ঘুরে এলাম নিউ ইয়র্ক - ১
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ০২ অক্টোবর, ২০১৩, ০৭:১৬:৪৫ সকাল
হাফিজ সাহেবের এক অত্যন্ত প্রিয় খালার বিয়ে হয় অ্যামেরিকা প্রবাসী পাত্রের সাথে। খালার বাড়ী, গাড়ী, ব্যাবসা সবই আছে কিন্তু কাগজপত্র সংক্রান্ত জটিলতার জন্য আর দেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই বিশ বছর খালার সাথে দেখা হয়নি ওনার। ক্যানাডা আসার পর থেকে খালার সাথে প্রায়ই কথা হয়। এবার সুযোগ করে খালার সাথে দেখা করতে গেলাম।
১৩ই সেপ্টেম্বর
বেলি আপা, যার কাছ থেকে আমাদের গাড়ী কেনা, আমাদের এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে গাড়ী নিয়ে চলে গিয়েছেন। এয়ারপোর্টে ঢোকার পর থেকে মেজাজটা ক্রমাগত খারাপ হতে রয়েছে। প্রথমেই নামে মুহাম্মাদ দেখে হাফিজ সাহেবকে আলাদা রুমে নিয়ে আটকে রাখা হোল আধাঘন্টা যেন সন্ত্রাসীরা প্লেন উড়িয়ে দেয়ার জন্য সন্তানসন্ততি নিয়ে প্লেনে ওঠে কিংবা নাম থেকে মুহাম্মাদ বাদ দেয়ার মত বুদ্ধি তাদের নেই। ওখান থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে সামনে এগিয়ে যেতে ওরা আমাদের পানির বোতল, জুস সব ফেলে দিল যেন এগুলো মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র। আমাদের পরনের সেফটি পিন, ব্রুচগুলোও ওদের ভীতির সঞ্চার করে। এরা টাকা ছাড়া একটা লাগেজও নিতে দেয়না আর ওদের দৃষ্টিতে পাসপোর্টবহনকারী কোমরের বেল্টটিও একটি স্বতন্ত্র ব্যাগ হিসেবে পরিগণিত হয়। জীবনে শতাধিকবার প্লেনে চড়েছি কিন্তু এমন সংকীর্ণ, বে-আরাম, বালিশ কম্বলবিহীন, অকেজো এসিওয়ালা প্লেন আর দেখিনি। প্লেনে কোন খাবার দেয়া হয়না, তবে কেউ চাইলে কিনে খেতে পারে, পানীয়ও বিক্রয়যোগ্য তবে সাদা পানি এবং কোকজাতীয় পানীয় চাইলে পাওয়া যায়।
পথে ট্রানজিট ছিল হিউস্টনে, এক ঘন্টারও কম, এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যেতেই শেষ। নইলে হিউস্টনে বসবাসরত আমার এক বান্ধবীকে আসতে বলতাম যার সাথে বিশ বছর দেখা হয়নি। এই অ্যামেরিকান মুসলিমা বাংলাদেশী বিয়ে করায় এক সময় চট্টগ্রামে থাকতেন, বিধবা হয়ে ফিরে এসে আবার বাংলাদেশী বিয়ে করেন। তিনি এত সুন্দর করে ইসলামকে বুঝেন এবং বোঝান যাতে জন্মগত মুসলিমরা নিজেদের মূর্খতায় লজ্জা পাবে।
প্লেন নিউ ইয়র্ক এসে নামতেই ঝাঁ করে একটা দুর্গন্ধ নাকে এসে ঢুকল। বুঝলাম ঘটনা খারাপ। আমি এমনিতেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাপ্রিয়, তার ওপর টানা পাঁচ বছর পৃথিবীর পরিচ্ছন্নতম নগরীতে বসবাস আমাকে শুচিবায়ুগ্রস্ততার দ্বারপ্রান্তে এনে দিয়েছে নিজের অজান্তেই। সমস্ত পুরোনো শহরগুলোর মতই এই শহরটিও ঘিঞ্জি, সংকীর্ণ রাস্তাঘাটযুক্ত, লোকে লোকারণ্য, আবর্জনা, শব্দদূষণ এবং অপরাধপ্রবনতার শিকার। দেশে থাকতে আমরা প্রায়ই কলকাতা বেড়াতে যেতাম। হাফিজ সাহেব বেশ কিছুদিন ধরেই কলকাতাকে মিস করছিলেন। ওনাকে বললাম, 'ওয়েলকাম টু কলকাতা'। নিউ ইয়র্ক আর কলকাতা কাছাকাছি সময়ে একই ঔপনিবেশিক প্রভুদের হাতে গড়া। আদতেই এই দুই শহরের মাঝে অনেক মিল। উভয় স্থানে একই স্থাপত্যকলার দেখা মেলে, একই লাল ইটের ব্যাবহার, একই সাইজের বাড়ীঘর, একই ধরনের দোকানপাট আর রাস্তায় একইরকম ট্রাফিক।
খালু যখন আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে নিতে এলেন তখন রাত বারোটা। হাফিজ সাহেবের সাথে খালুর এই প্রথম সাক্ষাত। কিন্তু প্রথমে দেখাতেই ওনার খালুকে ভাল লেগে গেল। খালা একটু পর পর ফোন করছেন আমরা কত দূর, কতক্ষণে পৌঁছাব। খালার বাসা নিউ ইয়র্কের বাইরে, লং আইল্যান্ডে। ওখান থেকে যেকোন জায়গাই ন্যূনতম এক ঘণ্টার দুরত্ব। আমরা যতক্ষনে গিয়ে পৌঁছলাম ততক্ষণে খালা অস্থির হয়ে ঘরের বাইরে চলে এসেছেন। খালা, খালু আর দুই বোন রুশা ও হৃদিতার সাথে এই আমাদের প্রথম দেখা হলেও কোন জড়তা ছিলোনা। আর ছিলেন খালার বৃদ্ধা শাশুড়ি যিনি ছিলেন 'আরজালিল উমুর' শব্দের বাস্তব প্রতিচ্ছবি, 'তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত পৌছানো হয়, যাতে সে জানার পর জ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে সজ্ঞান থাকে না' (সূরাহ হাজ্জ্বঃ আয়াত ৫)। তিনি এককালে দুর্দন্ড প্রতাপশালী মহিলা ছিলেন, যেভাবে স্বামীর সহায়সম্পত্তি সামলেছেন, একইভাবে বৌদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন অথচ এখন সামান্য ব্যাপারেও শিশুদের মত আচরন করেন। খুব আশ্চর্য লাগে যখন দেখি কেউ ক্ষমতা পেলে ভবিষ্যতের কথা ভাবেনা। অনেক শাশুড়ি বোঝেন না বৌয়ের প্রতি তাঁর আদর করার দায়িত্ব না থাকলে শাসন করার অধিকার জন্মায় কি করে? তিনি একটি মেয়েকে স্নেহ দিয়ে বৃদ্ধ বয়সে তার সেবাযত্নের অধিকার অর্জন করতে পারেন অথবা সাময়িক ক্ষমতার লোভে মত্ত হয়ে বৃদ্ধবয়সে তার দয়ার পাত্রী হতে পারেন। খালা তাঁর মাস্টার বেডরুম শাশুড়িকে ছেড়ে দিয়ে নীচতলায় থাকেন, শাশুড়ির তদারকে সদা যত্নবান, অনেক সময় শিশুদের মত আচরন করলে খাইয়েও দেন। রুশা আমাদের ওর রুম ছেড়ে দিয়ে দাদুর রুমে চলে গেল। রাদিয়া আর হৃদিতা সমবয়সী, ওরা দু'জন একসাথে থাকার সংকল্প করল।
খাবার ইচ্ছা না থাকলেও খালার অনুরোধে খেতে বসলাম। খাবার টেবিল দেখে আমি নিশ্চিত হলাম খালা পাগল হয়ে গিয়েছেন। বিশাল টেবিলের কোথাও এক ইঞ্চি জায়গা খালি নেই। আমরা খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম। বহুদিন পর দেখা হলে যা হয়, অনেকের কথা মনে পড়ে, অনেকের খোঁজখবর করা হয়। দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে গেল।
১৪ই সেপ্টেম্বর
রাতে অন্ধকারে ভালভাবে দেখা হয়নি। সকালে উঠে দেখলাম খালার বিশাল বাগান। এই এলাকায় সরকারের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি লটের ২০% জায়গা বাড়ীর, ৮০% জায়গা বাগানের। সামনের বাগানে পথের দু'পাশে গাছগুলো খালু সুন্দর শেপ করে কেটে রেখেছেন, খালা ফুলের বাগান করেছেন, ঝর্ণা, ইট দিয়ে ছোট্ট ঘের বানিয়ে জলজ উদ্ভিদ লাগিয়েছেন, ডানপাশে বিরাট বিরাট গাছ, একটা গাছের কান্ডের পুরোটাই লতায় ঢাকা। পেছনের বাগানে লাউ, কুমড়া, সীম, বরবটি, করলা, টমেটো, বেগুন, ক্যাপ্সিকাম, কাঁচামরিচ, ফলফলাদি। নিউ ইয়র্কের আবহাওয়া ক্যাল্গেরীর মত শীতল নয়, তাই ফলনে প্রাচুর্য দেখা যায়। তার ওপর খালাখালুর যত্নে বাগানটি এত সুন্দরভাবে বেড়ে উঠেছে যে পথচারীরা বাড়ী বয়ে প্রশংসা করে যায়।
হাফিজ সাহেব শখ করেছিলেন খালার হাতে মোগলাই পরোটা খাবেন। খালা দেখি সাত সকাল উঠে মোগলাই বানাচ্ছেন। দেশে থাকতে রান্নার সময় শাশুড়ি আম্মার সাথে বসে বসে গল্প করতাম। বহুদিন পর আবার রান্নাঘরে খালার সাথে বসে গল্প করলাম। খালা কথা বলেন খুব আদর করে। অন্যরা ঘুম থেক উঠার আগেই অনেক গল্প হোল খালার সাথে।
আমাদের কন্যারা ঘুম থেকে উঠেই জানাল ওরা কার্লোস বেকারী দেখতে যাবে। এখানে একটি জনপ্রিয় টিভি প্রোগ্রাম কেক বস। নিউ জার্সীর কার্লোস বেকারীর মালিক বাডি ভ্যালাস্ট্রো আর তাঁর পরিবার মিলে ছোট ছোট ফুলওয়ালা কেক থেকে ট্রেন, জাহাজ, চিড়িয়াখানার প্রতিকৃতি, এমনকি প্রমানসাইজের মটরসাইকেল, গাড়ী পর্যন্ত বানায় কেক দিয়ে যা দেখতে একেবারেই আসলের মত। এই বেকারীর প্রতিষ্ঠাতা কার্লোস ছিলেন বাডির বাবা। কার্লোসের ঐতিহ্য যাতে পরিবারের বাইরে না যায় সেজন্য এই দোকানের সমস্ত কর্মচারীই হোল পরিবারের সদস্য। লং আইল্যান্ড থেকে নিউ জার্সী যেতেই লাগে দুই ঘণ্টা। তাই আমরা ভাল করে খেয়েদেয়ে রওয়ানা হলাম। লম্বা সময় পর দোকানের সামনে পৌঁছে দেখি মানুষের লাইন দোকানের সামনে ফুটপাথ পেরিয়ে রাস্তার অপর পাড়ে ফুটপাথ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। দোকানে ঢোকা গেল প্রায় এক ঘন্টা পর। ছোট্ট দোকানটি মূলত সিটি হলের সামনে অবস্থিত হওয়ায় এবং টিভিতে প্রচার পাওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বাচ্চারা কিনল যা কিনতে চায়, অবশ্যই ভালভাবে উপকরণাদি চেক করে নেয়ার পর।
তবে সেদিনের প্রধান চমক, যার জন্য আমরা নিউ ইয়র্ক যাবার আগে থেকেই উদগ্রীব হয়ে বসে ছিলাম সবাই, তা ছিল নিউ ইয়র্কের বাইতুল মা'মুর মসজিদে একটি অনুষ্ঠান যেখানে প্রধান বক্তা ছিলেন শাইখ ইউসুফ এস্তেস। রাদিয়া বার বার বলছিল, 'আমি আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপসকে সামনাসামনি দেখেছি, এবার ইউসুফ এস্তেসকে দেখব, এর পর ডঃ জাকির নায়েককে দেখতে পারলে আমার জীবনের একটা বড় শখ পূরন হবে'। অনেক ট্রাফিক পেরিয়ে, অনেক উৎকন্ঠা নিয়ে মাগরিবের সময় বাইতুল মা'মুর মসজিদে পৌঁছলাম। কিন্তু তারপর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কিছু কিছু মহিলার আচরন দেখে এই আয়াতটি মনে পড়ে যাচ্ছিল, 'আর কাফেররা বলে, তোমরা এ কোরআন শ্রবণ করো না এবং এর আবৃত্তিতে হট্টগোল সৃষ্টি কর, যাতে তোমরা জয়ী হও' (সূরাহ ফুসসিলাতঃ আয়াত ২৬)। এঁরা উচ্চকন্ঠে কথা বলছিলেন, হাসাহাসি করছিলেন। ফলে না মসজিদের আদব রক্ষা হচ্ছিল, না তারা নিজেরা শুনছিলেন না কাউকে শোনার সুযোগ দিচ্ছিলেন। বাঙ্গালী স্বর্গে গেলেও মানুষ হবেনা! একটি প্রশ্নের জবাবে শাইখ এস্তেস বললেন, কিয়ামতের অনেকগুলো নিদর্শনের মাঝে বর্তমানে সবচেয়ে প্রকট দু'টি উদাহরণ হোল, পিতামাতা সন্তানদের দাসদাসীতে পরিণত হবে এবং যারা এক সময় রাখাল ছিল তারা অট্টালিকা নির্মানে পরস্পরের প্রতিযোগিতা করবে। কথার সত্যতায় শিউড়ে উঠলাম। শাইখ এস্তেসকে দেখলাম অনেক নরম হয়ে পড়েছেন তবু কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন পুরোদমে যেন মৃত্যুর পর তিনি এর ফায়দা লাভ করতে পারেন। বয়স আমাদের সবাইকে গ্রাস করছে কিন্তু আমরা কয়জন আখিরাতের ব্যাপারে এতটা সচেতন?
মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখা হোল ব্লগার আবুসামীহা সিরাজুল ইসলাম ভাইয়ের সাথে। আর ছিলেন হাফিজ সাহেবের বাল্যবন্ধু আলী হাসান ভাই। ঠিক হোল আমরা পরদিন আলী হাসান ভাইয়ের সাথে নিউ ইয়র্কের শহর এলাকা দেখতে বের হব।
বিষয়: বিবিধ
২৮০৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন