অনুগ্রহ

লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ২৫ মে, ২০১৩, ০৩:০৭:১২ দুপুর

১/

চাকরী পেয়েছি শুনে এক বান্ধবী ফোন করলেন, ‘ভালোই তো, মানুষ ক্যানাডায় এসে ডিগ্রীর পর ডিগ্রী, কোর্সের পর কোর্স করেও চাকরী পায়না। আর আপনি কিচ্ছু না করে, এমনকি চেষ্টাও না করে একের পর এক ক্যানাডার সেরা কোম্পানীগুলোতে কাজ করে চলেছেন!’ ভেবে দেখলাম কথাটা আসলেই ঠিক। আহামরি কোন যোগ্যতা নেই, উচ্চাভিলাষ এবং অধ্যাবসায় উভয়ের অভাব, অথচ কিভাবে কিভাবে যেন রেজুমিটার ওজন বাড়তেই রয়েছে!

ক্যানাডায় এসে CRTP নামে একটা কোর্স করেছিলাম। এই কোর্সের মাধ্যমে তারা নিজের দেশে উচ্চপদে কাজ করে আসা অভিবাসীদের এখানকার কর্মক্ষেত্রে পুণর্বাসিত হবার যোগ্য করে গড়ে তোলে। সে সূত্রে নানান দেশের বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবের পাশাপাশি একটি বৃহৎ গ্যাস কোম্পানীতে অ্যাডমিন হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা জুটে যায়। তারপর কিছুদিন ঘাপটি মেরে বসে থাকি বাসায়। আচানক একদিন চাইনিজ বান্ধবী জেনী (ওর চাইনিজ নাম ফ্যাং মে, ওরা বিদেশে আসার আগে নিজেই নিজের একটি ইংরেজী নামকরন করে নেয়) ফোন করে জানায় সে যে বিখ্যাত অয়েল কোম্পানীতে কাজ করে সেখানে একটি পজিশনের জন্য সে তার বসকে আমার কথা বলেছে। বস আমাকে বাসা থেকে ডেকে ইন্টারভিউ নিয়ে চাকরী দিয়ে দেন। মসজিদের পাশে অফিস- কাজ করি, খাই দাই, ঘুরি ফিরি আর মসজিদে নামাজ পড়ি।

তারপর চাকরী ছেড়ে দিয়ে CELTA কোর্স করলাম দেশে ফিরে যাব বলে। কিন্তু কপালে না থাকলে কি আর যাওয়া যায়? সমস্ত সংসার বাক্সে ভরে চলল এক বছর। তারপর একদিন আবার বাক্সপ্যাটরা খুলতে শুরু করলাম। এ’সময় আমার প্রভু সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘চল তোকে এবার পৃথিবীর সেরা দশটি কোম্পানীর একটিতে কাজ করিয়ে দেই, দেখি তুই কি করিস!’ কি আর করব? চাকরীতে গিয়ে প্রথমেই তাঁর সামনে মাথা নত করার একটা জায়গা খুঁজে বের করলাম। পৃথিবীব্যাপী মুসলিমদের এক বিশাল সম্পদ সালাম। একটি ‘আসসালামু আলাইকুম’ সম্ভাষন সাদা কালো, এশিয়ান আফ্রিকান ইউরোপিয়ান, বস ক্লিনার সব পার্থক্য নিমিষেই ঘুচিয়ে দিয়ে দু’জন সম্পূর্ন অপরিচিত ব্যাক্তির মাঝে গড়ে তোলে হৃদয়ের বন্ধন অথচ দু’জন একে অপরের নামও জানেনা! এভাবেই বন্ধুত্ব হয় সোমালিয়ার আয়শার সাথে। আয়শার মাধ্যমে পরিচয় হয় নোমাইর ভাইয়ের সাথে। আল্লাহ মিশরীয়দের রহমত করুন। নোমাইর ভাই কোম্পানীর সাথে আলাপসাপেক্ষে একটি রুম স্থায়ীভাবে নামাজের জন্য বুক করে রেখেছেন যেখানে কাবার্ডের ভেতর সারি সারি জায়নামাজ!

ওখানে যেদিন কন্ট্র্যাক্ট শেষ হোল সেদিনই খবর পেলাম আগে যে অয়েল কোম্পানীতে কাজ করতাম সেখানে আবার চাকরী হয়ে গিয়েছে। জেনীর চাপে পড়ে ইন্টারভিউ দিলেও ভরসা ছিলোনা চাকরী হবে কারণ এবারের কাজটা ক্যাল্গেরী অফিসে বসলেও ক্যাল্গেরীর নয়, রেইনবো লেকের। যে দু’জন তাদের পছন্দের তালিকায় ছিল তার মধ্যে আমি ছাড়া অন্যজন রেইনবো লেকে কাজ করেছে তিনবছর। কিন্তু আরেক চাইনিজ বান্ধবী জেইন (ইয়ান জিং) অসাধ্য সাধন করল। ইন্টারভিউর পর পর সে রেইনবো লেকে চলে গেল এবং ওখানকার বস জো’র কাছে আমার যোগ্যতা নিয়ে সত্যমিথ্যা কি বলেছে আমি জানিনা কিন্তু সকল সম্ভাবনার উর্ধ্বে আমার চাকরী হয়ে গেল! আজ মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, মানুষের এই ভালোবাসা পাবার কোন যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও আমার করুণাময় প্রভু আমার চলার পথকে কতই না প্রশস্ত করে দিয়েছেন! অতঃপর আমি আমার প্রভুর কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করব?

২/

ক’দিন আগেই বাসা বদলেছি, এক বছরের লীজ। কিন্তু বাড়ীওয়ালা বেঈমানী করে কোন কথাবার্তা আলাপ না করে বাড়ী বিক্রি করে দিল। আমরা পড়ে গেলাম বিশাল সমস্যায়। ক্যাল্গেরীতে ইদানিংকালে অভিবাসীসহ অন্যান্য এলাকা থেকে চাকরীপ্রত্যাশী এত লোক এসেছে যে এক একটি বাড়ীর জন্য পঁচিশ থেকে একশ আবেদনপত্র জমা পড়ছে, বাড়ীওয়ালারা বিরক্ত হয়ে ফোনই উঠাতে চায়না, উঠালে বলে বাড়ী ভাড়া হয়ে গিয়েছে। দুইমাস ধরে হন্যে হয়ে বাড়ী খোঁজার পর একদিন এক ভাই অনুমতি চাইলেন একটি মুসলিম ওয়েবসাইটে অ্যাড দিতে যে একটি মুসলিম পরিবারের বাসস্থান প্রয়োজন। পরদিন এক লোক ফোন করলেন তাঁর বাড়ীটি দেখতে যাবার জন্য। গিয়ে দেখি এলাকাটি যেমন সুন্দর, বাড়ীটিও তেমনি। বিশাল বাড়ী, ঘাসবিছানো এবং পাকা করা বিরাট আঙ্গিনা, গাছপালা, সর্বত্র যত্নের ছাপ। ভদ্রলোক লেবানিজ, ডাউনটাউনে বিরাট ব্যাবসা। স্ত্রীটিও চমৎকার। ছয় ছয়টি সন্তান একহাতে সামলান, বিশাল ভ্যানে করে বাচ্চাদের আনানেয়া করেন, বাচ্চাদের বয়স আড়াই থেকে এগারো বছরের মধ্যে। সম্পূর্ন পর্দানশীন এই মহিলা কিভাবে ছয় ছয়টি সন্তান সামলে এত বিশাল ঘর এত টিপটপ রাখেন এবং নিজে এত ফিটফাট থাকেন আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বাচ্চাগুলো যেমন সভ্যভদ্র তেমনি ঘরটিও বাড়ী খোঁজার প্রচেষ্টায় আমাদের দেখা দুই শতাধিক ঘরের মধ্যে সবচেয়ে পরিস্কার, কোথাও কোন দাগ নেই, গন্ধ নেই, ঝকঝকে তকতকে। কিন্তু এই বাড়ীর ভাড়া আমাদের নাগালের অনেক বাইরে। তাছাড়া আমরা মানুষ মাত্র চারজন। চার বেডরুম, আড়াই বাথরুম, তিনটি ড্রয়িং রুম এবং তিনশ লোকের বসার মত আঙ্গিনা নিয়ে আমরা কি করব বা তা পরিষ্কার রাখব কিভাবে? আমাদের অপারগতার কথা জানিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভদ্রলোক নাছোরবান্দা। তিনি ভাড়া কমাতে কমাতে অর্ধেকে চলে এলেন। আমরা খুব আশ্চর্য হলাম। একদিকে আমরা কুকুরের বিষ্ঠা ভরা বাড়ীর বাড়ীওয়ালাদের দেমাগে বাঁচিনা আর ইনি কিনা আমাদের ধরে বেঁধে তাঁর বাড়ীতে রাখতে চান। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঘটনা কি?’ তিনি জানালেন সন্তানদের ইসলামের ওপর গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যাবসাপাতি বাড়ীঘর রেখে লেবানন চলে যাচ্ছেন। তিনি চান না তাঁর ঘরে কুকুর বিড়াল বা গার্লফ্রেন্ডওয়ালা কিংবা নাস্তিক কেউ থাকুক তা সে যতই ভাড়া দিক। তিনি চান এই ঘরে তাঁর অনুপস্থিতিতেও নামাজ পড়া, ইসলামের চর্চা অব্যাহত থাকুক। এর পরে আর কি বলা যায়? তিনিও কমালেন যতটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হোল, আমরাও বাড়ালাম যতটা আমাদের সামর্থ্য। বাড়ীটাও পাওয়া যাবে ঠিক সেদিনই যেদিন আমাদের বর্তমান বাড়ীতে থাকার শেষ সময়সীমা। কি জানি, হয়ত আমার প্রভু চান আমরা কিছুদিন শান শওকতে থাকি! অতঃপর আমি আমার প্রভুর কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করব?

৩/

অফিসে সেলফোন বাজছে দেখে দৌড়ে গিয়ে ধরলাম। ডেন্টিস্টের অফিস থেকে ফোন। জানাতে ফোন করেছে মঙ্গলবার ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। বললাম সেদিন কাজ আছে, সুতরাং তারিখ পরিবর্তন করতে হবে। সে আমাকে তারিখ পরিবর্তন করে পরের মাসের এক শনিবার সকাল ন’টায় সময় দিল। কিন্তু আমরা উভয়েই শুনতে পেলাম ডাক্তারের অফিসের অন্য ফোনে অপর রিসেপশনিস্ট আরেক রোগীকে একই তারিখ একই সময় অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিচ্ছে। ঘটনার কাকতালিয়তায় আমরা তিনজনই হকচকিয়ে গেলাম। আমাকে লাইনে রেখে উভয় রিসেপশনিস্ট পরস্পরের সাথে আলাপ করতে লাগল, তারপর জানাল, ‘সব ঠিক আছে’। আমি বললাম, ‘কিভাবে সব ঠিক আছে? অন্য রোগীকে তো সময় পরিবর্তন করে দিলে না’। সে বলল, ‘অন্য রোগীও তুমি’। আমি হতবাক হয়ে বললাম, ‘মানে?’ ‘মানে অন্য লাইনে তোমার হাজব্যান্ড ফোন করেছে তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পরিবর্তন করার জন্য। সুতরাং আমরা দু’জনেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পরিবর্তন করে একই সময় দিলেও একই রোগীকেই দিয়েছি। সুতরাং, সব ঠিক আছে!’

এমন অদ্ভুত ঘটনায় হাসলাম কিছুক্ষণ সবাই মিলে।

আরেকদিন সন্ধ্যায় মাছ রান্না করব, চুলায় পেঁয়াজ ভাজা হচ্ছে, আমার ছেলে কাঠি দিয়ে পেঁয়াজ নেড়ে নেড়ে রান্নার ভান করছে, আমি মাছ শেষ ধোয়া দিচ্ছি, আমার মেয়ে ধনিয়া পাতা বেছে রেডি করছে। খানিক পর পেঁয়াজ ফুটতে শুরু করল। ছিটকে গায়ে পড়তে পারে বলে পুত্রকে বললাম, ‘বাবা, পেঁয়াজ ফুটছে, এবার তুমি একটু দূরে সরে যাও’। সাথে সাথে শুনি সে বোনকে গিয়ে বলছে, ‘আপু, আম্মু বলেছে the pot is going to explode. চল আমরা দু’জনেই এখান থেকে পালাই!’ প্রথমে থতমত খেয়ে গেলেও পরে বুঝতে পারলাম ইংরেজী boil, sputter, explode এই সবগুলো শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হোল ‘ফুটছে’। সুতরাং, আমার ভাষা সম্পর্কে স্বল্পজ্ঞানী কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ে big+জ্ঞানী পুত্রের কল্পনাবিলাসের ফলাফল হোল সে ‘ফুটছে’ শব্দের সম্ভাব্য অনুবাদ করেছে ‘explode’! ব্যাপারটা বেশ কিছুদিন আমাদের সবার হাসির খোরাক জোগালো।

জীবনের এই টুকটাক মজার ঘটনা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দই জীবনে বৈচিত্র আনে, জীবনকে অর্থবহ করে। ক্ষণে ক্ষণে ঘটমান এসব ঘটনা দেখে ভাবি, অতঃপর আমি আমার প্রভুর কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করব?

বিষয়: বিবিধ

৪৯৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File