ঘুরে এলাম নিউ ইয়র্ক - ৪

লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ০৮ অক্টোবর, ২০১৩, ১১:৩৩:১৬ সকাল



১৮ই সেপ্টেম্বর

আমরা যারা অনার্সে একসাথে পড়েছি তার মধ্যে বেশ কিছু বান্ধবীর বিয়ে হয় বিদেশে অবস্থানরত পাত্রের সাথে, আবার কিছু কিছু বান্ধবী বিয়ের পর সপরিবারে বিদেশে পাড়ি জমায়। আমাদের সবচেয়ে বন্ধুবৎসল সহপাঠী ছিল বর্ণালী। ওর কাছে মোটামুটি সবার খবরাখবর পাওয়া যায়। সে স্বামীর সাথে নিউ ইয়র্ক চলে আসে আমরা ক্যাল্গেরী আসার কিছুদিন পরই, লং আইল্যান্ডেই থাকে। নিউ ইয়র্ক যাবার প্ল্যান হবার সাথে সাথে সবার আগে ওর সাথেই যোগাযোগ করি, অথচ আসার পর থেকে ফোনে পর্যন্ত কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠছিলোনা। মেয়েদের জীবনের বাস্তবতাই এমন যে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়স্বজন, স্বামীর বন্ধুবান্ধব নিজের আত্মীয়বন্ধুদের চেয়ে প্রায়োরিটি পায়। যে বান্ধবীরা ছুটিতে দেশে যান তাঁরা ফিরে এসে অতৃপ্তি প্রকাশ করেন যে বাপের বাড়ী আর শ্বশুরবাড়ীর মাঝে ছুটাছুটি করতে করতেই ছুটিটা কেটে গেল। এখানে ব্যাস্ত জীবন, পরিকল্পনা থাকে দেশে গেলে হয়ত বিশ্রামের সুযোগ হবে। অথচ কার্যত দেখা যায় উভয়পক্ষের লোকজনকে খুশি করতে করতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে আসা হয়, তারপর আবার সেই কাজের সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়া। যাই হোক, বর্ণালীর সাথে প্ল্যান হয়েছিল সকালে ওর বাসায় নাস্তা খেয়ে ওদিক থেকেই আমরা সরাসরি বাল্টিমোর চলে যাব। সকালে উঠে দেখা গেল রুশার গাড়ির চাকা বদলানো প্রয়োজন। রুশা তখন ইউনিভার্সিটিতে, গাড়ীর কাগজপত্র কোথায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। কাগজপত্র ছাড়া আমরা গাড়ী নেবনা। খালা খালু গাড়ী ভাড়া করে যেতে দেবেন না। সব মিলে এক জগাখিচুড়ি অবস্থা। ওদিকে বর্ণালীর অফিসের সময় হয়ে গেল। হাফিজ সাহেব বললেন, 'চল, আমরা আগে গিয়ে বর্ণালীর সাথে দেখা করে আসি, নইলে হয়ত আর দেখাই হবেনা'।

আমরা যতক্ষণে বর্ণালীর বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম ততক্ষণে ওর অফিসে যাবার সময় পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ও অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে দেরীতে যাবে। আমার এই বন্ধুপাগল বান্ধবীটির বিশেষত্বই এই যে ওর কাছে বন্ধুরা সবার আগে। যাবার সাথে সাথে সে আফসোস করতে লাগল ওর স্বামী অফিসে আর মেয়ে স্কুলে চলে গিয়েছে, যেন আমাদের জন্য সবাই কাজ বাদ দিয়ে বসে থাকবে! ওর শ্বশুরবাড়ী চট্টগ্রাম। ক্যাল্গেরী চলে আসার আগে যখন শেষবার ওর সাথে দেখা করতে গেছিলাম তখন ওর এক জায়ের মেয়েকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে বলেছিল। দেখি উনি এখানে চলে এসেছেন মেয়েসহ! ওর শাশুড়িও এসেছেন বেড়াতে। ওর ঘর, বাগান ঘুরে দেখলাম। ওর বানানো মজার মজার নাস্তা খেলাম। অনেকের খোঁজখবর পাওয়া গেল। ও ভাল আছে এটা নিজ চোখে দেখে আনন্দিত হলাম। কথাপ্রসঙ্গে ও জানাল এক বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে দেখে গৃহকর্ত্রীর মা আমাদের চেনেন, তবে কিভাবে চেনেন বর্ণালী জানেনা। ঐ বাসায় ফোন করে জানতে পারলাম তিনি আই আই ইউ সি'র সাবেক প্রো ভিসি লোকমান স্যারের স্ত্রী, নিউ ইয়র্কে মেয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। ওনাকে যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখা গেল উনি তখন এডমন্টন চলে এসেছেন ছেলের বাসায়। যাক, এডমন্টন ক্যাল্গেরী থেকে আড়াই ঘন্টার পথ, ফিরে এসে যাওয়া যাবে। তবে আমরা ফিরে আসার পাঁচদিন পর তিনি নিজেই ক্যাল্গেরী আসেন, আমাদের বাসায় বেড়াতে এলে বহুদিন পর আবার তাঁর সাথে সাক্ষাত হয়।

আমরা চলে আসার একটু আগে বর্ণালী বলল, 'ভুলেই গেছিলাম, মমি বলেছিল তুই এলে ফোন দিতে'।

অনার্স জীবনে আমরা চার বান্ধবী সবসময় একসাথে থাকতাম- শিমু, মমি, সিমিন আর আমি। এর মধ্যে শিমু ছিল ফিলোসফার, মমি ছিল সিনসিয়ার, সিমিন ছিল কমেডিয়ান আর আমি ছিলাম সিরিয়াস। এছাড়া আমাদের আরেকটা বিশেষত্ব ছিল- আমাদের একজন ভি করে গায়ে ওড়না দিত, একজন আধামাথা ঢেকে ওড়না পরত, একজন পুরামাথা ঢাকত, আরেকজন মুখসহ ঢাকত- কিন্তু তখন মানুষ অনেক বেশি উদারপন্থী ছিল, এগুলো কখনোই আমাদের বন্ধুত্বে অন্তরায় হিসেবে দেখা দেয়নি। আমরা প্রতিবছর ৮ই মে যেকোন এক জায়গায় মিলিত হতাম, একেকজন একেকরকম খাবার তৈরী করে নিয়ে আসত আর তার স্বাদ যেমনই হোক সেটাই অমৃত মনে করে খেতাম। ৮ই মে কেন সেটা অবশ্য আমরা কেউই জানিনা! একবার ৮ই মে উদযাপিত হয় আমার বাসায়। আমাদের ডাইনিং রুমের ফ্যানটা উৎকট রকম ঘটঘট শব্দ করত। এর মধ্যে আমরা বসে বসে মমির হাতের মজাদার মটর পোলাও খাচ্ছি। শিমু বলল, 'মনে করি, আমরা প্যারিসের রেস্টুরেন্টে মিউজিক শুনে শুনে খাচ্ছি, তাহলে ফ্যানের শব্দটা মিষ্টিমধুর মনে হবে!'

আমাদের যেকোন কাজ করতে হলে মমিকে বলার সাথে সাথে ও করে দিত, তাই পুরো ক্লাস ওকে 'সিনসিয়ার' ডাকত। আর সিমিনের এক একটা কথা শুনলে হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যেত। একবার খুব ক্ষিদে পেয়েছে, ক্যান্টিনের সিঙ্গারা অখাদ্য, রাস্তার ওপাড়েই আয়মানস যেখানে মজার মজার সব খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু মাঝখানে বিরাট লোহার গেটটা শেকল দিয়ে তালা মারা। আমি মনে মনে ভাবছি, 'কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট ...'। মমি বলল, 'আমরা একটু ঘুরে অন্য গেট দিয়ে যেতে পারি'। শিমু বলল, 'শুধু খাওয়ার জন্য এত কষ্ট করব?' সিমিনের চটপট উত্তর, 'রাসূল (সা) বলেছেন জ্ঞানার্জনের জন্য চীনদেশে যেতে, আর আমরা খাওয়ার জন্য আয়মানসে যেতে পারবনা?!'

নিউ ইয়র্ক যাবার আগে মমির সাথে ফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু যাবার পর কিছুতেই ও আমাকে পায়না আর আমি ফোন করারই সময় পাইনা। ওর সাথে কথা বলতে বলতে জানালাম ভার্জিনিয়া যাচ্ছি, ফেরার পথে ওর বাসা হয়ে আসব। মমি বলল, 'ওখানে আমাদের এক বান্ধবী আছে, আন্দাজ কর তো কে?' আমি একজনের কথা বললাম। ও বলল, 'নাহ, সে না। এ যে অ্যামেরিকা এসেছে তা আমি নিজেই দু'দিন আগেও জানতাম না'। বুঝতে পারলাম না কে হতে পারে। খানিক পরে মমি নিজেই পরিষ্কার করে দিল, 'সিমিন ভার্জিনিয়া এসেছে আড়াই বছর হয়ে গেল অথচ দুষ্টটা আমাদের কারো সাথে যোগাযোগ করেনি!' আমি তো শুনেই চিৎকার! হাফিজ সাহেব বলে, 'কি হোল? কোন দুঃসংবাদ?' এমন বেরসিক লোকের সাথে কি করে যে থাকি আমি! খুশির চিৎকারও বোঝেন না। সিমিনের নাম্বার নিলাম। তারপর বর্ণালীর বাসা থেকে বেরোলাম। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলে হয়ত আগে ভার্জিনিয়া যাওয়া যেতে পারে।

খালার বাসায় যেতে যেতে ছাত্রীজীবনের নানান মজাদার ঘটনা স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে লাগল। তবে পৌঁছে কঠোর বাস্তবতার সম্মুখীন হলাম। চাকা ঠিক করতে করতে বেজে গেল তিনটা। অচেনা জায়গায় দিনের আলো থাকা অবস্থায় ভ্রমন করতে পারলে চিনতে সুবিধা হয়। কিন্তু সমস্ত কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে করতে ছয়টা বেজে গেল। তবু এক ঘন্টার মত দিনের আলো পাওয়া যাবে ভেবে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। ভার্জিনিয়া যাওয়া অসম্ভব, বাল্টিমোরই যেতে হবে। তবে বিধি বাম। বর্ণালীর বাসা পর্যন্ত পৌঁছতে সকালে লেগেছিল আধঘন্টা, এখন ট্রাফিক জ্যামের কারণে ঐটুকু পথ যেতে চলে গেল এক ঘন্টা। কুইন্স পেরোবার আগেই অন্ধকার নামল জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজে যখন উঠছি তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে রাতের বেলা বলেই হয়ত দোতলা ব্রিজটার মাহাত্ম বেশি চোখে পড়ল। ব্রিজ পেরিয়ে নিউ জার্সী ঢুকতেই পড়ল সব ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা। সি এন এন চ্যানেলে যেসব পরিবেশ দূষণের রিপোর্ট দেখতাম সেগুলো এবার সচক্ষে দেখা হোল, আসলেই বীভৎস ব্যাপার। এই এলাকাটা পেরিয়ে একটা ফিলিং স্টেশনে দাঁড়িয়ে আমরা গাড়ীতে তেল ভরলাম, গাড়ী পরিষ্কার করলাম, পাশের রিফ্রেশমেন্ট সেন্টারে অজু করে নামাজ পড়লাম, হাফিজ সাহেব কফি কিনলেন- এই বিচ্ছিরি জিনিসটা খেতে বিস্বাদ হলেও ঘুম নিরোধক হিসেবে চমৎকার, তবে আমি খাই চুইং গাম। আবার পথে নামলাম আমরা।

হাফিজ সাহেব চালক হিসেবে ভাল আর আমি খোলা রাস্তায় ন্যাভিগেটর হিসেবে ভাল যদিও আমাকে গলিপথে ছেড়ে দিলে আমি ধাঁধায় পড়ে যাই। জীবনের পথটা যেমন একা চলা যায়না তেমনি হাইওয়েতেও অ্যাসিস্ট্যান্ট ছাড়া গাড়ী চালানো যায়না, ক্লান্তি এসে যায়, পথ ভুল হতে চায়। খালার বাসা থেকে বালিশ নিয়ে এসেছিলাম দু'টো। পেছনে বাচ্চারা দু'জন দুটোতে হেলান দিয়ে ঘুম, অবশ্যই সীট বেল্ট বেঁধে শুয়ে। আমরা দু'জন কথা বলছি, উনি চালাচ্ছেন, আমি পথ দেখাচ্ছি। এভাবেই চার ঘন্টা, অনেক দূর পথ, অনেক নদী, অনেক ব্রিজ, অনেক টোল বুথ আর অনেক সুন্দর সময় কেটে গেল। পৌঁছে গেলাম নূসরাতের বাসায়। এর মধ্যে খালা আর নূসরাত যে কতবার ফোন করেছে! খালা ভাবছেন, 'ওরা যদি হারিয়ে টারিয়ে যায় তাহলে আমি আপাকে কি জবাব দেব?' আর নূসরাত ভাবছে সকাল থেকে রাত হয়ে গেল, চারঘন্টার পথ ফুরোচ্ছে না কেন?! বেচারী তো আর জানেনা আমাদের নিউ ইয়র্ক থেকে বেরোতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে!

পৌঁছনোর সাথে সাথে নূসরাতের বর শামস নেমে এলো, হাফিজ সাহেব আর শামস মিলেই জিনিসপত্র সব টেনে তুলল দোতলায়। নূসরাতের এক বেডরুম বাসাটা সুন্দর গোছানো ছিমছাম। সবাই ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। বুঝলাম, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে কথাটা সত্য বটে। আমার এই পি এইচ ডিধারী বোনটা যেমন পড়ে, তেমন লেখে, তেমনই গুছিয়ে সংসার করে, তেমনই রাঁধে আবার তেমনই ছড়ি ঘুরায়। শামস বলল, 'আপু, আপনারা আসবেন দেখে আমি আজকে অনেক কাজ করেছি'। জিজ্ঞেস করলাম, 'কি কি করলে?' ও বলল, 'কোন চাদরটা বিছালে নূসরাতের বকা খেতে হবেনা সেটাই ভেবেছি তিনঘন্টা ধরে!' খুব মজা পেলাম ওর কথায়। আর নূসরাত দেখি এত রান্না করেছে যে টেবিলে রাখার জায়গা নেই, প্লেট গ্লাস পানি দেয়ার জন্য আলাদা টেবিল প্রয়োজন হচ্ছে! খেতে খেতেই অনেক গল্প হোল- পি এইচ ডি'র পড়া কোন পর্যায়ে, এর পর পরিকল্পনা কি, আমাদের দিনকাল কেমন কাটছে, নিউ ইয়র্ক কেমন লাগল ইত্যাদি। নূসরাত এর আগে একদিন আমাদের সাথে কথা বলার জন্য খালার বাসায় ফোন করেছিল। সেদিন আমরা ম্যানহাটন ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, ওর কথা হয় খালুর সাথে। ও পরিচয় দিলো, 'আমি রেহনুমার ছোট বোন'। খালু বলল, 'ওর তো বোন নেই, তুমি কেমন বোন?' নূসরাতও মজা করে বলল, 'আমি ওনার পাতানো বোন'। খালুর খুব পছন্দ হোল বুদ্ধিমতি মেয়েটিকে, তেমনি নূসরাতেরও পছন্দ হোল মজার মজার কথা বলা খালুকে।

খাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে সোফা বেড পেতে রাদিয়া রিহামের ঘুমের বন্দোবস্ত হোল, আমাদের দেয়া হোল বেডরুমে। আর আমরা যাতে আরাম করে থাকতে পারি সেজন্য বেচারারা নিজেরা স্বেচ্ছানির্বাসিত হোল পাশের বাসায়। এমন স্বার্থপর বড়বোন কেউ কোনদিন দেখেছে? কোথায় ফ্লোরিং করে সারারাত গল্প করব! কিন্তু আসলে সবাই ছিল ক্লান্ত। আমরা জার্নি করে ক্লান্ত, আর ওরা সারাদিন ঘর গুছিয়ে রান্না করে ক্লান্ত। তাই গল্প আপাতত শিকেয় তোলা রইল।

ঠিক হোল, সকালে নূসরাত ল্যাবে গিয়ে কাজ সেট করে আমাদের সাথে ওয়াশিংটন যাবে। তারপর ভার্জিনিয়া যাবার চেষ্টা করব। কারণ তার পরদিনের প্রোগ্রাম অলরেডি সেট করা- সুতরাং হাতে সময় এই একদিনই। তারপর আমরা ঘুমের রাজ্যে অবগাহন করতে যার যার রুমে আশ্রয় গ্রহণ করলাম।

বিষয়: বিবিধ

২৫৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File