ঘুরে এলাম নিউ ইয়র্ক - ৬

লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ১১ নভেম্বর, ২০১৩, ১১:৪৬:২১ রাত



২০এ সেপ্টেম্বর

সকালে উঠেই হুলস্থুল করে গোছগাছ শুরু। নিউ জার্সি হয়ে নিউ ইয়র্ক যেতে হবে। সময় ঠিকমত মিলাতে না পারলে সিমিনের মত আরো কিছু হয়ত মিস হয়ে যাবে। ওদিকে নূসরাত নানান পদের নাস্তা বানাচ্ছে যেন এক সপ্তাহ থাকলে যা খাওয়াত তার একটা নমুনা দিয়ে রাখ চায় যাতে ভবিষ্যতে দীর্ঘতর অবস্থানের পরিকল্পনা নিয়ে আসি। খেয়েদেয়ে বেরোবার সময় নূসরাত আবার পথের জন্য কিছু খাবার দিয়ে দিল, এমনকি আমার নাকের বন্যায় বাঁধ দেয়ার জন্য টিস্যূর রোল পর্যন্ত দিতে ভুললনা। ওর সাথে ক্যাম্পাসের পুকুর পাড়ে বসে গল্প করা হোলনা, ছোট বোনটাকে কিছু কিনে দেয়া হোলনা, মায়ার বাঁধনটা কাটিয়ে ঠিকভাবে বিদায় নেয়ার পর্যন্ত সময় হোলনা। আবার আমরা পথে নামলাম।

যাবার সময় রাতের অন্ধকারে পথের পাশে কিছুই দেখতে পাইনি। ফেরার সময় দেখলাম পুরো পথটাই গাছপালায় ঘেরা। পটম্যাক নদী দেখে মনে পড়ল সম্ভবত 'দ্য লাস্ট অফ দ্য মোহিকানস' উপন্যাসে পড়েছিলাম কিভাবে নব আবিষ্কৃত এই মহাদেশে ভূমি দখলের প্রতিযোগিতায় ফরাসী আর ইংরেজদের যুদ্ধে পটম্যাকের পানি বহুবার লোহিতবর্ণ ধারন করেছে। ব্রিটিশ এবং অ্যামেরিকান সাহিত্যের কাঠামোগত দিক থেকে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ব্রিটিশ সাহিত্যে গল্প শুরুর আগে স্থান কাল পাত্র এমনভাবে বর্ণনা করে নেয়া হয় যেন পাঠক মানসপটে ঐ স্থানে পৌঁছে ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। অ্যামেরিকান সাহিত্যে আপনি পুরো উপন্যাস শেষ করার পরেও বুঝতে পারবেন না ঘটনাটা কোথায়, কোন যুগে ঘটেছে, কিংবা যার সাথে নায়কের ঝগড়া সে তাঁর ডানপাশের বাড়ীতে থাকে না বাঁপাশের প্রতিবেশী। এক্ষেত্রে 'দ্য লাস্ট অফ দ্য মোহিকানস' ব্যাতিক্রম। এখানে দেখানো হয়েছে কিভাবে নব্য উপনিবেশ স্থাপনকারীরা কখনো বন্ধু সেজে, কখনো শত্রুর বেশে স্থানীয় অধিবাসীদের বিলোপ সাধন করেছে। লেখায় স্থান কাল পাত্র স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে এবং রেড ইন্ডিয়ানদের হেয় করার পরিবর্তে তাদেরও যে একটি কৃষ্টি ছিল, সংস্কৃতি ছিল তা তুলে ধরা হয়েছে। তাই এই বইটি আমার খুব প্রিয়। এসব ভাবতে ভাবতে ন্যাভিগেশনে অমোনযোগী হয়ে পড়েছিলাম। হাফিজ সাহেব ফিরিয়ে আনলেন বর্তমানে, 'এবার তো পথ দেখাও!'

পথে হাফিজ সাহেবের তিনজন বন্ধু ফোন করলেন যারা নিউ জার্সিতে থাকেন। কথা ছিল আমরা নিউ জার্সিতে যে গন্তব্যে যাব তাঁরা সেখানে এসে দেখা করে যাবেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর স্পষ্ট হোল তাঁরা নিউ জার্সিতে থাকলেও উভয় স্থানের মাঝে দুরত্ব এত বেশি যে শুধু আসতেই দু'ঘন্টা লাগবে। কর্মদিবসের মাঝে চারঘন্টা কেবল যাতায়াতে ব্যায় করে বন্ধুর সাথে দেখা করা কোনভাবেই পোষায় না। তাই পথেই নির্ধারন হয়ে গেল তাদের সাথে দেখা হচ্ছেনা। এটাই অ্যামেরিকায় জীবনের বাস্তবতা।

আড়াই ঘন্টায় পৌঁছলাম মমির বাসায়। আমরা পথে থাকাকালীন মমি বার বার ফোন করছিল। আমরা যখন ওর বাসার কাছাকাছি তখন মমি ফোন করে জানাল, ‘আমি বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছি, কিন্তু বাসায় আব্বু আম্মু আছে, তোমরা এসে খেতে বসে যেও’। যখন ওর বাসায় পৌঁছলাম তখনও মমি ফেরেনি। আমার সৌভাগ্য, আমার সব বন্ধুদের বাবামায়েরা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আংকেল আন্টির সাথে দেখা হোল অনেক বছর পর, কিন্তু তাঁদের সাথে কথাবার্তা বলতে গিয়ে মনে হোল বুঝি গতকালই দেখা হয়েছে! দু’জনে অনেক স্মৃতিচারণ করলেন, জানালেন এমনকি মমির চাচীও আমার সাথে দেখা হবে শুনে আনন্দিত যদিও তিনি থাকেন অন্য স্টেটে। একটু পর মমি এসে পড়ল ওর তিন বাচ্চা নিয়ে। আমাদের শেষবার যখন দেখা হয় তখন দু’জনেরই নতুন বিয়ে হয়েছে। ওর স্বামীকে আমরা দেখিনি। সে দেশ ছেড়ে চলে আসবে, তাই একজনের কাছ থেকে বাইক জোগাড় করে হাফিজ সাহেব আর আমি অনেক দূর পথ পেরিয়ে ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এবার আবার দেখা হোল পনেরো বছর পর যখন সে তিন সন্তানের মা আর আমার দুই সন্তান। মজা পেলাম দেখে যে মমিরও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি, মনে হচ্ছে যেন সেই আগের মমি। বাচ্চাদের সময় দেয়ার জন্য সে বাসায় বসেই ট্র্যাভেল এজেন্ট হিসেবে কাজ করে, ড্রয়িং রুমের একপাশে ওর সাজানো অফিস। তবে একটা কথা না বললেই নয়। নিউ ইয়র্কের ঘিঞ্জির পর ওর বাসাটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। রাদিয়া বলল, ‘আম্মু, আন্টির বাসাটা দেখে মনে হচ্ছে আমরা ক্যাল্গেরী ফিরে এসেছি!’

খেতে বসে চোখ কপালে উঠল, কত কিছু যে রান্না করেছে মমি! তবে ও সবকিছু বাদ দিয়ে নানাবিধ আচার সম্বলিত বাটিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো, ‘আমার মনে আছে তুমি ভাতের সাথে আচার খেতে পছন্দ কর’। আসলেই আমি এমনিতে আচার খাইনা, তবে ভাতের সাথে খেতে পছন্দ করি। এই ছোট ছোট জিনিসগুলো শুধু তারাই মনে রাখে যারা আপনাকে আন্তরিকভাবে ভালবাসে। আমার বিয়ের পর একবার আমার দাদার ছোটবোন- যাকে আমি ছোটবেলায় নাম দিয়েছিলাম ভালদাদু যেহেতু এই দাদুর কাছেই থাকা হত বেশি, আহ্লাদও পাওয়া যেত বেশি- আমাদের রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়েছে। সকালে এমনিতেই দেখতে গেলাম দাদু কি করছে। গিয়ে দেখি দাদু ডাইনিং রুমে বসে চাউল বাছছে। দাদুর বাসায় দশ বারোজন কাজের লোক। তাই আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘কি ব্যাপার দাদু? তুমি চাল বাছছ কেন?’ দাদু বলল, ‘এগুলো বাছা চাল’। তখন আরো আশ্চর্য হলাম, ‘বাছা চাল আবার বাছছ কেন?’ দাদু বলল, ‘তোমার জন্য’। এবার একেবারেই বোকা বনে গেলাম, ‘আমার জন্য!’ দাদু মুচকি হেসে বলল, ‘দেখে নিচ্ছি মরা চাল আছে কিনা। নইলে তুমি খাবার টেবিলে বসে বাছতে শুরু করবে তাই’। ভালবাসা প্রকাশ করার জন্য আসলে মোমবাতি কিংবা ফায়ারওয়ার্কস প্রয়োজন হয়না, হৃদয় থেকে উৎসারিত অনুভূতিগুলো এমন ছোট ছোট বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে আপনিই হৃদয়কে স্পর্শ করে।

খাওয়া দাওয়া শেষে মমি বলল, ‘দাঁড়াও, আমরা নিশ্চিন্তে কথা বলার ব্যাবস্থা করে আসি’। ও হাফিজ সাহেবকে ঘুমানোর ব্যাবস্থা করে দিয়ে, বাচ্চাদের খেলার ঘরে আন্টিকে তদারক করতে দিয়ে চলে এলো। কিন্তু ওর ছেলের ফুটবল প্র্যাক্টিসে যাবার কথা, ভাইয়ার আসতে দেরী হবে। মমিকে বললাম, ‘চল, আমিও তোমার সাথে যাই। দিয়ে আসতে আসতে কথা হবে’। যাওয়া আসার পথে আমরা দু’জন মোটামুটি গত পনেরো বছরের স্মৃতিচারণ করে ফেললাম। কবিতা আমার প্রিয় সাহিত্যরূপ নয় কারণ আমার মোটা মাথায় কবিতা ঢোকেনা। কিন্তু রবার্ট ব্রাউনিংয়ের কবিতা ভাল লাগত আর মেটাফিজিকালদের যেহেতু এগুলো সহজবোধ্য কিংবা চিন্তার খোরাকসম্বৃদ্ধ। ব্রাউনিংয়ের ‘দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার’ কবিতাটি আমার ভীষণ পছন্দের যেহেতু এখানে সীমিত সময়কে আশার ফোয়ারা দিয়ে অসীমে রূপান্তরিত করা হয়েছে। আমাদের এই সময়টুকুও যেন সেভাবেই কাটল। ফিরে এসে ভাইয়ার সাথে দেখা হোল, এই প্রথম। ভাল লাগল তাঁকে, ভাল লাগল তিনি আমার বান্ধবীটিকে ভাল রেখেছেন, ভাল লাগল মমির তিন সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। মাগরিবের পর আমরা আবার আঙ্কেল, আন্টি, ভাইয়া, মমি আর ওর মেয়েদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, হাতে মমির দেয়া উপহার। আবার কবে দেখা হয় কে জানে! কিন্তু কিছু কিছু বন্ধন এমন হয় যেগুলো সময়ের ব্যাবধানেও থেকে যায় চির অটুট।

দীর্ঘ পথ পেরিয়ে প্রায় আড়াই তিন ঘন্টা পর গিয়ে পৌঁছলাম নিউ ইয়র্কের জ্যামেইকা এলাকায়। এদিকটা আগে আসা হয়নি। এখানে হাফিজ সাহেবের বন্ধু তাউস সাহেবের বাসায় তাঁর ইউনিভার্সিটি জীবনের তিন বন্ধু একত্রিত হয়েছিলেন তাঁদের স্ত্রীপুত্রসহ- এই তিনজনের মাঝে একজন আজিজ ভাইয়ের বাসায় দেখা করতে ছুটে এসেছিলেন যেদিন আমাদের ওনার বাসায় দাওয়াত ছিল। বহুদিন পর দেখা ওঁদের, তাই তাঁদের মনমত গল্প করতে দিয়ে আমরা ভেতরের ঘরে গিয়ে বসলাম। তাঁদের স্ত্রীদের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। প্রথমত, আমার বিয়ের সময় এঁদের কারো বিয়ে হয়নি; দ্বিতীয়ত, তাঁদের বিয়ের সময় তাঁদের স্বামীরা অ্যামেরিকায় চলে এসেছেন ফলে তাঁদের স্ত্রীদের মাঝে যারা দেশে ছিলেন তাঁদের সাথেও আমাদের সাক্ষাত হয়নি। যাই হোক, আমার সামাজিক দক্ষতা শূন্য বললেই চলে। পরিচিত অঙ্গনে যেখানে সবাই কথা বলছেন তার মাঝে দু’একটা কথার ভাঁজ দিয়ে মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারি, কিন্তু অপরিচিত স্থানে নিজের যোগ্যতার ওপর ভর দিয়ে অগ্রসর হবার মত দক্ষতার প্রচন্ড অভাব। এটাকে আবার সনাতন ভাষায় বিশ্লেষণ করা হয় ‘অহংকার’ শব্দটি দিয়ে। এসব জায়গায় আমি জেন অস্টেনের ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসের মিস্টার ডার্সিকে খুব অনুভব করি যাকে বন্ধুরা ভালবাসত, কিন্তু অচেনা লোকজন তাঁর লাজুকতাকে অহংকার হিসেবে ধরে নিত। জেন অস্টেনের মত কেউ যদি এসে আমার পক্ষে সাফাই গাইতেন কতইনা ভাল হত! এই বিষয়ে আমার একটি অভিজ্ঞতা খুব মনে পড়ে। আমার এক বাহরাইনী পত্রমিতা ছিল। মেয়েটি আমার প্রথম চিঠি পেয়েই লিখে পাঠাল, ‘আমার ধারণা তুমি প্রচন্ড অহংকারী’! আমি তো বিধ্বস্ত! কি ব্যাপার, কেন তার এমন মনে হোল? তখন সে বলল, ‘তুমি টাইপ করে চিঠি লিখলে কেন?’ আমি প্যাঁচানো অক্ষরে ইংরেজী লিখি এবং হাতের লেখাও ঠিক মুক্তার মত নয়, সেজন্য টাইপ করে দিয়েছিলাম যেন তা ওর জন্য সহজপাঠ্য হয় আর ফল হোল এই! কিন্তু তখন আমি উপলব্ধি করলাম মানুষ কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস দিয়ে অন্যকে বিচার করে। দু’বছর পর অবশ্য সে লিখে পাঠিয়েছিল, ‘তুমি মোটেই অহংকারী নও। তোমার ব্যাপারে আমার প্রথম ধারণা সম্পূর্ন ভুল ছিল’। তাউস সাহেবের বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় মোটামুটি সব ভাইদের পরিবারের সাথে একটি আন্তরিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে আসতে পেরেছি আশা করি যেহেতু তাঁরা গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন।

খালার বাসায় যতক্ষণে গিয়ে পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। সবাই প্রচন্ড ক্লান্ত। বাচ্চাদের শুইয়ে দিয়ে খালার সাথে কিছুক্ষণ গল্পসল্প করলাম। পরদিন হাফিজ সাহেবের আল্টিমেটাম পূর্ণ হবার দিন। যাবার আগে উনি খালুকে বলে গেছিলেন, ‘আব্বাজান, নিউ ইয়র্কে আমাদের শেষ দিন আমরা আপনাদের সাথে বেড়াব। সেদিন আপনি কোমরে কোন ব্যাথা রাখবেন না। কোন এক্সকিউজ শোনা হবেনা’। তাই দেরী না করে সবাই শুয়ে পড়লাম।

বিষয়: বিবিধ

২৬৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File