ সাহেব এসে হতবাক হয়ে বললেন ঐ ভদ্রমহিলা বরিশালে ওনাদের প্রতিবেশী ছিলেন, তাঁর বাবা আবার খালার বড়বোনের বিয়ের ঘটক ছিলেন এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার হোল ঐ খালুকে আমরা আসার আগে বরিশাল দেখে এলেও এখন উনি এখানেই আরেক মেয়ের বাসায় থাকেন! পৃথিবীটা আবারও মনে হোল খুব ছোট কিন্তু সময় ততোধিক সংক্ষিপ্ত। তখন বাজে রাত সাড়ে এগারোটা, খালুর আম্মা বাসায় একা, আমাদের পরদিন ভোর ছ’টায় বেরোতে হবে, সুতরাং তাঁর মেয়ের সাথে দেখা হলেও তাঁর সাথে দেখা করার কোন উপায় নেই।
বাসায় পৌঁছে প্রথমেই বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। হাফিজ সাহেব খেতে না পারলেও মাছ আর সব্জী হাত দিয়ে ধরেই মজা পাচ্ছিলেন। তাঁকে তাঁর মত মজা পেতে দিয়ে আমি বাকী জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম, বাইরে রইল শুধু যে যা পরে যাবে সেই পোশাক। হৃদিতার কাছ থেকে একটা গল্পের বই নিয়েছিলাম যেটা গত কয়দিন ভ্রমনের সময় আমার সাথী হয়ে ছিল। বইটির শেষ কয়টি পৃষ্ঠা পড়ে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন রাত তিনটা। সবার তখন দু’ঘন্টা ঘুম হয়ে গিয়েছে। তবু সকালে সবাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে রেডি করার জন্য আমাকেই উঠতে হবে পাঁচটায়। তবে বিশেষ শান্তির কথা হোল বইটা সমাপ্ত হয়েছে!
২২ এ সেপ্টেম্বর
ভোরবেলা খালা খালু আমাদের এয়ারপোর্টে দিয়ে গেলেন। খালা এর মধ্যেই বাচ্চাদের জন্য নাস্তা বানিয়ে সাথে দিয়ে দিয়েছেন। বেরোবার মূহূর্তে আমাকে এক সেট বেডকভার উপহার দিলেন, ওটা তখন আর বাক্সে ভরার সময় নেই তাই আলাদা লাগেজ হিসেবেই নিতে হোল।
নিউ ইয়র্কে এক অদ্ভুত জিনিস দেখলাম যা এর আগে কোনদিন কোথাও দেখিনি। এয়ারপোর্টে ট্রলি নেয়ার জন্য পয়সা লাগে! পয়সা দিয়েই ট্রলি নিলাম বটে কিন্তু বেশি দূর নিতে দিলোনা। বাকী পথ সব লাগেজ আমরা চারজন মিলে হাতেই বহন করতে হয়েছে। যার মাথায় বাক্সে চাকা লাগানোর বুদ্ধি এসেছিল আল্লাহ তাকে উপযুক্ত পুরস্কারে ভূষিত করুন। নইলে সেদিন আমাদের অবস্থা হত করুণ।
প্রথম ফ্লাইট নিউ ইয়র্ক থেকে টেক্সাস। টেক্সাস এয়ারপোর্টে নামাজ পড়ে উঠলাম টেক্সাস থেকে ক্যাল্গেরীর প্লেনে। নিজের বাসস্থানের প্রতি মায়াটাই মনে হয় এমন যে সারা রাতে মাত্র দু’ঘন্টা ঘুমালেও বেশ ভালই লাগছিল। ক্যাল্গেরীর আকাশ সীমায় প্রবেশ করতেই রাদিয়া বলল, ‘আম্মু, একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছ?’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি?’ ও বলল, ‘আমি আর সর্দি টের পাচ্ছিনা’। আমি খেয়াল করলাম আমারও সর্দি উধাও! অথচ গত কয়টা দিন কি কষ্টটাই না পেয়েছি!
ক্যাল্গেরী এয়ারপোর্টে প্লেন নামতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। বেলী আপা দিয়ে গেছিলেন, ওনার স্বামী এলেন নিয়ে যেতে। কিন্তু ভাই আমাদের বাসায় না এসে আমাদের ওনার বাসায় নিয়ে গেলেন। বেলী আপা কাজে গেছিলেন, কিন্তু আমাদের জন্য খাবারের ব্যাবস্থা করে গেছিলেন যেন বাসায় গিয়ে রান্না করতে না হয়। ওনার মেয়ে এবং ভাগনীরা খুব যত্ন করে খাওয়াল আমাদের। তারপর আমরা বাসায় যাবার পথে মোনালিসা আপার বাসায় গেলাম। যাবার সময় আমার টুকটাক গহনা, যা কোনদিনই পরা হয়না তবু রাখতে হচ্ছে ছেলেমেয়ের বিয়ের জন্য, মোনালিসা আপার কাছে দিয়ে গেছিলাম। ওগুলো নিতে গিয়ে দেখি উনি তিনটা বাটি দিচ্ছেন। আমি বললাম, ‘এতগুলো বাটি কিসের? আমি তো আপনাকে কেবল একটি ছোট্ট কৌটো দিয়ে গেছিলাম!’ উনি বললেন, ‘আপনি আবার এসে রান্না করবেন? তাই আমি অল্প একটু তরকারী রান্না করে রেখেছিলাম যে আপনি গহনা নিতে এলে দিয়ে দেব’। বাসায় এসে জামাকাপড় ছেড়ে বসেছি মাত্র। দরজায় বেল শুনে দেখি ইফতেখার ভাই প্রচুর বাটি নিয়ে উপস্থিত। বললেন, ‘আপনারা অনেক ক্লান্ত। আমি বসবনা। বাটিগুলো নেন। অল্প খাবার আছে, রাতে আর রান্না করার দরকার নেই’। তাঁদের দেয়া খাবারে অবশ্য শুধু রাতটুকু নয়, আমার আর তিনদিন রান্না করার দরকার হয়নি। ক্যাল্গেরীতে এত মায়া বলেই বুঝি নিউ ইয়র্কের এত আলোর ঝলকেও ভাল লাগেনি?!
(সমাপ্ত)
বিষয়: বিবিধ
২১৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন