ঘুরে এলাম নিউ ইয়র্ক - ৩
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ০৬ অক্টোবর, ২০১৩, ০১:২৪:৪২ দুপুর
১৬ই সেপ্টেম্বর
ব্যাক্তিগত অভ্যাস এবং ডাউনটাউনে কাজ করার সুবাদে আমি প্রচুর হাঁটতে পারি কিন্তু বাকি তিনজনের অবস্থা ছিল বিধ্বস্ত। সকালে উঠে আলী হাসান ভাইয়ের সাথে দু'টো মিউজিয়াম দেখতে যাবার কথা থাকলেও কার্যত রাদিয়া উঠল এগারোটায়, হাফিজ সাহেবকে বেলা বারোটায় খালার বকা খাইয়ে ঘুম থেকে তুললাম, রিহাম উঠল একটায়। খালু হাফিজ সাহেবকে ভারী সুন্দর একটা টি-শার্ট উপহার দিয়ে বকা খেয়ে ঘুম ভাঙ্গার দুঃখ ভুলিয়ে দিলেন। নাস্তা খাবার পর খালা বললেন, 'আজকের দিনটা তো কোন কাজে লাগলনা। তুমি বললে অনেকদিন সমুদ্র দেখনা। চল, তোমাকে সমুদ্র দেখিয়ে আনি'।
সৈকত খালার বাসার অদূরেই। সাগর দেখতে গিয়ে বুঝলাম এ তো সাগর নয়, একেবারে মহাসাগর, অ্যাটলান্টিক মহাসাগর! ইচ্ছে ছিল বালির ওপর হাঁটব, পানিতে নামব, কিন্তু এমন দিনেই কিনা শরীর সায় দিচ্ছিলোনা। সুতরাং চললাম বাতিঘরের দিকে। এই স্থাপনাটির প্রতি আমার এক দুর্বার আকর্ষন কাজ করে। কন্যাকুমারী বেড়াতে গিয়ে সারারাত জেগে বসে কয়শ বার যে সেই একই আলোর আবর্তন দেখেছিলাম! আমার জীবনের লক্ষ্য বাতিঘর হওয়া যেন কোন একদিন কোন এক পথহারা নাবিককে পথ দেখাতে পারি। যোগ্যতা সীমিত হলেই কি আর আশা সীমিত হয়? তবু মাঝে মাঝে সীমাবদ্ধতা মেনে নিতেই হয়। বাতিঘর দেখলাম কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় সেই আড়াইশ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সাহস করতে পারলাম না। খালু একটা ঘেরা দেয়া জায়গা দেখালেন যেখানে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। শুধু তারাই গাড়ী নিয়ে যেতে পারে যাদের ওখানে বাড়ী আছে। সাগরের একটা সম্মোহনী শক্তি আছে। আবুধাবিতে আমার শোবার ঘরের জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যেত। সেই উচ্ছ্বল তরঙ্গ কখনো নীল কখনো সবুজ রঙ ধারণ করত, নেচেগেয়ে হাতছানি দিত। সারাদিন তাকে দেখার পর আবার সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা করতে যেতাম, ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত কিন্তু তার গর্জন শুনে মন ভরতনা, তার স্রোতের আসা যাওয়া দেখে প্রান ভরতনা। কোন কোনদিন ভোরে উঠে বাবার সাথে মাছ ধরতে যেতাম, রূপালী ঝলকে উছলে উঠত সমুদ্রের প্রান। বাজারে এত মাছ তবু নিজ হাতে মাছ ধরার সে কি আনন্দ! এঁরা কতইনা ভাগ্যবান যারা প্রতিদিন সাগরের এই হাতছানিতে সাড়া দিতে পারে!
বাসায় ফিরে খালুর সাথে তাঁদের দোকান দেখতে চললাম। খালাদের দোকান অ্যাস্টোরিয়ায়, বাসা থেকে এক দেড়ঘন্টার দুরত্বে। দোকানের নাম খালার নামে, দীপা মিনি মার্কেট। দোকানটি বেশ বড়, জিনিসপত্র প্রচুর, সারাক্ষনই লোকজনের আসা যাওয়া। এর মধ্যেই খালু আমাদের জন্য চা বানালেন, রিহামকে শেখালেন কিভাবে টাকা নিতে হয়, কোথায় রাখতে হয়, কিভাবে ভাংতি পয়সা গুছিয়ে রাখতে হয়, আবার কয়েকবার প্র্যাকটিস করিয়ে ওকে চকলেট আর আইসক্রীম পারিশ্রমিক দিলেন! আমরাও নিলাম যার যা প্রয়োজন। এই প্রথম কোন দোকান থেকে কিছু নিয়ে পয়সা দিতে হোলনা! দোকানের সাজ সরঞ্জামাদি সব খালুর হাতে করা। এক সময় খালারা পাশের বিল্ডিংয়েই থাকতেন, স্বামী স্ত্রী মিলে যখন যে ফ্রি থাকত তখন সে দোকানে বসত। বাসাটা দেখতে গেলাম। তারপর আমরা রওয়ানা হলাম টাইমস স্কোয়ারে।
টাইমস স্কোয়ারের নামকরন নিউ ইয়র্ক টাইমসের হেড কোয়ার্টারের নামে হলেও এটি মূলত একটি ব্যাবসাকেন্দ্র। এখানে অবস্থিত নানান ব্যাবসার মাঝে প্রধান একটি হোল বিনোদন ব্যাবসা। ব্রডওয়ে থিয়েটার, ম্যাডাম তুসোঁর মিউজিয়াম, রিপ্লির বিলিভ ইট অর নট মিউজিয়ামসহ প্রচুর অফিস, হোটেল ইত্যাদি থাকার কারণে এই পথ দিয়ে প্রতি তিন দিনে এক মিলিয়ন মানুষ হেঁটে যায় যার একটি বিশাল অংশ পর্যটক। এখানে খুব ধুমধাম করে নববর্ষ উদযাপিত হয়। রাতের বেলা সবচেয়ে দর্শনীয় হোল এখানকার বিলবোর্ডগুলো যেগুলো নিয়ন বাতি কিংবা আস্ত বিল্ডিং সাইজের টিভিস্ক্রীণের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এত আলোর ঝলকানি দেখেও গাইতে পারলাম না, নিউ ইয়র্ক 'শহর আইসা আমার আশা পুরাইল, লাল নীল বাত্তি দেইখা নয়ন জুড়াইল'। আমি বড় বেরসিক টাইপের মানুষ। কৃত্রিম বস্তুনিচয় আমাকে আকর্ষন করেনা, আলোর ঝলকানি আমার বিরক্তির উদ্রেক করে।
কিছুক্ষণ পর অ্যাডভোকেট আব্দুল আজিজ ভাই এলেন। হাফিজ সাহেবের দুলাভাইয়ের বিশেষ বন্ধু থেকে তিনি একসময় আমাদের পারিবারিক বন্ধুতে রূপান্তরিত হন। রাদিয়ার নামের আরেকটি অংশ তানজিলা রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আজিজ ভাইয়ের মেয়ের নাম তানজিলা হওয়ায় হাফিজ সাহেব রাজী হননি, 'এত কাছের সম্পর্কে দু'জনের একই নাম হলে গুলিয়ে যাবে'। আজিজ ভাইয়ের সাথে ট্রেনে করে তাঁর বাসায় চললাম। তিনি ব্রুকলিনের ইহুদী অধ্যূষিত একটি এলাকায় থাকেন। তিনি দেখালেন ওরা কিভাবে পাশাপাশি সমস্ত বাড়ীগুলো কিনে নিয়ে একটি পাড়ার মত করে নিয়েছে। ইহুদীরা ধর্মীয় ব্যাপারে অসম্ভব গোঁড়া, আর এঁরা ছিল ধার্মিক ইহুদী। পুরুষদের সবার দেখলাম লম্বা ঢোলাঢালা পোষাক আর মুখভর্তি লম্বা দাঁড়ি। ওদের বিবাহিতা মহিলারা পর্দার একটা বিকল্প সমাধান বের করেছে- মাথা ন্যাড়া করে পরচুলা পরা! তবে আমার সবচেয়ে যেটা জানার আগ্রহ তা হোল পুরুষরা, মাথাভর্তি চুল থাক কি টাকমাথা, মাথার তালুর ঠিক মধ্যখানে মিনি সাইজের একটা টুপি পরে, এটা কিভাবে আটকে থাকে। ওদের এই টুপি পরে সারাদিন ঘুরতে, এমনকি দৌড়াতে দেখেছি কিন্তু টুপি নড়েনা, টাকমাথা হলেও না!
বাসায় পৌঁছনোর আগেই দেখি ভাবী ছোট মেয়েটিকে নিয়ে বাতাসের ভেতর রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য! রাস্তার মধ্যেই গল্প শুরু! বাসায় পৌঁছে তানজিলাকে পেয়ে রাদিয়ার গল্প শুরু। তবে আমাদের পুত্রদ্বয়ের বয়সের অনুপাতে গড়মিল, ওরা বসে রইল যার যার মত। ভাবীর সেদিন কাজ ছিল তবু রান্না করে ভর্তি করে ফেলেছেন। আমি বললাম, 'এতকিছু না করে শুধু শুটকি ভর্তা করলেই তো হত!' ভাবীর উত্তরে অবাক হলাম, উনি ভেবেছিলেন হাফিজ সাহেব চট্টগ্রামের আর আমি চট্টগ্রামের বাইরের! ভেবে দেখলাম কথা সত্য। হাফিজ সাহেব চমৎকার চাঁটগাঁইয়া বলেন, আমার নাকি অ্যাক্সেন্ট ঠিক হয়না! হতদ্যোম হয়ে মুখ হাত ধুতে গেলাম। এসে দেখি ভাবী এর মধ্যেই চমৎকার শুটকী ভর্তা তৈরী করে ফেলেছেন! লজ্জা পাচ্ছিলাম যে কথাটা বলে ভাবীকে কষ্টে ফেলে দিলাম। কিন্তু উনি বললেন, 'ভাবী, বাপের বাড়ীর মানুষ দেখলেও শান্তি লাগে!' আমার যা চেহারা তাতে যেকোন ছুতাতেই চেহারা দেখে কেউ শান্তি পান শুনে যারপরনাই আনন্দিত হলাম। গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল কিন্তু মনে হোল কোন কথাই হয়নি। এর মধ্যে হাফিজ সাহেবের এক বন্ধু কামরুল সাহেব এসে ঘুরে গেলেন। অবশেষে আজিজ ভাই বললেন, 'চলেন, আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি'। ভাবীও রওয়ানা হলেন আমাদের সাথে, পথে যেতে যেতে বাকি গল্পটুকু করা যাবে। খালার বাসায় আসার পথে রাতের নিউ ইয়র্ক দেখলাম, বিশাল চাঁদের নীচে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি টিমটিমে আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চারা পথেই ঘুমিয়ে পড়ল। খালার বাসায় নেমে, ভাই ভাবীর কাছে বিদায় নিয়ে, ঘরে ঢুকে বাচ্চাদের শুইয়ে দিয়ে এসে দেখি খালু ভাত খাচ্ছেন আর 'বাবাগো, মাগো' করে কাতরাচ্ছেন। বেচারার সায়াটিকার ব্যাথার সমস্যা আছে। কিন্তু খালু কাউকে দিয়ে কাজ করানো পছন্দ করেন না, আবার কাজ না করেও বসে থাকতে পারেন না। খালার বকার ভয়ে স্বীকার না করলেও সম্ভবত উনি দোকানে কোন ভারী মালপত্র তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যাথায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। ভয়ানক অবস্থা। কোনক্রমে কিছু খেয়ে, ব্যাথার ওষুধ খেয়ে, গরম পানির ব্যাগ নিয়ে শুতে যাবেন খালু। এর মধ্যেও তিনি তরকারী ঢেকে তুলে রাখতে, প্লেট ধুতে অস্থির হয়ে পড়লেন। শেষে খালা থ্রেট দিলেন এমন অনিয়ম করলে অপারেশন করাবেন। তখন খালু বাধ্য ছেলের মত চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়লেন!
১৭ই সেপ্টেম্বর
সকালে উঠে খালা বললেন, 'তোমাদের যেহেতু নিউ ইয়র্ক ভালো লাগছেনা, তোমরা রুশার গাড়ী নিয়ে ওয়াশিংটন, ভার্জিনিয়া আর পেনসিলভেনিয়া ঘুরে এসো'।
আসলেই শুধু মানুষগুলো ছাড়া নিউ ইয়র্কের আর কিছু ভাল লাগছিলোনা। এই ইট কাঠ লোহা পাথরের মাঝে ওরা কিভাবে নিজেদের সুকোমল রেখেছেন, ঢাকাবাসীদের মত কঠোর হৃদয় হয়ে যাননি তাই ভাবি। এর জন্য এঁদের সম্বর্ধনা দেয়া উচিত! কিন্তু রুশা এক বছর চাকরী করে টাকা জমিয়ে এই গাড়ীটা কিনেছে। মানুষের শখের জিনিসে হাত দেয়া উচিত না। তাই দ্বিধা বোধ করছিলাম।
খালু কঁকাতে কঁকাতে বললেন, 'ওরা ছোটমানুষ, একা একা যেতে পারবেনা, আমি ওদের নিয়ে যাব'।
হাসব না কাঁদব? ব্যাথায় খালুর অবস্থা শেষ আর উনি আমাদের চিন্তায় অস্থির! খালারও মন চাইছে যেতে কিন্তু বৃদ্ধা শাশুড়িকে দেখবে কে? রুশার ইউনিভার্সিটি আর হৃদিতার ক্লাস চলছে পুরোদমে। তাছাড়া আমাদের জন্য ওঁদের ব্যাবসার ক্ষতি হবে এটাও আমাদের ভাল লাগবেনা। খালার সাথে বসে রুট ঠিক করে প্রোগ্রাম ঠিক করা হোল। গাড়ী চেষ্টা করব রুশারটা না নিয়ে ভাড়া করতে। ব্লগার নূসরাত রহমানকে ফোন করলাম। আমাদের নিউ ইয়র্ক যাবার কথা শুনেই বেচারী যোগাযোগ করতে শুরু করেছিল এসে আমাদের নিয়ে যাবে। জানালাম আমরা বাল্টিমোর হয়ে ওয়াশিংটন যাব। বহুদিন পর দেখা হবে এই খুশিতে আমরা ডগমগ।
দুপুরের দিকে আমরা বের হলাম ম্যানহাটনের উদ্দেশ্যে। সেন্ট্রাল পার্কের দু'পাশে দু'টো মিউজিয়াম, এই দু'টোই দেখার সংকল্প করে এসেছিলাম ক্যাল্গেরী থেকে। সেদিন উদ্দেশ্য ছিল অ্যামেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টরি দেখব। রাদিয়ার পছন্দের জায়গায় যাওয়া হয়েছে প্রথম দিনই, এটা রিহামের পছন্দের স্থান। এখানে চারতলায় বিষয় অনুযায়ী জীবনের ইতিহাস বিন্যস্ত হয়েছে। একতলায় রয়েছে পৃথিবীর নানান প্রান্তে প্রাপ্ত বিভিন্ন পশুপাখির ট্যাক্সিডার্মি। যারা ট্যাক্সিডার্মির বিষয়ে আগ্রহ বোধ করেননা তাদের জানার জন্য বলছি জিনিসটা আমারও পছন্দ না, কিন্তু এর মাধ্যমে বাচ্চারা অনেককিছু দেখার বা জানার সুযোগ পায়। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া, পালক, আঁশ ইত্যাদি নিয়ে প্রাণীটিকে জীবিত অবস্থার মত করেই মমি বানানো হয়। দেয়ালে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ছবি এঁকে, প্রাকৃতিক পরিবেশের কিছু উপাদান ফ্লোরে ছড়িয়ে দিয়ে এর ওপর প্রাণীটিকে দাঁড় করিয়ে কাঁচ দিয়ে ঘিরে দেয়া হয় যেন এটি ক্ষয়ে না যায়। তো ধরুন দেয়ালে একটি বনের দৃশ্য এঁকে, ফ্লোরে কিছু ঘাসের প্রতিকৃতি দিয়ে, সামনে একটি বহতা স্রোতের প্রতিকৃতি বানিয়ে ঘাসের ওপর একটি হরিন শিশুসহ কয়েকটি পুরুষ ও মা হরিণ দাঁড় করিয়ে দেয়া হোল। কাঁচের সামনে বর্ননা লিখে দেয়া থাকে এই প্রাণীর নাম কি, কোথায় পাওয়া যায়, কি ধরণের পরিবেশে থাকে, কি খায়, কত বছর বাঁচে ইত্যাদি। এ'রকম কয়েক হাজার ট্যাক্সিডার্মি স্থান পেয়েছে এই মিউজিয়ামে। ধারণা করুন তো একটি শিশু কয়েক মূহূর্তের ভেতর কতগুলি জিনিস শিখতে পারবে এরকম একটি উদাহরণ সামনাসামনি দেখতে পেলে! আমাদের সময় ছিল কম, পাঁচটায় মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবে। রিহাম আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে বলল, 'আম্মু চল, আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে নাহলে আমরা সব দেখতে পারবনা'। আমিও সমান উৎসাহী।
পরের ফ্লোরে ছিল নানান মহাদেশের আদি সভ্যতার কিছু কিছু নিদর্শন। দেখলাম দুরত্বের কারণে এখানে অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় দক্ষিণ অ্যামেরিকার নিদর্শনাদি স্থান পেয়েছে বেশি। হয়ত এগুলো সংগ্রহ করা এবং আনা সহজতর ছিল। সকল আদি সভ্যতার মাঝে কয়েকটি জিনিসে মিল খুঁজে পেলাম। এরা পোশাক পরতনা বা যৎসামান্য পরত, এরা নানান দেবদেবীর পুজা করত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভীত বিহ্বল জীবন কাটাত, এরা গানবাজনা নাচগান নিয়ে সময় কাটাত- ব্যাপারগুলো বর্তমান সভ্যতার চেয়ে খুব একটা আলাদা মনে হোলনা যদিও বর্তমানে দেবদেবীর স্থান দখল করেছে নেতাশ্রেণী, ধনীকশ্রেণী, অভিনেতা, গায়ক, ফ্যাশন, টাকাপয়সা, খ্যাতি ইত্যাদি। একমাত্র আল্লাহর প্রতি আনুগত্য মানুষকে এসব দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে, মানুষকে আত্মসম্মানসহকারে বাঁচার সাহস দিতে পারে। দুঃখ হোল কত বিপুল সংখ্যক মানুষ এই সহজ পথটি বেছে না নিয়ে কঠিন পথ ধরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে এবং আরো কত মানুষ সেই একই পথের যাত্রী।
পরের ফ্লোরে একপাশে ছিল মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠনপ্রনালীর বৃহৎ ছবি বা প্রতিকৃতি ও বৃত্তান্ত। সময় কম থাকায় এই অংশটি দ্রুত পেরোলাম যেহেতু এগুলো আমি বাচ্চাদের বাসায়ও বই দেখিয়ে শেখাতে পারব। শুধু একটি দেহকোষের গঠনপ্রকৃতি নিয়ে রিহামের সাথে আলোচনা করলাম। তার পাশের অংশটি ছিল খনিজ পদার্থ নিয়ে। রাদিয়াকে বছর কয় আগে ক্যাল্গেরীর খনিজ মিউজিয়ামে নিয়ে গেছিলাম, পুরো মিউজিয়ামই খনিজ নিয়ে। রিহাম তখন দু'বছরের শিশু। তাই মূলত ওকেই এই জায়গাটা ভালভাবে ঘুরিয়ে দেখালাম। হাফিজ সাহেব আর রাদিয়া ততক্ষণ বিশ্রাম নিল, নামাজ পড়ল। এখানে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল একটি উল্কাপিন্ড এবং খনিতে খনিজ কি অবস্থায় থাকে এর কয়েকটি প্রতিকৃতি। অন্যপাশে ছিল রিহাম আর আমার প্রিয় ডাইনোসর। তবে ড্রামহেলারে যে বিরাট ডাইনোসর মিউজিয়াম আছে সেখানে প্রতি বছর যাওয়া আসার পর আমাদের কারুরই এই অংশটা তেমন আকর্ষনীয় মনে হোলনা। এখানে কেবল তিনটি কঙ্কাল ছিল যেগুলো ড্রামহেলারে নেই- হরিণ, গরু আর ঘোড়ার আদি পুরুষদের কঙ্কাল। আহারে! ঐ গরু এখন একটি জবাই করলে পুরো গ্রাম সাতদিন খেতে পারত!
একেবারে নীচের ফ্লোরে যখন পৌঁছেছি তখন ঘোষনা দিচ্ছে মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবে। হাফিজ সাহেব বললেন, 'বলার সাথে সাথে তো আর বন্ধ করে দেবেনা, দশ পনেরো মিনিট সময় আছে। তুমি আর রিহাম যতটুকু পারো ঘুরে দেখে এসো। একপাশে ছিল ফসিল। এগুলো ড্রামহেলারে প্রচুর দেখা হয়েছে। তাই রিহাম আর আমি দ্রুত ঐ জায়গা ঘুরে অন্যপাশে চলে গেলাম। এখানে ছিল বর্তমানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রানীর প্রতিকৃতি। সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল নীল তিমির একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতি আর নিজের পরিবেশে সুন্দরবনের বাঘের প্রতিকৃতি। সময়ে শেষ হয়ে গেল। শান্তি পেলাম যে মিউজিয়ামের কিছু বাদ যায়নি। মা ছেলের শখ এবং সংকল্প দু'টোই পূরণ হয়েছে।
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আলী হাসান ভাইয়ের বাসায় রওয়ানা হলাম। ভাবী দু'দিন আগেই দাওয়াত দিয়ে রেখেছিলেন, পরে সিরিয়াল মিলে না মিলে। ট্রেনে করে তাঁদের বাসার কাছাকাছি পৌঁছলে তাঁরা এসে আমাদের বাসায় নিয়ে গেলেন। হাফিজ সাহেব আর আলী হাসান ভাই দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে সহপাঠী ছিলেন, প্রগতিশীল পরিবার থেকে মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ায় উভয়েই একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে বড় হয়েছেন। তাই তাঁদের দু'জন একে অপরকে যেভাবে বোঝেন সেভাবে আমার পক্ষেও বোঝা সম্ভব নয়। আলী হাসান ভাইদের চৌদ্দ ভাইবোন। এই প্রসঙ্গে আমার কিশোরীবেলার একটা ঘটনা মনে পড়লে আমি এখনো ভীষণ লজ্জা পাই। আমার এক সহপাঠিনী বলল ওরা তেরো ভাইবোন, বড়জনের বয়স তখন চল্লিশ, ছোটটি কয়েক মাস। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আচ্ছা, তোমরা সব ভাইবোন কি সবাইকে চেন?' আসলে এর আগে এতবড় পরিবার দেখিনি, কিন্তু পরে মনে হয়েছে আমার মত গাধা পৃথিবীতে আর নেই। সে শুধু আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে তাকাল কিন্তু কিছু বললনা। পরে আরেকজনের কাছে ওর একটি মন্তব্যে বুঝতে পারি আমার প্রতি ওর কোন অনুযোগ নেই, সে বুঝতে পেরেছে এই বোকামী আমার অনভিজ্ঞতার ফল, কি যে আরাম পেয়েছিলাম সেদিন, মনে হোল মনের ওপর থেকে এক বিরাট বোঝা হাল্কা হয়ে গেল! অবশ্য আমরা সহপাঠী থাকা অবস্থাতেই ওদের পরিবারে চৌদ্দতম ভাইটির পদার্পন ঘটে। যাই হোক, আলী হাসান ভাইদের অনেকজন ভাইবোন একই সময় অ্যামেরিকায় ইমিগ্রেশন পাওয়ায় তাঁরা বেশ কয়েকজন এখন তাঁর বড় ভাইয়ের বাড়ীতে অবস্থান করছেন, আর বড় ভাই এই সুযোগে বাংলাদেশে চলে গিয়েছেন! তাঁর বড় ভাইবোনরা বয়সে তাঁর অনেক বড়। মজার ব্যাপার হোল তাঁর এক বোন আমার এক দাদীর ভাইয়ের বৌ, বাবার বন্ধুর বৌ হিসেবে তাঁকে সারাজীবন মামী ডেকে এসেছি। তাঁর আরেক বোন আমার আপন ভাইয়ের চাচীশাশুড়ি, আমার বাবামা এবং আমরা উভয়েই তাঁকে আপা ডাকি! তাঁর ছেলেমেয়েরাও ছিল তখন। বাসা ভর্তি ভাইবোনদের ছেলেমেয়ে- ছেলেরা আলাদা রুমে, মেয়েরা আলাদা রুমে- এদের কেউ কেউ আবার প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে আমাদের ছাত্রছাত্রী ছিল। ভাবী খুব ভাল রান্না করেন। ভাই তাঁকে বলে রেখেছিলেন, 'আমার বন্ধু আসবে, সব চাঁটগাঁইয়া আইটেম হওয়া চাই'। ভাবী জানালেন ভাই বন্ধুর জন্য শখ করে নিজে গরুর মাংস রান্না করেন। নানাবিধ তরকারী দিয়ে খাওয়ার পর ভাবী পরিবেশন করেন ফালুদা যা চট্টগ্রামের লিবার্টির ফালুদার চেয়ে কোন অংশে কম মজাদার ছিলোনা। খাওয়ার পর ভাবী, তাঁর ননদরা সবাই মিলে গল্প হোল। আলী হাসান ভাইয়ের বাবার লেখা 'কাবা শরীফের ইতিহাস' আমার পড়া সবচেয়ে তথ্যসম্বৃদ্ধ বইগুলোর একটি। ইচ্ছা আছে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করব। আমাদের যাওয়া উপলক্ষ্যে ভাবী আলী হাসান ভাই এবং হাফিজ সাহেবের আরো কিছু বন্ধুবান্ধবকে খবর দেন। তার মধ্যে খালেদ ভাই নিউ জার্সী থেকে এসে পৌঁছান। তারপর আবার বেচারা একঘন্টার জ্যাম ঠেলে আমাদের বাসায় দিয়ে আসেন।
বাসায় পৌঁছে দেখি খালুর এই প্রাণান্তকর অবস্থার মধ্যে তাঁরা গিয়ে আমার আর রাদিয়ার জন্য জামা কিনে এনেছেন। মনে মনে একপ্রকার কষ্টই পেলাম যে আমরা আসার কারণে তাঁদের এই কষ্ট। কিন্তু খালাখালুর ভালবাসা উপেক্ষা করতে পারলাম না, বিশেষ করে যেখানে জামাগুলো এত সুন্দর। পরদিন বাল্টিমোর রওয়ানা হব তাই জামাকাপড় গুছিয়ে শুতে গেলাম
বিষয়: বিবিধ
২৩৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন