ঘুরে এলাম নিউ ইয়র্ক - ৫

লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ১৩ অক্টোবর, ২০১৩, ১০:৫৯:০৬ সকাল



১৯এ সেপ্টেম্বর

ভোর থেকেই রান্নাঘরে নানারকম আওয়াজ পাচ্ছি আর মজাদার সব গন্ধ, কিন্তু কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিনা যে উঠে গিয়ে একটু হাত লাগাব, ক্লান্তি আর সর্দি মিলে ভালই কাবু করে ফেলেছে। যতক্ষণে উঠলাম তখন আমি ছাড়া সবাই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। নূসরাত আবার অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাল। নাস্তা দিয়েও যে টেবিল ভর্তি করে ফেলা যায় তা প্রমাণ করার জন্যই যেন এত আয়োজন!

আজকের দিনটাই সম্বল। তাই আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এর ভেতরেই গুনবতী নানারকম খাবার, পানীয় আর আমার প্রবাহমান নাকের সেবায় টিস্যুর আস্ত রোল নিয়ে নিয়েছে। আমরা প্রথমে গেলাম ওদের ক্যাম্পাসে। ভারী সুন্দর শান্ত একটা ক্যাম্পাস, দেখলেই পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে। নূসরাত সেদিনের কাজটা ল্যাবে সেট করে সুপারভাইজারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে পনেরো মিনিটের ভেতর এসে হাজির! আমরা রওয়ানা হলাম ওয়াশিংটন ডিসি ।

ওয়াশিংটন ডিসির ডিসি শব্দটা ডিস্ট্রিক্ট অফ কলাম্বিয়ার সংক্ষেপিত রূপ। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলো রাষ্ট্রের সমষ্টি, যখন একটি রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার প্রশ্ন আসে তখন সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এটি কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেনা। সেই মোতাবেক ১৭৯১ সালে ভার্জিনিয়া এবং মেরিল্যান্ডের কিছু কিছু জমি নিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে ক্যাপিটল বা পার্লামেন্ট অবস্থিত হবে যেন এখানে প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব সমান মর্যাদা পায় (যদিও প্রায় ৫৫ বছর পর ভার্জিনিয়ার জমি ফিরিয়ে দেয়া হয়)। রাজধানীর নামকরণ হয় অ্যামেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্টের নামানুসারে। পৃথিবীর অধিকাংশ রাজধানীর মত ওয়াশিংটনও একটি নদীর তীরে অবস্থিত যার নাম পটম্যাক। রাজধানী মুলত পার্লামেন্টকে ধারণ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন এখানে রয়েছে প্রেসিডেন্টের বাসভবন ওয়াইট হাউজ, সুপ্রীম কোর্ট, বিভিন্ন দেশের এম্বাসী, প্রচুর মিউজিয়াম এবং স্থাপত্য যার অধিকাংশই মূলত ন্যাশনাল মল এলাকার আশাপাশে অবস্থিত। এই ব্যাস্ত শহরটিতে অধিকাংশ লোকজন আশেপাশের রাষ্ট্রগুলো থেকে যাতায়াত করে কাজ করে থাকে। যাতায়াতের জন্য সড়কপথের পাশাপাশি রয়েছে দ্রুতগামী ট্রেনের ব্যাবস্থা। শহরে অপরাধপ্রবণতার হার অনেক বেশি। এক সময় এই শহরের এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। পরবর্তীতে সরকারের বিবিধ পদক্ষেপের কারণে একটি বিচিত্রবর্ণ সমাজ সৃষ্টি হয়েছে।

নূসরাতদের ক্যাম্পাস থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত প্রায় পুরো পথটা বেশ গাছপালায় ঘেরা ছায়াঢাকা, পথে বাচ্চাসহ হরিণও দেখলাম। ওয়াশিংটন পৌঁছে আমরা ন্যাশনাল মলের কাছাকাছি লোগান সার্কেলে গাড়ী পার্ক করলাম। এখানে কিছু হেরিটেজ হাউজ আছে। ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে এগুলো রয়ে গিয়েছে। রাদিয়া বলল, 'আম্মু, তোমাদের চট্টগ্রামের বাসাটাও তো এরকম। এটা দেখার জন্য ওয়াশিংটন আসতে হয় নাকি?' আসলে ব্রিটিশ আমলে বানানো বাড়ীগুলো একটা দেখলে মোটামুটি সব দেখা হয়ে যায়- পানখাওয়া দাঁতের মত লাল ইটের মুখগুলো প্রায়ই হয় ষড়ভুজ আকারের কিংবা চতুষ্কোণ, ছোট্ট ছোট্ট কামরা আর অনেক অনেক জানালা দরজা- এই হোল এই স্থাপত্যের সারসংক্ষেপ।

ওখান থেকে হেঁটে ন্যাশনাল স্কোয়ারে পৌঁছে দেখি বিশাল বিশাল বাগানের মাঝে আবার সেই ইট কাঠ লোহা পাথরের স্তুপ। একটা স্তুপে ঢুকলাম- লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস- পৃথিবীর বৃহত্তম দু'টি লাইব্রেরীর একটি। এখানকার বইয়ের কালেকশন কিংবদন্তীতুল্য। কিন্তু পুরোটা ঘুরে মনে হোল একে বিদ্যামন্দির বলাই যথার্থ। প্রচুর মূর্তি, বিশাল বিশাল সব ছবি, চার্চের মত রঙ্গিন কাঁচ দেয়া জানালা, কিন্তু বই ধরাছোঁয়ার বাইরে। বই যদি হাত দিয়ে ছোঁয়া না যায়, এর গন্ধ শোঁকা না যায়, স্পর্শ দিয়ে এর অনুভূতি পাওয়া না যায়, চোখ দিয়ে এর সৌন্দর্য অনুভব করা না যায়, মন দিয়ে এর বানী উপলব্ধি করা না যায় তাহলে কি মন ভরে? মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বের হয়ে ক্যাপিটল বিল্ডিং দেখলাম। প্রচন্ড গরমের মধ্যে আর হাঁটতে ইচ্ছে করছিলনা। তাছাড়া এইসব স্তুপ আর সহ্য হচ্ছিলোনা। হাফিজ সাহেবকে বললাম, 'চলেন, ভার্জিনিয়া যাই'। ওনার ড্রাইভ করতে ইচ্ছে করছিলোনা। কিন্তু নূসরাত যখন বলল, 'তাহলে আমি ড্রাইভ করি', উনি সাথে সাথে বললেন, 'আচ্ছা, যাওয়া যাক'। ওর ড্রাইভিংয়ের ওপর ওর ভাইয়ের আস্থার পরিমান দেখে নূসরাতও হাসতে লাগল।

ভার্জিনিয়া যাবার পথে ওয়াশিংটনের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো দেখতে দেখতে যেতে লাগলাম। স্মিথসনিয়ান ইন্সটিটিউশনে যাবার খুব ইচ্ছে ছিল, এমন বিচিত্র কাহিনী সচরাচর শোনা যায়না- এক বৃটিশ বিজ্ঞানীর সমস্ত সম্পদ উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন তাঁর ভাগ্নে যিনি নিজেও নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান, মারা যাবার সময় তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ দান করে যান এমন একটি দেশে জ্ঞানের বিচ্ছুরণের জন্য যেটি তিনি নিজেই দেখেননি! কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছিলনা, মনও এই স্তুপসমূহের মাঝে হাঁপিয়ে উঠেছিল।

সিমিনকে ফোন করলাম, 'ভার্জিনিয়া আসছি'। কিন্তু বেচারীর কাজ বিকাল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা। মনে হচ্ছিলোনা আমরা কোনভাবেই গিয়ে ওকে পাব, তবু ফোনে কথা বললাম কয়েকবার। পথটুকু ভীষণ ভাল লাগছিল। উঁচুনীচু পাহাড়শ্রেণীর মাঝে সোজা পথ। অ্যামেরিকার রাস্তাগুলো ক্যানাডার মত এতটা প্রশস্ত নয়, লেনগুলোও অপ্রশস্ত, এর মধ্য দিয়ে ওরা গাড়ী চালায় স্পিড লিমিটের অনেক অনেক ওপরে, অধিকাংশই সীট বেল্টের তোয়াক্কা করেনা, ক্যানাডিয়ানরা আইনের প্রতি অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল। নিউ ইয়র্ক থেকেই আমরা রাস্তার নিয়ম অনুযায়ী স্পিড লিমিট বজায় রেখে গাড়ী চালিয়ে আসছি আর দেখি আশেপাশে সব গাড়ী সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে! তবে এই রাস্তায় ভিড় ছিল তুলনামূলকভাবে কম।

দু'এক ঘন্টা পর ভূমির বিন্যাস মনে হতে লাগল যেন সমুদ্রের ঢেউ। বিশ বছর আগে রিডার্স ডাইজেস্টের একটি বই পড়েছিলাম যেখানে পৃথিবীর সব আশ্চর্য জায়গাগুলোর বর্ণনা এবং ছবি ছিল। তার মধ্যে একটি অধ্যায় ছিল শেনানদোয়াহ। এটি ছিল ইরোকি রেড ইন্ডিয়ানদের পবিত্র ভূমি, মাইলের পর মাইল জুড়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত উঁচুনীচু সমভূমি, গাছপালা আর ঘাসে ছাওয়া যাকে ওরা ভালবেসে ডাকত শেনানদোয়াহ যার সম্ভাব্য অর্থগুলির একটি ছিল 'বিউটিফুল ডটার অফ দ্য স্টারস' (সুন্দরী তারকাকন্যা)। খালাত বোনকে বইটি দেখিয়ে বলেছিলাম, 'আল্লাহ যদি কোনদিন আমাকে এই জায়গাগুলো দেখতে যাবার তাওফিক দিতেন!' হাফিজ সাহেবকে বললাম, 'জায়গাটা দেখে আমার শেনানদোয়াহর বর্ণনা মনে পড়ে গেল!' একটু পর রাস্তায় সাইনবোর্ড চেক করতে গিয়ে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল, জায়গার নাম শেনানদোয়াহ! ঐ মূহূর্তের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত মন বার বার উচ্চারন করছে, 'সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহান্নাহিল আজীম। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ!' আজ যদি আমি ঐ ইট কাঠ লোহা পাথর দেখে দিনটা কাটিয়ে দিতাম তাহলে এই অসাধারন সৃষ্টি আমার কল্পনাতেই রয়ে যেত, বাস্তবে দেখা হতনা; আজ যদি নূসরাত সামান্য কসরত না করত তাহলেও এখানে আসা হতনা; আজ যদি আল্লাহ হাফিজ সাহেবের মন পরিবর্তন করে না দিতেন তাহলেও এই অপূর্ব সৃষ্টি দেখা হতনা। বিশ বছর আগের স্বপ্ন আল্লাহ আমার অজান্তেই পূরণ করে দিলেন! অতঃপর আমি আমার রাব্বের আর কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করব?!

দু'চোখ মেলে দেখতে রইলাম এই মাটির সমুদ্র, যতটুকু পারি স্মৃতিতে গেঁথে নেবার আশায়। মনের অবস্থা বোঝাতে পারবনা। খালাখালুকে মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছি লুরে ক্যাভার্নে যাবার কথা বলার জন্য। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন গুহার কথা পড়ে আসছি। সেই গুহামানবের বাসগৃহ থেকে আজকের গুহাবাস পর্যন্ত যত গুহার কথা পড়েছি, ছবি দেখেছি তার মাঝে আমাকে সবচেয়ে আকর্ষন করত সেই সব গুহা যেগুলোতে হাজার হাজার বছর ধরে পানি চুঁইয়ে পড়ে সৃষ্টি হয়েছে নানাধরনের অদ্ভুত প্রাকৃতিক স্থাপত্য। লুরে ক্যাভার্ন তেমনই একটি গুহা। ১৮৭৮ সালে যখন জানা গেল চুনাপাথরের একটি উচ্চভূমির ফাটল থেকে শীতল হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে পাঁচজন স্থানীয় লোক কৌতুহলী হয়ে খুড়তে গিয়ে এই গুহাটি পেয়ে যায়। গুহার খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং অ্যামেরিকায় সবকিছু যেভাবে ব্যাবসার উপায়ে পরিণত হয় তেমনি এটিও পয়সার বিনিময়ে দর্শনীয় স্থানে রূপান্তরিত করা হয়।

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছই তখন পৌনে পাঁচটা, শেষ ট্রিপের টিকেট বিক্রি হচ্ছে। নূসরাত গাড়ী থেকে নেমেই দিল দৌড়। ওর অসদুদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আমাকেও দৌড় দিতে হোল। দৌড়ে ভাল ছিলাম, বয়সের সাথে সাথে ওজন না বাড়ার কারণে অন্যদের তুলনায় উত্তরোত্তর ভালই হয়েছি। ক্যাভার্নের টিকেটের দাম ভালই, নূসরাতের সাথে ধস্তাধস্তি করে টিকেট কিনলাম। তবু সে দমে যাবার পাত্রী নয়, ওর কাছে ডিসকাউন্ট কার্ড ছিল, ওটা দিয়ে টিকেটের দাম কিছু কমাল। ট্রিপ শুরু হতে পনেরো মিনিট সময় ছিল। ততক্ষণে সবাই আসর নামাজ পড়ে নিলাম।

গুহায় ঢুকলাম পাঁচটায়। একঘণ্টার ট্যুরে সাথে গাইড আছে নানান বিষয় বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। এই গুহাটি একসময় পানিতে পরিপূর্ণ ছিল, অম্লধর্মী সেই পানি গুহাভ্যন্তরের নরম চুনাপাথরকে গলিয়ে খালি জায়গার সৃষ্টি করে। পরে পানি সরে যেতে থাকে এবং চুঁইয়ে পড়া পানি অবশিষ্ট চুনাপাথরকে নানান বিন্যাসে সাজিয়ে একটি অনবদ্য প্রাকৃতিক স্থাপত্য সৃষ্টি করে। গুহাভ্যন্তরের এই স্থাপত্য মূলত চুনাপাথরের তৈরী হওয়ায় সৃষ্টিগতভাবে শ্বেতবর্ণ। তবে এর মধ্যে লৌহের উপস্থিতির কারণে লাল কিংবা হলুদ; তামার উপস্থিতির কারণে নীল বা সবুজ; এবং ম্যাঙ্গানিজ ডাই অক্সাইডের কারণে কাল বর্ণ ধারণ করতে পারে। এটি এখনও জীবিত অর্থাৎ এখানে এখনো পানি চুঁইয়ে পড়ে নতুন নতুন স্ট্যালেগমাইট এবং স্ট্যালেকটাইট তৈরী হচ্ছে। পানির সাথে যে খনিজ থাকে তা যখন মাটির ওপর জমা হতে হতে ওপর দিকে উঁচু হতে থাকে তখন তাকে স্ট্যালেগমাইট বলে। আর যদি তা ওপর থেকে ঝুলতে ঝুলতে নীচের দিকে নামতে থাকে তখন তাকে স্ট্যালেকটাইট বলে। এর প্রতি কিউবিক ইঞ্চি তৈরী হতে পানির ধারার ওপর নির্ভর করে ১২০ থেকে ৩০০ বছর সময় লাগে। অর্থাৎ আমরা ঐ মূহূর্তে যা দেখছি তা পৃথিবীর হাজার হাজার বছরের ইতিহাসকে ধারণ করে আছে!

এখানে তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। অ্যামেরিকায় আসার পর থেকে গরমে কষ্ট পাচ্ছিলাম যেহেতু এখানে ক্যানাডার চেয়ে তাপমাত্রা বেশি। এবার শান্তিতে হাঁটা এবং দেখা যাচ্ছিল। গুহায় যে কতরকম বিন্যাস ছিল সব আলোচনা করে শেষ করা সম্ভব নয়- একেবারে প্রাচীন ও মজবুত স্ট্যালেগমাইট আর স্ট্যালেকটাইট মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে এমন থেকে এখনো গাঠনিক পর্যায়ে আছে এমন পাথরও ছিল। তবে আমাকে যে জিনিসগুলো সবচেয়ে আকর্ষন করেছে তার মধ্যে কয়েকটি জিনিস তুলে ধরা যেতে পারে। গুহায় বিভিন্ন স্থানে মানুষের হাড়গোর পাওয়া গিয়েছে তবে একটি লাশ সম্পূর্ন পাওয়া যায়। মেয়েটিকে সম্ভবত তার আত্মীয় স্বজন কবর দিয়ে চলে যায়, পরে মাটি ধ্বসে পড়লে সে সরাসরি গুহায় পড়ে যায়। রেড ইন্ডিয়ান মেয়েটির সম্মানে ওরা স্থানটির নাম দিয়েছে দ্য প্রিন্সেস চেম্বার। খুব মজা পেলাম। মেয়েটি জীবিত থাকলে এই সম্মান পেত কিনা সেটা আলোচনার অবকাশ রয়েছে। মানুষ মৃত ব্যাক্তিকে যে সম্মান দেয় সেটা জীবিত ব্যাক্তিকে দেয় না কেন সেটা আমার কাছে একটা বিস্ময়। মৃত ব্যাক্তি কি সম্মান অসম্মান বোঝার মত অবস্থায় থাকে? জীবিত ব্যাক্তিই কি সম্মানের বেশি হকদার নয়?

একটি জায়গা অসাধারন লাগল। ওপরে প্রচুর স্ট্যালেকটাইট, দেয়ালের মত একটি পাথরের আড়ালে থাকায় এদের দেখা যায়না। নীচে ওদের চুঁইয়ে পড়া পানি জমা হয়ে একটি সরোবরের মত সৃষ্টি করেছে। ওখানে স্ট্যালেকটাইটের ছায়া এত স্পষ্ট দেখা যায় যে মনে হয়ে সব পানির নীচে স্ট্যালেগমাইট! অসাধারন সুন্দর এই প্রতিচ্ছায়া কাঁচের ওপর প্রতিফলনের চেয়েও যেন বাস্তব!

এক জায়গায় দেখলাম একটি বিশাল স্ট্যালেকটাইট, অন্তত তিনতলার চেয়ে কম উচ্চতার হবেনা, ভূমিকম্পে উপড়ে পড়ে ওভাবেই শুয়ে আছে। ঐ মূহূর্তে ভূমিকম্প হলে আমাদের কি হতে পারে ভেবে শিউরে উঠলাম যদিও জানি এগুলো সহজে খসে পড়েনা।

এক জায়গায় কর্মচারীরা ভুলে দু'টি মিনি সাইজের স্ট্যালেগমাইট ভেঙ্গে ফেলেছিল। তবে এর ফলে দেখার সুযোগ হয় এই পাথরগুলোর ভেতরটা দেখতে কেমন হয়। অবিশ্বাস্য হলেও এগুলো দেখতে হুবহু ডিম ভাজির মত, মধ্যখানে একটা খনিজ কুসুম আর বাইরে ডিমের সাদার মত জমা হওয়া পাথর!

তবে যে স্থাপত্যটি দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলামনা তা ছিল এমন কিছু পাথর যা ঝরঝর করে পানি পড়লে সৃষ্টি হয়। পানির স্রোতের কারণে এখানে এক ইঞ্চি পাথর তৈরী হতে লাগে তিনশ বছর। কিন্তু এগুলো দেখতে যেন দামী পর্দার মত, চওড়া পর্দায় ভাঁজ ভাঁজ, এক ইঞ্চির আটভাগের এক ভাগ পুরু এই পর্দার ভেতর দিয়ে আলো দেখা যায় অথচ আদতে এগুলো পাথর! এর সৌন্দর্য যতই দেখি তবু যেন মন ভরেনা!

এখানেও মানুষের আধিপত্য বিস্তারের কিছু চিহ্ন চোখে পড়ল- গুহায় ঢুকতেই প্রথম স্ট্যালেগমাইটটির নাম ওয়াশিংটন; একজোড়া পিলারসদৃশ স্টালেগমাইট যার সাথে স্ট্যালেকটাইট মিলে গিয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে, এখানে প্রচুর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এই আশায় যে এই সম্পর্কে এই পিলারের মত হবে; একটি সরোবর যেখানে কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকজন মানত করে পয়সা ছুঁড়ে গুহামালিকের সম্পদ বৃদ্ধি করে; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের তালিকা; সম্পূর্ন গুহাটিকে একটি বাজনায় রূপান্তরিত করা। তবু আল্লাহর এই অনবদ্য সৃষ্টি দেখে চোখ আর মন উভয়ই তৃপ্ত হোল।

বের হয়ে দেখি সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গিয়েছে, নূসরাত যে খাবার এনেছিল তাই খাওয়া হোল। তারপর মাগরিব পড়ে আবার বাল্টিমোর রওয়ানা হতে হোল। তখনও পৌঁছতে এগারোটার পর হবে। সিমিনের কাজ শেষ হবে এগারোটায়। সুতরাং কোনভাবেই ওর সাথে দেখা করা সম্ভব না। এই একটি অপূর্ণতা নিয়ে ফিরে চললাম।

আমরা তখন পথে, নূসরাত শামসকে ফোন বলল ভাত বসিয়ে দিতে, আলু সেদ্ধ করতে। গুনবতী পৌঁছে মাত্র এমন মজার এক আলু ভর্তা বানাল যে অন্য সব তরকারী বাদ দিয়ে আমরা ভর্তা দিয়ে রাতের খাবারটা তৃপ্তি সহকারে খেলাম। শুতে যাবার আগেই নূসরাতের ভাইয়ের একটি সুখবর পেলাম। সব মিলিয়ে চমৎকার একটি দিন শেষে কৃতজ্ঞচিত্তে ঘুমাতে গেলাম।

বিষয়: বিবিধ

২২৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File