একটি উত্তম বৃক্ষ
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ০৪ জুলাই, ২০১৩, ০১:১৬:৩৯ দুপুর
ছাত্রজীবনে ভাল তার্কিক ছিলাম, চ্যাম্পিয়ন হয়েছি কয়েকবারই। তবে বাস্তবজীবনে আমি একজন উত্তম শ্রোতা, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মৌন থাকতেই ভালবাসি। ঝগড়ার অভ্যাস নেই, যারা বকতে চায় তাদের ইচ্ছেমত বকতে দেই, উত্তর না পেয়ে একসময় তারা নিজেরাই চুপ হয়ে যায়। শুধুমাত্র ভদ্রতা বজায় রাখা এবং অন্যের প্রয়োজনে সাড়া দেয়া ব্যাতীত কথা বলে সময় নষ্ট করার চেয়ে কিছু পড়া বা কোন গঠনমূলক কাজ করায় সময় দেয়াটাই শ্রেয় মনে হয়। সেই নবম শ্রেনীতে কঠোর সংকল্প করেছিলাম কথা বলা কমিয়ে দেব। দীর্ঘ সময় সাধনা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে এই পর্যায়ে এসে হাতেগোণা কিছু মানুষ ছাড়া সবার সাথেই আমি খুব ভেবেচিন্তে, মেপেঝুঁকে, যুক্তি দিয়ে কথা বলি। তারপরও যারা তর্ক করতে চায় তাদের ক্ষেত্রে ইমাম গাজ্জালীর পদ্ধতি অনুসরন করার চেষ্টা করি। তাঁর শব্দগুলো হুবহু মনে নেই তবে কথাগুলো ছিল মোটামুটি এরকম, ‘কেউ যদি আমাকে জানার জন্য প্রশ্ন করে তবে আমি তাদের সাধ্যমত উত্তর দেই; কেউ যদি তর্ক করার উদ্দেশ্যে আমাকে কিছু বলে আমি তাকে বলি ‘সালাম’ এবং অতঃপর তার কথার কোন উত্তর দেইনা; কোন পাগল যদি আমাকে কোন প্রশ্ন করে আমি তাকে কোন উত্তর দেইনা যেহেতু তার বোঝার ক্ষমতা নেই; কোন মূর্খ ব্যাক্তি আমাকে কোন প্রশ্ন করলে আমি তাকেও কোন জবাব দেইনা কারণ ঈসা (আ) অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন কিন্তু কোন মূর্খ ব্যাক্তিকে জ্ঞানী বানাতে পারেননি’।
খুব অবাক হই যখন দেখি মানুষ তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বিতর্ক করে সময়, মেধা এবং শ্রম নষ্ট করে; কাউকে দু’কথা শুনিয়ে দিয়ে তৃপ্তিলাভ করার উদ্দেশ্যে নিজের মুখ এবং অন্যের চরিত্রের পবিত্রতা নষ্ট করে; নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে ঠিক এবং অপরের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভুল প্রমাণ করার জন্য সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করতেও পিছপা হয়না। আমার এক অতি জ্ঞানী মামা একবার আমার বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ের আনন্দে পানি ঢেলে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘বিতর্ক একটা বাজে জিনিস। তুমিই বল, বিতর্কে কে জেতে? যে সত্য বলল সে না যে যুক্তিতর্ক দিয়ে মিথ্যাটাকেও সত্য প্রমাণ করতে পারল সে?’ সেদিন থেকেই বিতর্ক বাদ দিলাম। উকিল হবার শখ ছিল Paper Chase আর L.A. Law তে তুখোর সব উকিলদের অকাট্য সব যুক্তি দেয়া দেখে, সেই ইচ্ছাও বাদ দিলাম। জীবনে একটি কাজ করতে কখনো পিছিয়ে যাইনি তা সে যতই কঠিন হোক না কেন, তা হোল সত্যকে গ্রহণ করা। মতের অমিল সত্ত্বেও অন্যের ভালোটুকু গ্রহণ করতে পারলে লাভ আমারই, আর ভাল সবার মাঝেই আছে, এমনকি শয়তানের মাঝেও শিক্ষণীয় অনেক গুন আছে- সে অন্যকে পথভ্রষ্ট করলেও নিজে একজন উত্তম ইবাদাতকারী, সে তার সৃষ্টিকর্তাকে উত্তমরূপে জানে এবং তার অধ্যাবসায় অতুলনীয়, সে কখনোই হাল ছেড়ে দেয়না।
একবার আই আই ইউ সি অফিসে বসে আছি, একটা ফোন এলো, রঙ নাম্বার, কিন্তু লোকটা ইংরেজীতে ক’খানা অশ্রাব্য শব্দ উচ্চারণ করে নিজের পরিচয় উপস্থাপন করল, তারপর লাইন কেটে দিল। ফাহমিদা শুনে বলল, ‘আপনি হলেন ইংরেজীর মাস্টার, সে দু’টো কথা শোনালে আপনি তাকে পনেরো মিনিট লেকচার শোনাতে পারতেন। অথচ আপনি কিছুই বললেন না?!’ বেচারী আমাকে বড় ভালোবাসে তাই এটুকুও ওর সহ্য হোলনা। কিন্তু আমি তাকে বোঝালাম, ‘বললে কি হত বল? আমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করা হত, ব্যাপারটা নিয়ে একটু অহংকারের প্রকাশ ঘটত, ওর দু’টো গুনাহর বদলে আমি পনেরোটা গুনাহ সঞ্চয় করতাম। এই তো? কিন্তু আমি ওর সাথে পনেরো মিনিট নষ্ট করার পরিবর্তে দশ মিনিটে কুর’আনের দু’টো পৃষ্ঠার অনুবাদ পড়লাম, তারপর পাঁচ মিনিটে তোমাকে এর সারাংশ শোনালাম। কোনটাতে লাভ বেশি হোল বল দেখি?’ ফাহমিদা একা নয়, চুপ করে থাকি বলে অনেকেই আমাকে বোকা ভাবে, ‘এ’ কেমন প্রানী, চোখের সামনে লোকে বলে যায় অথচ সে একটা টুঁ শব্দ করেনা?’ কিন্তু দেখুন আল্লাহ কি বলছেন, ‘রহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মুর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, ‘সালাম’ (সূরা ফুরক্কানঃ আয়াত ৬৩)। একজন বিশ্বাসীর মাঝে কাঙ্খিত গুনাবলীর একটি হোল, তারা ‘অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত’ (সূরা মুমিনূনঃ আয়াত ৩) এবং ‘যখন তারা কোন বাজে কাজ কিংবা অসাড় কথাবার্তার নিকটবর্তী হয় তখন তারা এতে যোগ না দিয়ে সম্মানের সাথে চলে যায়’ (সূরা ফুরক্কানঃ আয়াত ৭২)।
‘পরম করুণাময় আল্লাহ, যিনি কুর’আন শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন’ (সূরা রাহমানঃ আয়াত ১-৪)। সেই ভাষার উদ্দেশ্য তিনি উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মত। তার শিকড় মজবুত এবং শাখাপ্রশাখা আকাশে উত্থিত। সে পালনকর্তার নির্দেশে অহরহ ফল দান করে। আল্লাহ মানুষের জন্যে দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন-যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। এবং নোংরা বাক্যের উদাহরণ হলো নোংরা বৃক্ষ। একে মাটির উপর থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। এর কোন স্থিতি নেই’ (সূরা ইবরাহীমঃ আয়াত ২৪-২৬)। সুতরাং, ভাষার উদ্দেশ্য হোল এর মাধ্যমে উত্তম ফললাভ করা, যে কথার উদ্দেশ্য বিধেয় ঠিক নেই সে কথা থেকে কোন ফল আশা করা যায়না, এমনকি আল্লাহ বলছেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম অবয়বে, অতঃপর তাকে পৌঁছে দিয়েছি নিকৃষ্টতম পর্যায়ে’ (সূরা ত্বীনঃ আয়াত ৪-৫)। সেই পর্যায়ে পৌঁছনোর জন্য কথাও একটি মাধ্যমে বটে!
ফলের কথায় জান্নাতের প্রসঙ্গ মনে এলো। এর বর্ণনায় বিবিধপ্রকার খাবার, পোশাক, বাড়ীঘর এবং সম্পদের চাকচিক্যের কথা এসেছে। স্বভাবজাতভাবে আমি অত্যন্ত নীরস প্রকৃতির, খাবার দাবাড় এবং চাকচিক্যময় বস্তুসমূহের প্রতি আমার আকর্ষন কম। তাছাড়া নিজের কর্মকান্ডে আমি নরকে না যাওয়া নিয়ে এতটা চিন্তিত যে স্বর্গে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ বিশেষ একটা হয়ে ওঠেনা। তাই জান্নাতের বর্ণনাসম্বলিত আয়াতগুলো পড়ে যতটা না উজ্জীবিত হই তার চেয়েও বেশি হতাশ হই যে এখানে আমি কিছুতেই প্রবেশাধিকার পাবোনা। তবে আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি সূরা হোল সূরা গাশিয়াহ, এই সূরার দু’টো আয়াত আমাকে বেহেস্তে যাবার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। আমি অত্যন্ত আরামপ্রিয়। তাই যতবারই পড়ি, ‘সেখানে সারি সারি বালিশ সাজানো থাকবে’ (আয়াত ১৫), নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে যায়, স্বর্গীয় বালিশের সারির প্রতি প্রলুব্ধ হই। অপর যে বিষয়টি আমাকে স্বর্গীয় উদ্যানসমূহের প্রতি আকর্ষন করে তা হোল, ‘সেখানে তারা কোন অসাড় কথাবার্তা শুনবেনা’ (আয়াত ১১)। চুপ করে থাকি তার অর্থ তো আর এই নয় যে মানুষের কথায় কষ্ট পাইনা! সৃষ্টিকর্তা যে মুখখানা দিয়েছেন অপরের প্রয়োজনে সাড়া দিতে, দু’টো মায়াভরা কথা বলে সমবেদনা জানাতে, ক’টা বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শের মাধ্যমে অন্যের সমস্যার সমাধান দিতে সে মুখখানা দিয়ে মানুষ কি ভয়ানক সব অস্ত্র ছুঁড়ে মারে, কি অশ্লীল সব শব্দাবলী উচ্চারণ করে, কি নির্লিপ্তভাবে অন্যের হৃদয়ে মারিয়ানার গহ্বর সৃষ্টি করে দিয়ে অহংবোধ করে! হৃদয় তো ভারাক্রান্ত হবেই। তখনই ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় সেই উদ্যানে যেখানে ‘তাদের সম্ভাষন হবে ‘সালাম’ (সূরা ইবরাহীমঃ আয়াত ২৩)। কতইনা সুন্দর সে সম্ভাষন! অথচ তারা বোঝেনা, আজ যারা ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে অন্যের মনে কষ্ট দিচ্ছে তাদের নিক্ষেপ করা হবে এমন এক প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতে, ‘যা তাদের হৃদয় পর্যন্ত পৌছবে’ (সুরা হুমাযাহঃ আয়াত ৭), শুধু শরীর দাহ করে ক্ষান্ত হবেনা।
আল্লাহ বলেন, ‘ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা’আলা দয়া করবেন’ (সূরা তাওবাহঃ আয়াত ৭১)। রাসূল (সা), যিনি ছিলেন কুর’আনের বাস্তব প্রতিবিম্ব, তাঁকে আমরা দেখি তিনি ছিলেন মিতবাক, হাসিমুখে কথা বলতেন, অতিরিক্ত জোরেও কথা বলতেন না আবার অতিরিক্ত নীচুস্বরেও নয়, প্রয়োজনীয় কথা সর্বোচ্চ তিনবার বলতেন, রেগে গেলেও কথাবার্তায় মাত্রা ছাড়িয়ে যেতেন না, মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র আচরন করতেন, অন্যায়কারীর প্রতি ছিলেন ক্ষমাশীল, উপদেশদানে অগ্রগামী। তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে সকল পরিস্থিতিতে ভাল কথা বলতে হয়, ভাল আচরন করতে হয়। কিন্তু আমরা, তার অনুসারীরা, তাঁকে কতটুকু অনুসরন করি?
রাসূল (সা) বলেছেন, যদি আমরা জানতে পারি আগামীকাল কিয়ামত হবে তবু যেন আমরা ভাল কাজ করা বন্ধ না করি, এমনকি যদি তা হয় একটি চারাগাছ লাগানো, যদিও আগামীকালের কিয়ামতে তা নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু আমার উত্তম নিয়াতটি আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত থাকবে, হয়ত এই চারাগাছটিই আমাকে বাঁচাবে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি থেকে! তাই প্রতিদিন এখানে সেখানে ছোট ছোট চারাগাছ লাগাই- ট্রেনে দশ মিনিটের জন্য পরিচয় হওয়া মেয়েটির মনে, অফিসের লিফটে এক মিনিটের সাহচর্য পাওয়া মহিলাটির মানসে, খাবার দোকানের দোকানীটির মাথায়, বন্ধুদের আসরে, পথচলতি পথিকের হৃদয়ে- হয়ত একদিন এই চারাগাছগুলো ডালপালা মেলে দাঁড়াবে, হয়ত একদিন এদের শাখাপ্রশাখায় পাখীরা আশ্রয় খুঁজে নেবে, হয়ত একদিন এর বীজগুলো ছড়িয়ে পড়বে আরো হাজারো হৃদয়ে, আবার হয়ত কিছুই জন্মাবেনা এগুলো থেকে, মুকুলেই ঝরে যাবে সব। কিন্তু হয়ত আমার প্রতিপালক আমার প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট হয়ে বলবেন, ‘যাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম!’ সেদিনের আশায় চলুন আমরা সবাই উত্তম বৃক্ষসমূহের চারাগাছ বুনি। হয়ত আমারটি প্রস্ফুটিত হবেনা, হয়ত আপনারটি হবে। তখন নাহয় উত্তম পরামর্শের বাহানায় সেখানে আমিও কিছু ভাগ বসাব!
বিষয়: বিবিধ
৩২৪২ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"তাই প্রতিদিন এখানে সেখানে ছোট ছোট চারাগাছ লাগাই- ট্রেনে দশ মিনিটের জন্য পরিচয় হওয়া মেয়েটির মনে, অফিসের লিফটে এক মিনিটের সাহচর্য পাওয়া মহিলাটির মানসে, খাবার দোকানের দোকানীটির মাথায়, বন্ধুদের আসরে, পথচলতি পথিকের হৃদয়ে- হয়ত একদিন এই চারাগাছগুলো ডালপালা মেলে দাঁড়াবে, হয়ত একদিন এদের শাখাপ্রশাখায় পাখীরা আশ্রয় খুঁজে নেবে, হয়ত একদিন এর বীজগুলো ছড়িয়ে পড়বে আরো হাজারো হৃদয়ে, আবার হয়ত কিছুই জন্মাবেনা এগুলো থেকে, মুকুলেই ঝরে যাবে সব। কিন্তু হয়ত আমার প্রতিপালক আমার প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট হয়ে বলবেন, ‘যাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম!’ সেদিনের আশায় চলুন আমরা সবাই উত্তম বৃক্ষসমূহের চারাগাছ বুনি। হয়ত আমারটি প্রস্ফুটিত হবেনা, হয়ত আপনারটি হবে। তখন নাহয় উত্তম পরামর্শের বাহানায় সেখানে আমিও কিছু ভাগ বসাব!"
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন