চাইনিজ বিড়ম্বনা
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ২৪ আগস্ট, ২০১৩, ০২:২৭:০৩ দুপুর
জীবনে কোনদিন এত উপকার পাইনি রোজা রেখে! রোজার উপকারীতায় মুগ্ধ হয়ে সেদিন আমি দশ ডলার সাদাকা দিলাম। আগামাথা কিছুই বুঝছেন না? তো শুনুন।
ঘটনাটা হোল, আমার এক সহকর্মী জিনুবিনের কন্যার জন্ম হোল আমার জন্মদিনে। আমাদের দেশে যার বাচ্চা হয় তার ওপর দিয়ে ছোটখাট একটা কিয়ামত যায়। হসপিটালের বিল, বৌয়ের চিকিৎসা, বাচ্চার জিনিসপত্র, আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশি সবাইকে খাওয়ানো – সব মিলে বেচারার নিঃসম্বল অবস্থা। জিনুবিনের হসপিটালের বিল, বৌয়ের চিকিৎসা সরকারের দায়িত্ব; বাচ্চার জিনিসপত্র কেনার পাশাপাশি বৌকে দেখাশোনা করার জন্য ছুটি দেয়ার দায়িত্ব কোম্পানীর; আর বাচ্চা হওয়া উপলক্ষ্যে ওকে খাওয়ানোর দায়িত্ব আমাদের, আবার সেটা খাওয়ানো হবে ওর পছন্দের রেস্টুরেন্টে। জিনুবিন চাইনিজ, তাই সে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট পছন্দ করল। আমাদের গ্রুপে জেইন, জিং, সিন্থিয়া আর জিনুবিন চাইনিজ; হ্যাভিয়ার মেক্সিকান হলেও আধা চাইনিজ যেহেতু সে চাইনিজ বিয়ে করেছে। বাইরের কেবল কেরী আর আমি। সুতরাং, ওর পছন্দে সবাই খুশি কেরী আর আমি ছাড়া। ক্যানাডায় এখন চাইনিজরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমি এবং কেরী ক্যানাডার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের প্রতিনিধিত্ব করছি। গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুদের কোন গুরুত্ব নেই, তাই আমি ইসলামে এবং কেরী স্বধর্মে সমাধান খুঁজল। সেই অনুযায়ী আমি দাওয়াতের দিন রোজা রাখলাম এবং কেরী ‘Love thy neighbour’ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে দাওয়াতে গেল।
আমি জানতাম আমরা যে মাঝে মধ্যে শখ করে স্যুপ, নুডলস কিংবা ফ্রাইড রাইস খাই তা মূলত চাইনিজ খাবারের ইন্ডিয়ানাইজড রূপ কিন্তু মেইনল্যান্ড চায়নার খাবার একেবারেই অন্যরকম। অধিকাংশ নর্থ অ্যামেরিকানদের মত কেরীও মনে করে পৃথিবীর শুরু এবং শেষ নর্থ অ্যামেরিকার সীমানার মাঝেই। তাই সে এই তথ্য জানতনা। সাড়ে এগারোটায় যখন জেইন এসে সবাইকে রেস্টুরেন্টে যাবার জন্য ডাকল তখন আমি প্রচন্ড ব্যাস্ততার ভান করে বললাম, ‘হাতের কাজটা শেষ করেই আমি রওয়ানা দেব, তোমরা চলে যাও’। জেইন কেরীকে নিয়ে চলে গেল।
আমি জানতাম চায়নাটাউন ডাউনটাউনেই কিন্তু কোনদিকে জানতাম না। সৌভাগ্যবশত জিং কাজে আটকা পড়েছিল, ওকে বললাম, ‘আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। চল, দু’জনে একসাথে যাই’। আমরা দু’জন বারোটায় অফিস থেকে বেরোলাম। রাস্তায় গিয়ে দেখি বাস পনেরো মিনিট লেট। ক্যাল্গেরীর ট্রেন সার্ভিস চমৎকার হলেও বাস সার্ভিস লক্কর ঝক্কর মার্কা, এর জন্য মনে মনে অত্যন্ত খুশি হলাম। চায়নাটাউনে বাস থেকে নামতেই একটা গন্ধ এসে ধাক্কা দিয়ে আমার বোঁচা নাকটা প্রায় বন্ধই করে দিল। জিং মনে কষ্ট পেতে পারে ভেবে নাক মোছার ভঙ্গিতে টিস্যূ দিয়ে নাক চেপে ধরলাম। রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই ফ্রেশ এক পশলা গন্ধে আমার পা দু’টো বুঝে পাচ্ছিলনা ভেতরে দৌড় দেব না বাইরে কারণ পেট জানান দিচ্ছিল যেকোন সময় বমি করে বিতিকিচ্ছিরি কান্ড ঘটাতে পারে। ভাগ্য ভাল ঘাড়ে আচ্ছা করে পারফিউম মেরে এসেছিলাম এই সম্ভাবনার কথা ভেবে, ঘাড়ে নাকমুখ গুঁজে চেরী ফুলের সুবাসে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বার বারই চেরীফুলের হাল্কা গন্ধ পরাজিত হচ্ছিল পঁচা মাংসের তীব্র গন্ধের কাছে। ভেতরে গিয়ে কেরীর বিশুষ্ক মুখখানা দেখে মায়া লাগল কিন্তু সবার সামনে সান্তনা দেয়ার মত কিছু বলতে পারলাম না। আমাদের দেরী দেখে ওরা অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। প্রায় পনেরোটা আইটেম। আমার কথা মাথায় রেখে শুকরের কোন আইটেম অর্ডার দেয়া হয়নি। এতদিনে ওদের আমি হালালের সংজ্ঞা এবং এতদসংশ্লিষ্ট কুর’আনের আয়াতগুলোও মুখস্ত করিয়ে ফেলেছি। সুতরাং, আমাকে দেখেই ওরা বলল, ‘তুমি মেন্যু দেখে যা খেতে পারবে তা অর্ডার দাও’। খুব মনোযোগ সহকারে মেন্যু দেখতে দেখতে মনে মনে শুকরিয়া করলাম রোজা রেখেছি। কেন তা একটু পরেই টের পাবেন।
আমি কিছু বলছিনা দেখে জেইন বলল, ‘তোমার জন্য কি দিতে বলব?’ হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গার এখনই উপযুক্ত সময়, বললাম, ‘আমি আজ রোজা রেখেছি’। রামাদান এক মাসে ওদের রোজার মাস’আলাসহ মুখস্থ করিয়ে ফেলেছি। সবাই জানে এর অর্থ আমি চা পর্যন্ত খেতে পারবনা, যদিও আমি চা এমনিতেই খাইনা। সবার সে কি আফসোস! কেউ কেউ বলল, ‘তাহলে তুমি এলে কেন? এখন তোমার সামনে আমরা সবাই খাব আর তুমি চেয়ে থাকবে?!’ আমি বললাম, ‘জিনুবিনের মেয়ের জন্ম আমার জন্মদিনে আর আমি আসবনা? আমি তোমাদের খাওয়া দেখে চাইনিজ খাওয়া শিখব’। তবে মেন্যু দেখে আমি জানি এই খাবার আমি কোনদিন খেতে পারবনা।
একটু পর খাবার আসতে শুরু করল। প্রথমেই এলো বেশনে কড়কড়া করে ভাজা অক্টোপাসের ঠ্যাং, মুরগীর ঠ্যাঙ্গের আঙ্গুলযুক্ত নীচের অংশ, দুইপ্রকার কঞ্জি – একটা কাঁকড়া দেয়া আরেকটা মুরগীর মাংস দেয়া – যেটাকে আমরা সোজা ভাষায় বলি জাউভাত। সবাই মহানন্দে অক্টোপাসের ঠ্যাং চিবাতে লাগল, কেরী বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে রইল, আমি ঘাড়ে মুখ গুঁজে চেরীফুলের সুবাসে খাবারের গন্ধ চাপা দেয়ার চেষ্টায় রত হলাম। একটু পর এলো ডালপালাসহ গোটা ডাঁটাশাকের গাছ সেদ্ধ, খুব আগ্রহ নিয়ে বসে রইলাম দেখব ওরা এটা কিভাবে চপস্টিক দিয়ে তোলে। জিং বেইজিংয়ের মেয়ে, কথাবার্তা আচার ব্যাবহারে বিশুদ্ধ। সে আমাকে যে দু’একটা চাইনিজ শব্দ শিখিয়েছে তার উচ্চারণ শুনেই চাইনিজরা বলে, ‘তোমার উচ্চারণ আমাদের চেয়েও ভাল’। সে চপস্টিক ব্যাবহার করা শিখেছে মটরদানা তোলার অভ্যাস করে। মানুষ চেষ্টা করলে কি’না পারে! কিন্তু এই গোটা গাছ ওরা কিভাবে খায় সেটা দেখার সুযোগ পেলাম না। সামনে একটা বাটি এলো, সাদা সাদা টুকরোগুলো দেখে সেদ্ধ করা পাস্তার মত মনে হোল, কিন্তু চাইনিজ রেস্টুরেন্টে পাস্তা আসবে কোত্থেকে? জেইনকে জিজ্ঞেস করলাম। সে জানাল এটা হোল গরুর ভুড়ি সেদ্ধ, শুধু লবন দিয়ে। কেরী তখনও কিছু খায়নি, এবার মনে হোল বমি করে দেবে, আমি আবার ঘাড়ে মুখ লুকালাম। এবার এলো দু’রকমের পিঠা জাতীয় জিনিস, খোলটা চালের গুঁড়ার তৈরী, একটার ভেতরে মুরগীর মাংস আরেকটার ভেতর কাঁকড়া। সবার চাপে পড়ে কেরী মুরগীর মাংস দেয়া একটা পিঠা খেলো – সেই প্রথম সেই শেষ। এবার এলো গরুর মাংসের লম্বা লম্বা ফালি, সেদ্ধ করে ওপরে কি যেন সস ছিটিয়ে দেয়া, ওরা চপস্টিক দিয়ে ধরে পুরো মাংসখন্ডটাকে আস্তে আস্তে ম্যাজিকের মত মুখে পুরে অদৃশ্য করে দিল, আমি আর কেরী মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে লাগলাম। একটু পর এলো বিরাট বাটিভর্তি নুডল স্যুপ, কাঁকড়ার কড়কড়া খোল আর আরো কি কি যেন দেয়া। আমার আর কেরীর মনে হোল এটা তো শুরুতে দেয়ার কথা ছিল সম্ভবত। এবার এলো একটা বড়া যেটা দেখে মনে হচ্ছিল এটা বায়োলজি ক্লাসে ডেমনস্ট্রেশনের জন্য বানানো, জিনিসটা এত বিশ্রী ছিল দেখতে যে কেউ এটা ছুঁলোই না। তারপর এলো দু’রকম মিষ্টি। একটার নাম এগ কাপ, আসলেই মনে হচ্ছে ময়দার খোলের ভেতর কাঁচা ডিমের হলুদ অংশ। আরেকটা জেলাটিনের ভেতর দারচিনির ফুল দেয়া। এই পিচ্ছিল বস্তুটি জিং যেভাবে চপস্টিক দিয়ে নিখুঁতভাবে কেটে চার টুকরো করল, অতঃপর অন্যদের মত গেঁথে না নিয়ে বরং চপস্টিক দিয়ে ধরে খেল তাতে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। হ্যাভিয়ার একই কাজ করার চেষ্টা করতে গিয়ে কাটতে সক্ষম হোল কিন্তু না গেঁথে খেতে পারলনা। তবে আসল শো শুরু হোল এর পর। সবার খাওয়া শেষ, অথচ খাবার বেশ কিছু বাকী রয়ে গিয়েছে। হ্যাভিয়ার এক এক করে সব প্লেটের তলানী পরিস্কার করতে শুরু করল। ওর খাওয়ার পরিমাণ দেখে আমরা সবাই কোন হলিউড মুভির দর্শকের চাইতেও বেশি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। শেষ পর্যন্ত সে প্রায় সব শেষ করে ফেলল। একটা পিঠা আর দু’তিন চামচ কঞ্জি বাকী ছিল, সেটা সে ওর স্ত্রীর জন্য প্যাক করে নিল। আধা বোল স্যূপ ছিল, জিনুবিন নিয়ে নিল। এই অদ্ভুত এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার পর আমরা ফিরে চললাম অফিসে।
অফিসে এসে সবাই বলল আমার টাকা দেয়ার প্রয়োজন নেই যেহেতু আমি কিছু খাইনি। আমি মনে মনে ভাবলাম, ‘টাকা দিয়ে মানুষ এত বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারেনা’। বললাম, ‘আমি জিনুবিনের কন্যার জন্ম উপলক্ষ্যে এই টাকা শেয়ার করতে চাই’। হ্যাভিয়ার বলল, ‘রেহনুমার অংশের টাকাটা আমি দিতে চাই যেহেতু ওর অংশের খাবারটুকু আমি খেয়েছি’। আমি বললাম, ‘তুমি নাহয় পরের বার দিয়ো, এবার আমার পালা’। আসল কথা হোল এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমাকে খেয়ে সঞ্চয় করতে হয়নি এই খুশিতেই আমি দশ টাকা সাদাকা দিলাম।
পরের সপ্তাহে একদিন আমি আর কেরী হাঁটতে বের হয়েছি। কেরী বলল, ‘তুমিই বুদ্ধির কাজ করেছ, রোজা রেখেছ। সেদিন আমার যে কি কষ্ট হয়েছে আমি বলে বোঝাতে পারবনা। অনুরোধে ঢেঁকি গিলে আমি একটি পিঠা খেয়েছিলাম বটে, কিন্তু এরপর পুরো সপ্তাহ আমি অসুস্থ ছিলাম’।
আমার এক চাইনিজ বান্ধবী জেনী একবার অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আমাকে ফোন করল, ‘আমি এখন বুঝতে পারলাম তোমরা কেন হালাল খাও’। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘বল তো কেন?!’ সে বলল, ‘আমি এক চাইনিই বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেতে গেলাম। সে যেন অমৃত খাওয়ালো। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই মাংস কোথা থেকে কিনেছ?’ তখন ওরা জানাল ওরা একবার হালাল মাংসের দোকান থেকে মাংস খেয়ে এমনভাবে প্রেমে পড়ে গিয়েছে যে এখন আর অন্য কিছু খেয়ে মজা পায়না। আসলেই মাংসের স্বাদ যেন এখনো আমার মুখে লেগে রয়েছে!’
জিং আমার কাছে শুনে, কুর’আনের আয়াত পড়ে হালাল মাংস কিনে খেল ক’দিন আগে। তারপর বলল, ‘জীবনে এই প্রথম মাংস খেয়েও আমার পেট খারাপ হোলনা। মাংসটাও ভীষণ মজা আর দেখতেও ভারী সুন্দর, এর গন্ধটাও চমৎকার’।
সব শুনে এই উপসংহারে পৌঁছলাম, এই পৃথিবীর সকল নেয়ামত আল্লাহ আমাদের সেবার জন্য সৃষ্টি করেছেন, তাহলে আমাদের কিছু খেতে নিষেধ করার পেছনে তাঁর কি স্বার্থ থাকতে পারে? বরং তিনি চেয়েছেন রোগব্যাধি থেকে আমাদের নিরাপদ রাখতে, তাঁর সৃষ্টির সর্বোত্তম অংশটি আমাদের উপহার দিতে। তবু যদি আমরা হাঁড়ির ভেতরের মজাদার খাবার ফেলে হাঁড়ির নীচের কালিটাকেই উপাদেয় মনে করি সেক্ষেত্রে তিনি আমাদের জন্য দুঃখবোধ করা ছাড়া আর কি করতে পারেন?! আসলে আমরা না চাইতেই পেয়েছি বলে কি পেয়েছি বুঝিনা, যারা পায়নি তারা তাঁর নেয়ামতের স্পর্শমাত্র পেলেও মুগ্ধ হয়ে যায়!
(হাস্যরসাত্মকভাবে লেখা এই পোস্টটিকে কেউ কেউ অন্য জাতির প্রতি অসহিষ্ণুতার বঃহিপ্রকাশ মনে করতে পারেন। তবে সত্যি কথা হোল এরা সবাই আমার বন্ধু। আমার চাকরী পাবার পেছনে জেনী এবং জেইনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা রয়েছে। জেনী যদি আমার পেছনে বছরের পর বছর লেগে না থাকত আমার ঘর থেকে বেরোনো হতনা। আমার চাকরী কনফার্ম করার জন্য জেইন ঘর সংসার সন্তান ফেলে চারদিন রেইনবো লেকে গিয়ে পড়ে ছিল। বেচারীরা আমাকে নানারকম খাবার রান্না করে খাওয়াতে চায় কিন্তু ওদের খুব কম খাবারই আমি খেতে পারি হালাল হারামের পার্থক্যগত কারণে। তাই ওদের কাছে হালাল মাংসের গুণকীর্তন আমার কাছে এই সত্যের কনফার্মেশন যে আমরাই সঠিক অবস্থানে রয়েছি।)
বিষয়: বিবিধ
৫৪২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন