ঘুরে এলাম নিউ ইয়র্ক - ২
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ০৪ অক্টোবর, ২০১৩, ০৬:২৯:১০ সকাল
১৫ই সেপ্টেম্বর
পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আমরা চারজন। ট্রেনে করে ম্যানহাটনের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন স্টেশনে এসে নামলাম। কলকাতায় পাতাল রেলে চড়ার অভিজ্ঞতা থাকায় মাটির নীচে পথঘাট খুঁজে পেতে অসুবিধা হোলনা। নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে সিস্টেম প্রতিষ্ঠার দিক থেকে লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ের পরে হলেও আকারের দিক থেকে পৃথিবীর বৃহত্তম, দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে জটিল। কোন কোন জায়গায় তিনতলায় ট্রেন চলে। এই ব্যাবস্থা নিউ ইয়র্কের পাঁচটি বৃহৎ কাউন্টি ব্রঙ্কস, নিউ ইয়র্ক (ম্যানহাটন), কুইনস, কিংস (ব্রুকলিন) এবং রিচমন্ড (স্টেটেন আইল্যান্ড) এর মধ্যে প্রথম চারটিকে সংযুক্ত করেছে।
আমরা বের হবার অল্পক্ষণের মধ্যে আলী হাসান ভাই আমাদের সাথে একত্রিত হলেন। দুই বন্ধু চট্টগ্রামের ভাষায় গল্প করতে করতে এগোচ্ছেন। নাগরিক সভ্যতা আমাকে আকর্ষন করেনা, তাছাড়া আমি কিছুতেই নিউ ইয়র্কের আবর্জনাময় পরিবেশ আর দুর্গন্ধে অভ্যস্ত হতে পারছিলামনা, তাই রাদিয়া রিহাম আর আমি চলছি ধীরেসুস্থে। কিছুক্ষণ পর একটি দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় খেয়াল করলাম এক ভদ্র্লোক উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন সামনের দুই ভদ্রলোকের দিকে। একটু পর তিনি হাঁক ছাড়লেন, 'অবা, আঁইও চাঁটগাঁইয়া' (ভাই, আমিও চট্টগ্রামের)। কথা বলতে বলতে দেখা গেল এঁদের তিনজনই একই পরিমন্ডলে একই লোকজনের সাহচর্যে জীবন কাটিয়েছেন যদিও তাঁদের নিজেদের মাঝে দেখা হয়নি কখনো। তাঁর কাছে কিছু পরিচিত লোকজনের ফোন নাম্বারও পাওয়া গেল। ভদ্রলোক বিদেশ ছিলেন বহুবছর, বিয়েও করেছেন এক মিশরীয় ভদ্রমহিলাকে, ফলে নিজের ভাষায় কথা বলার লোক পেয়ে আপ্লুত বোধ করছিলেন। আমরা চা খাবনা, তিনি খাওয়াবেনই, পরে হাল ছেড়ে দিয়ে আমাদের একটি চায়ের মগ উপহার দিলেন। মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীটা খুব ছোট, একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝি মিলে যাবে কোন শেকড় যা আমাদের মানবতার বন্ধনে আবদ্ধ করবে। কতই না সহজ মানুষে মানুষে আন্তরিকতা! তবু মানুষ অমানুষে রূপান্তরিত হতে রয়েছে।
কিশোরী বয়সে একটা মুভি দেখেছিলাম 'ওয়াল স্ট্রিট', এটা অ্যামেরিকার ব্যাবসায়িক প্রাণকেন্দ্র, মুভির উপসংহারটা খুব ভাল লেগেছিল। টুইন টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত ফ্রিডম টাওয়ার হয়ে গেলাম ওয়াল স্ট্রিট দেখতে। পুরোনো শহরগুলোর রাস্তা তৈরী হত ঘোড়ার গাড়ী চলার জন্য, রাস্তার দুধারে স্থাপত্য নির্মান হয়ে গেলে আর শহরের চেহারা পরিবর্তন করা যায়না, ওয়াল স্ট্রিটে গাড়ী ঢোকানো মুশকিল। তবে অধিকাংশ শহরের কেন্দ্রস্থল হয় খুব ছোট, ফলে হেঁটেই দেখা যায় বা হেঁটে না দেখলে এর স্বাদ পাওয়া যায়না। ওয়াল স্ট্রিটের ফেডারেল হলটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যকলার উদাহরণ। এটি সামান্য আগ্রহ উদ্রেক করল।
এখান থেকে চলে গেলাম স্টেটেন আইল্যান্ডগামী ফেরীতে। চট্টগ্রামে জন্ম আমার, তারপর পৃথিবীর যেখানেই গেছি সমুদ্রের কাছাকাছি ছিলাম, কিন্তু ক্যাল্গেরী এসে রকি মাউন্টেনের কোলে ভূমিপরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছি। বহুদিন পর হাডসন বে'র মুক্ত হাওয়ায় প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলাম। ফেরীর প্রোপেলারের ধাক্কায় পানির ফেনাগুলো মনে হচ্ছিল যেন ঠাকুরমা'র ঝুলির গল্পের দুধসাগর। ফেরীর পেছনে ঘেরা দেয়া অংশের বাইরে একটা গাংচিল এসে বসল, খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষন করতে লাগল, মনে হচ্ছিল যেন দ্য এনশিয়েন্ট ম্যারিনারের অ্যালবাট্রস। ফেরী একটু দূরে চলে এলে বামদিকে দেখা গেল হাডসন বে'র প্রবেশ পথের দু'পাশে কামান লাগানো দূর্গ আর দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। সামনে একইসাথে নিউ জার্সী, নিউ ইয়র্ক আর কুইন্সের ইট কাঠ লোহা পাথরের আকাশচুম্বী স্তুপ, কিন্তু দূর থেকে দেখে আর এত অসহ্য লাগছেনা। ডানদিকে দোতলা ব্রুকলিন ব্রিজ। এই সফরটুকু খারাপ লাগলনা। স্টেটেন আইল্যান্ডে নামাজ পড়েই আমরা ফিরে এলাম ম্যানহাটন। এবার গন্তব্য স্ট্যাচু অফ লিবার্টি।
হাঁটতে হাঁটতে সবার ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিল। এখানে মোড়ে মোড়ে খাবার দোকানের পাশাপাশি কলকাতার মতই ঠেলাগাড়িতে খাবার বিক্রি হয় যার অন্তত অর্ধেক হালাল। এগুলোতে সব ধরনের লোকজনের ভিড় লেগে থাকে। ক্যাল্গেরীতে শীতল আবহাওয়ার জন্য এমনটা করা সম্ভব হয়না। তবে ইদানিং উষ্ণ দিনগুলোতে কিছু কিছু ভ্যানগাড়ীর পেছনে ভ্রাম্যমান কিচেন করে খাবার বিক্রি করতে দেখা যায়। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির ফেরীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিলাম স্বাধীনতার এই মূর্তি বৃটেনের কাছ থেকে অ্যামেরিকার মুক্তি উপলক্ষ্যে ফ্রান্সের উপহার হলেও এর পেছনে রয়েছে মূলত চিরশত্রু বৃটেনের প্রতি ফ্রান্সের সুক্ষ্ণ রাজনৈতিক ঠেস। এই বিশাল মূর্তি ওরা ভগ্নাংশ আকারে জাহাজে করে এনে জোড়া দিয়ে গেলেও এর ভিত্তিটা অ্যামেরিকাকে নিজ খরচে তৈরী করে নিতে বলে। এত খরচ কে করে? অ্যামেরিকানরা একটা দূর্গের মাটিরঙ্গা ইটের ভিত্তির ওপর তুলে দেয় স্বাধীনতার দেবীকে যেন তালপাতার টুকরীতে ডায়মন্ডের আংটি! আবার এই উপহার লোকজনকে দেখিয়ে আরো পয়সা উপার্জনের উপায় হয় তাদের- এক্কেবারে ডাবল লাভ! তবে ওদের এত সাধের মূর্তিটি আর দেখা হয়নি কাছে থেকে, ফেরীর সময় শেষ হয়ে গেছিল আমরা যেতে যেতে।
এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল রকফেলার সেন্টার আর টাইমস স্কোয়ার। এগুলো রাতের বেলাই দেখতে বেশি ভাল লাগে। তাই সময় ক্ষেপনের জন্য আমরা একটি আদিবাসী মিউজিয়ামে ঢুকলাম। আবার উপলব্ধি করলাম মিডিয়া আসলে কত বড় অস্ত্র। আমাদের ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়েছে অ্যামেরিকা আবিষ্কার করেন কলম্বাস আর আমরাও তা বিশ্বাস করেছি। অথচ এই মহাদেশ এর শত শত বছর আগে থেকে আবিষ্কৃত এবং অধ্যূষিত ছিল- ওরা কি তাহলে মানুষ ছিলোনা? আরব ব্যাবসায়ীরা কলম্বাসের আগমনের প্রায় সাড়ে ছয়শ বছর আগে মানচিত্রে এই মহাদেশ সুচারুরূপে এঁকে রাখে- ওরাও কি মানুষ ছিলোনা? মিউজিয়ামে হাতেগোণা যে কয়টি বস্তুসামগ্রী দেখলাম তাও এত উচ্চমানের যে এই আদিবাসীদের আদিম বা অসভ্য বলার কোন উপায় নেই। তাহলে বাকি থাকে একটিই অস্ত্র যা শ্বেতাঙ্গরা সর্বত্রই প্রয়োগ করে থাকে। আদিবাসীদের অস্তিত্বের লড়াই চিহ্নিত হয় সন্ত্রাসবাদ হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে আদিবাসীরা প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি জীবনধারায় অভ্যস্ত ছিল। ফলে তাদের সেই কূটবুদ্ধি, নৃশংসতা এবং মানববিধ্বংসী অস্ত্র ছিলোনা যা দিয়ে তারা শ্বেতাঙ্গদের মোকাবিলা করতে পারে। এখন যে আদিবাসীরা অবশিষ্ট আছে তাদের সম্মান দেখানোর নামে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো হয় কিন্তু তাদের দেশ পরিচালনার ব্যাপারে কোন অধিকার নেই, কার্যত এঁদের অধিকাংশই সহজলভ্য আয়ের দ্বারা অকর্মন্য এবং আত্মবিধ্বংসী জীবনযাপন করে নিজেদের তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।
এবার রকফেলার সেন্টার- ২২ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রকফেলার পরিবারের ১৯ টি বাণিজ্যিক ভবন। মধ্যবর্তী স্থানগুলোতে নানাপ্রকার বিনোদনের ব্যাবস্থা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, বাচ্চাদের চার্জ শেষের দিকে। আমিও টের পাচ্ছিলাম, আল্লাহ আমাকে নিউ ইয়র্কের দুর্গন্ধ থেকে মাফ করতে চলেছেন, পাঁচ বছর পর আমার সর্দি হতে চলেছে। আমার সর্দি যে কি ভয়াবহ বস্তু তা যে দেখেনি সে কল্পনাও করতে পারবেনা। আমাদের অবস্থা দেখে হাফিজ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন টাইমস স্কোয়ার আরেকদিন হবে। তখন আমরা চারপাশে সামান্য ঘুরাঘুরি করে রকফেলার স্কোয়ারের জি ই বিল্ডিংয়ের ছাদে গেলাম যেখান থেকে নিউ ইয়র্কের স্কাইলাইন দেখা যায়। আবার সেই ইট কাঠ লোহা পাথরের স্তুপ দেখলাম, এবার ওপর থেকে যেহেতু এই বিল্ডিং নিজেই নিউ ইয়র্কের দশম উচ্চতম ভবন। ছাদে থাকা অবস্থাতেই সূর্যাস্তের সময় হয়ে গেল। নেমে এলাম নামাজ পড়ার জন্য। এবার একটি বিশেষ দাওয়াতে যাব।
ক্যাল্গেরী থেকে আসার আগে দৃঢ়সংকল্প ছিলাম ঘুরাঘুরি করব, দাওয়াত নেবনা। কিন্তু আবুসামীহা ভাইয়ের সাথে পারিবারিকভাবে পরিচিত হবার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমরা তাঁর বাসার কাছাকাছি ট্রেন স্টেশনে পৌঁছতেই তিনি গাড়ী নিয়ে হাজির হলেন আমাদের নিয়ে যেতে। বাসায় ভাবী এবং বাচ্চাদের পাশাপাশি অপেক্ষমান ছিল তাঁর প্রতিবেশিনী, আমার প্রিয় ছাত্রী বর্ষা। মূহূর্তেই গল্প জমে উঠল আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের, যেন কতদিনের পরিচয়! ভাবী অনেক আগে থেকেই আমার ফেসবুকে বন্ধু হয়ে আছেন অথচ একবারও জানাননি যে তিনিই আমাদের গুণবতী ভাবী। বার বার মানা করা সত্ত্বেও তিনি টেবিল ভরে ফেললেন। সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে ক্ষুধার্ত থাকায় খেলামও খুব মজা করে। অন্যদিকে বর্ষার সাথে দেখা পাঁচবছর পর। আমার একটি ইশারায় সে দশ দিনের ভেতর স্বামীর সাথে অ্যামেরিকা চলে আসে যদিও এর আগে কেউ ওকে রাজী করতে পারেনি। এই বিশ্বাস আর ভালোবাসা কি কিছু দিয়ে পরিমাপ করা যায়? সে ওর ফুটফুটে সন্তান দু'টিকে দেখাল, ওর বর্তমান জীবনের কথা বর্ণনা করল এবং জানালো আমার সেদিনের সেই উপদেশ ওর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমার আট বছরের সহকর্মী সালমা আপা, যিনি ছিলেন আমার রুমমেট এবং আমার সকল কথা ও কাজের সাক্ষী, প্রায়ই আমাকে বলতেন, 'রেহনুমা, তুমি দুঃসাহসী। কৃতঘ্নতার এই যুগে মানুষ কাছের মানুষদেরও পরামর্শ দিতে ভয় পায়, আর তুমি কিনা ফ্রি ফ্রি উপদেশ বিলি কর!' ইচ্ছে হচ্ছিল সালমা আপাকে জানাই, পাঁচ বছর পর একজন আমাকে জানালো একটি পরামর্শ ওর জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে, সে সুখি হয়েছে, এই আনন্দটুকুর জন্যই তো মানুষ বেঁচে থাকে! কিছুক্ষণের মধ্যে অ্যাডভোকেট আব্দুল আজিজ ভাইও এসে উপস্থিত। তিনি খবর পেয়েছেন আমরা এই বাসায় দাওয়াত নিয়েছি সুতরাং আর ছাড়াছাড়ি নেই, তাঁর বাসায় যেতেই হবে। পরদিন আবুসামীহা ভাইয়ের কাজ, তবু তিনি আমাদের খালার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর। এদিকে বাচ্চারা কিছুতেই এই বাসা থেকে যেতে রাজী না। পাশাপাশি ঠিক বেরোবার সময় ভাবী কোথা থেকে 'এক গুচ্ছ গোলাপ' বইটি এনে বললেন, 'কিছু লিখে দিন'। ভীষণ লজ্জা পেলাম। আমি কি একটা মানুষ হলাম! তবু তাড়াহুড়া করে কিছু লিখলাম, জানিনা ভাবীর মন ভরাতে পারলাম কিনা। ভাবীকে 'বিয়ে' বইটির একটি কপি উপহার দিলাম। ভাবী পালটা এক বিশাল প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন, কিছুতেই না শুনবেন না! এঁরা ভারী ডেঞ্জারাস মানুষ, খাইয়ে দাইয়ে, উপহার দিয়ে আবার বাড়ী পৌঁছে দেন! আমাদের দিয়ে এসে বাড়ী ফিরতে আবুসামীহা ভাইয়ের প্রায় রাত বারোটা বেজে গেছিল। তবে একটি কথা না বললেই নয়। সৃষ্টিশীল উপহার দেয়া শিখতে চাইলে আবুসামীহা ভাই এবং ভাবীর কাছে ট্রেনিং নিতে হবে- তাঁদের প্রতিটি উপহার নির্বাচনে ছিল রুচি, চিন্তাশীলতা এবং বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়া; প্রতিটি উপহারই ছিল যার জন্য দেয়া তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। তবে সবচেয়ে হৃদয়ছোঁয়া ছিল তাঁদের আন্তরিকতা যার জন্য অবশ্যই আমরা সোনার বাংলাদেশ ব্লগের কাছে কৃতজ্ঞ।
বিষয়: বিবিধ
২৩৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন