সুরা হুজুরাতের ১০ম আয়াত, ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হওয়ার নির্দেশ

লিখেছেন লিখেছেন জয়নাল আবেদীন টিটো ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০২:৩০:০৭ রাত

১০) নিশ্চয়ই মু'মিনগণ পরস্পর ভাই ভাই । সুতরাং তোমরা তোমাদের পারস্পারিক সম্পর্ক সুস্থাপন করে নাও । আল্লাহর প্রতি তাকওয়া পোষণ কর, যেন তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও ।

১১) হে ঈমানদারগণ কোন লোকসমষ্টি যেন অন্য কোন লোক সমষ্টিকে উপহাস/বিদ্রূপ না করে । হতে পারে তারা ওদের চেয়ে উত্তম । কোন নারী যেন অপর কোন নারীকে উপহাস/বিদ্রূপ না করে । হতে পারে তারা ওদের চেয়ে উত্তম ।

তোমরা একে অন্যকে আপমান/insult করো না ।

একে অপরকে নিকৃষ্ট নাম ধরে সম্বোধন করো না ।

ঈমান গ্রহণের পর ফাসেকী নামে খ্যাত হওয়া বড়ই খারাপ কথা । যারা এ থেকে তওবা করবে না, তারাই জালেম ।

১২) হে ঈমানদারগণ, বেশী বেশী অনুমান করা থেকে তোমরা বিরত থাক । কিছু কিছু অনুমান তো নিশ্চয়ই গোনাহ ।

তোমরা একে অপরের দোষ অনুসন্ধান করো না ( অর্থাৎ তোমরা একে অপরের দোষ খুঁজে বেড়িও না )।

তোমরা একে অপরের নামে গীবত (নিন্দা বা বদনাম) করো না । তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে ? তোমরাই তো তা ঘৃণা করবে ।

আল্লাহকে ভয় কর । নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, এবং পরম করুণাময় ।

নামাকরণ

হুজুরাত শব্দটি 'হুজরা' শব্দের বহুবচন । হুজরা মানে ব্যক্তিগত কক্ষ/ Personal room/ personal chamber । এই সুরার ৪র্থ আয়াতে হুজুরাত শব্দটি আছে ।

নাযিল হওয়ার সময়কাল

এ সুরা নাযিল করা হয়েছে মক্কা বিজয়ের পর, নবম হিজরীতে । রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের পর আরবের চারদিক হতে বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিদল আল্লাহর রাসুলের সাথে সাক্ষাত করতে আসতে লাগল । কোন কোন মরুচারী বেদুঈন--যারা ছিল একেবারেই আনকালচার্ড, সভ্যতার ছোঁয়া যারা কোনদিনই পায়নি, তারা আল্লাহর রাসুলের (সা.)-এর দরজার সানে এসে -কর্কশস্বরে, উচ্চশব্দে ডাক দিত । নবীজি তাঁর স্বভাবজাত ভদ্রতার দরুন তাদেরকে কিছু বলতেন না । কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদেরকে আদব কায়দা/ Etiquette General code of behavior শেখানোর প্রয়োজন অনুভব করলেন । এরই প্রেক্ষিতে এ সুরা নাযিল হয় ।

আলোচ্যবিষয়

১৮টি আয়াত সম্বলিত এ সুরায় আলোচ্য বিষয় বেশ কিছু । তবে আমরা এত বিষয় আলোচনা করব না । আমরা শুধু ১০, ১১ এবং ১২ নম্বর আয়াতের আলোচ্য বিষয় নিয়েই কথা বলব । ১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন মু'মিনদের পারস্পারিক বিষয় কী হবে ।

আপন ভাইদের মাঝে যে সম্পর্ক, এক মু'মিনের সাথে অন্য মু'মিনের সম্পর্ক ঠিক তা-ই । যে স্বভাব এবং আচরণ আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধকে আহত করে, আমাদের ঐক্যের দেয়ালে ফাটল ধরায়, আমাদের পারস্পারিক আত্মার বন্ধনকে ধ্বংস করে --তা হারাম ঘোষণা করা হয়েছে ১১ এবং ১২ নম্বর আয়াতে ।

যারা আখেরাতে আল্লাহর কাছে নাযাত চান, যারা চিরসুখের জান্নাত লাভ করতে চান, তাদের জন্য এ আয়াতগুলোর মর্মার্থ জানা, মানা এবং আমল করা ফরয ।

[b]১০ নম্বর আয়াত

ইন্নামাল মু'মিনুনা ইখওয়াতুন । নিঃসন্দেহে মু'মিনগণ পরস্পর ভাই ভাই ।

আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই, রক্তের কোন বন্ধন নেই, তারপরও অচেনা এক বিশ্বাসী অন্য বিশ্বাসীর ভাই, --এটা পৃ্থিবী ইতিহাসে এক অসাধারণ ঘোষণা । মানুষে মানুষে যে ভেদাভেদ ছিল, যে শ্রেণী এবং বর্ণবৈষম্য ছিল, ভ্রাতৃত্বের এই সার্বজনীন ঘোষণা সেই সবকিছুকে যে চুরমার করে ভেঙ্গে দিয়ে একনতুন সভ্যতার ভিত্তি গড়ে তুলল ।

এখানে কেউ ছোট-বড় নয়, সবাই ভাই ভাই ।

এখানে কেউ পর নয়, সবাই ভাই ভাই ।

এখানে কেউ ব্রাহ্মণ বৈশ্য শূদ্র নয়, সবাই ভাই ।

কেউ যেন কারো অচেনা নয়, সবাই ভাই ভাই ।

এই ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখাকে ইসলাম অনেক বেশী গুরুত্ব দিয়েছে । এমন কি তা নফল নামাজ-রোযা, দান-সাদকাহ'র চেয়েও অনেক বেশী ।

# কিয়ামতের কঠিন দিনে, যখন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না, তখন সাত শ্রেণীর লোককে আল্লাহ তাঁর ছায়ায় স্থান দিবেন । এর মধ্যে এমন দু'জন হল, যারা একে অপরকে শুধু আল্লাহর জন্য ভালবাসে । আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা একত্রিত হয়, এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা আলাদা হয়ে যায় ।

(আবু হুরাইরা রাদি. হতে বুখারী ও মুসলিম সংকলন করেছেন । রিয়াদুস সালেহীনে হাদীস নং ৩৭৬ )

# রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিনে আল্লাহ বলবেন, আইনাল মুতাহাব্বুনা বি জালালী, যারা শুধু আমারই মযার্দার কারণে একে অপরকে ভালবাসত, আজ তারা কোথায় ? আমি আজ তাদেরকে আমারই ছায়ায় স্থান দিব । আজকের দিনে আমার ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া নেই ।

( আবু হুরাইরা (রাদি.) হতে মুসলিম সংকলন করেছেন । রিয়াদুস সালেহীনে হাদীস নং ৩৭৭ )

# রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সেই সত্ত্বার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে যেতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা মু'মিন হবে । আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মু'মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না পরস্পরকে ভালবাসবে ।

( আবু হুরাইরা (রাদি.) থেকে মুসলিম সংকলন করেছেন । রিয়াদুস সালেহীনে হাদীস নং ৩৭৮)

# রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন, যারা আমারই মহত্বের কারণে একে অপরকে ভালবাসে, (কিয়ামতের ময়দানে) তাদের জন্য নূরের মিম্বর থাকবে--যা দেখে নবী ও শহীদগণ পর্যন্ত ঈর্ষা করতে থাকবেন ।

( মুয়ায রাদি. থেকে তিরমিযিতে সংকলন করা হয়েছে । রিয়াদুস সালেহীন, হাদীস নং ৩৮১)

ভ্রাতৃত্ববোধ বিষয়ক অনেক হাদীসের মধ্যে এখানে মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হল । এ থেকে জানা গেল, শুধু আল্লাহরই জন্য ভালবাসার গুরুত্ব কত অপরিসীম ।

যারা একে অপরকে শুধু আল্লাহরই জন্য ভালবাসে, তারা কিয়ামতের দিনে আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পাবেন--যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর অন্য কোন ছায়া থাকবে না; কিয়ামতের দিনে তারা জন্য নূরের মিম্বরের উপর সমাসীন থাকবে-যে নূরের মঞ্চ দেখে নবী ও শহীদগণ পর্যন্ত ঈর্ষা করতে থাকবেন । আবার বিপরীতদিকে, পারস্পারিক হিংসা-বিদ্বেষের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ববোধকে ছিন্ন করা নিজের দ্বীন-ধর্মকে ছিন্নভিন্ন করার শামিল ।

সুরা হুজুরতের ১০ নম্বর আয়াতের পরবর্তী অংশ হল ফাআছলিহু বাইনা আখাওয়াইকুম, তোমরা পারস্পারিক ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ইসলাহ (সুস্থাপন) করে নাও ।

ইসলাহ আরবী শব্দ, যার অর্থ মেরামত করা, সংশোধন করা ।

ধরুন, কারো বাড়ীর দরজা ভেঙ্গে গেল । এর মেরামত করা--একে বলে ইসলাহ ।

টুটা-ফাটা, ভাঙ্গাচোরা, ছেঁড়াফাড়া--এগুলোকে মেরামত করা হল ইসলাহ ।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, পারস্পারিক সম্পর্কে ফাটল দেখা দিলে তা মেরামত করে নিতে ।

আবু দ্দারদা (রাদি.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কাজ সম্পর্কে বলন না, যা নামাজ রোজা-দান-সাদকাহ হতে উত্তম ? সাহাবাগণ বললেন, হ্যাঁ বলুন । নবীজী বললেন,' সালাহু যাতিল বাইনি'' পরস্পরের মধ্যে ইসলাহ করে দেয়া, মানে সম্প্রীতি করে দেয়া ।

একে অপরের সাথে ফ্যাসাদ করা হল মুণ্ডন করা । আমি (নবীজি) বলছিনা যে তা চুলকে কামিয়ে ফেলে , বরং তা দ্বীনকে কামিয়ে ফেলে । (তিরমিযি) ।

ওয়াত্তাকুল্লাহা লাআল্লাকুম তুরহামুন ।

তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যেন তোমাদের উপর রহম করা হয় ।

এর মানে, তোমাদের মনে সত্যিই যদি আল্লাহর প্রতি ভয় থাকে, তাহলে, ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক মজবুত করে নাও । পারস্পারিক সম্পর্কের ফাটলকে ইসলাম বা মেরামত করে নাও । তখনই তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষণ হবে ।

(ক্রমশ...)

বিষয়: বিবিধ

২৮১৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

293562
১২ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০৪:৫৮
কাহাফ লিখেছেন :
'মুসলিম ভ্রাতৃত্ব'নামে ইসলামের অতীব গুরুত্বপুর্ণ এই বিষয় টা এড়িয়ে চলার কারণেই আজকের দুঃসহ অবস্হা!
মহান আল্লাহ ইসলামী ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ হওয়ার তাওফিক দান করুন,আমিন!!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File