মা বিহীন শূন্য পৃথিবী
লিখেছেন লিখেছেন রাবেয়া রোশনি ১৬ এপ্রিল, ২০১৩, ০৫:২০:২৩ বিকাল
নিজেকে আজ খুব বেশি অসহায় মনে হচ্ছিল রায়হানের । চারদিকে মেঘের গর্জন, প্রচণ্ড ঝড়, বাতাসের তুমুল বেগ, মাঝে মাঝে আকাশের ভয়ংকর নাদ বইছে। ক্লান্তি নেই, অবকাশ নেই, আছে শুধু হুঙ্কার। ঠিক রায়হানের মনে একই দানা বাঁধছে। হাজারও কষ্ট যেন আঁকড়ে ধরেছে রায়হান কে ।
সেই সকালে বেরিয়েছে। মানুষজন এখনও ঘুমে আচ্ছন্ন। মনের কোণে এক বিশাল চাপা কষ্ট নিয়ে চলতে হচ্ছে।
সারাদিন উদবান্তের মতো ঘুরছে, এখন অনেক রাত, লোকজনের কোনো ভিড় নেই, সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে চারদিকে, আলো আধারির মাঝে হেঁটে চলেছে রায়হান ।
কখন যে বাড়ির সামনে চলে এসেছে তা টেরই পেল না। অথচ সারাদিন বিষণ্ণ মন নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরেছে ।
দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ কর্নারের রুমটা থেকে হালকা আলোর দ্যুতি এসে চোখে পড়ল। বাড়িটি দু তোলা বিশিষ্ট। বাড়ির সামনে জারুল গাছ রয়েছে। এই গাছটা দেখতে বারি চমৎকার। আগে কত পাখির আড্ডা হতো । কিচির মিচির শব্দ। সকাল বেলা পাখিদের এই দৃশ্য দেখে নিজকে পাখির মতো মনে হতো।
গাছটি দেখতে চলে যাই উপরে। ভাবনার জগতে হারিয়ে যাই। ঢুকে পড়ি রুমটাতে । না কেউ নেই, কি যেন খুঁজি, খুঁজতে চেষ্টা করি। অজান্তেই চোখ চলে গেল জানালার দিকে , আর গভীর নিঃশ্বাস ফেলি।
আজ কেউ বকা দিচ্ছে না, কিছু বলছে না। অপেক্ষা করছে না কেউ। কেন করবে? আজ তো মা নেই ।
মা থাকতেন ওই রুমটিতে । আমি বাসায় আসতে একটু দেরি হলে মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। শুরু হয়ে যেত ফোনের পর ফোন। কোথায় আছি , কেন দেরি হচ্ছে , কতক্ষণ লাগবে বাসায় ফিরতে? এই সব প্রশ্ন শুনতে হতো আমাকে ।
আমি বলতাম , মা এইতো আর কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় আসছি । মায়ের মন তো মানছে না। এই জানালার পাশে দাড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতেন । আমি বাসায় ফেরার পর মা স্বস্তি পেতেন।
পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারায়ই । সেই থেকে মা আমার সব । বাবা হারানোর কষ্ট কখনও বুঝতে দেয় নি।
হাই স্কুল টিচার হিসাবে জয়েন্ট করেন । আর সকাল সন্ধ্যা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
সমাজের ফিছিয়ে পরা মানুষগুলো নিয়ে মা একটু চিন্তিত ছিলেন। বিশেষ করে যারা পড়াশুনা করতে সমস্যায় পড়তো, তাদের প্রতি মায়ের দরদ একটু বেশিই ছিল।
একসময় মা এলাকার এতিম, অনাথ এবং সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের পড়ানোর উদ্যোগ নেয়। আমাদের বাসায় পড়ানোর ব্যবস্থা করেন । নীচতলায় একটা বড় রুমের ব্যবস্থা করেন। ওখানে তাদের জন্য সবই ছিল । তাদের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে সব সময় ভাবেন। এমনকি নিজের খাওয়া, ঘুম ও অন্যান্য কাজের চেয়ে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে লিপ্ত থাকতেন।
মায়ের আদর ভালবাসা আমার জন্য যেমন ছিল , ওদের জন্য তার বেশি বৈই কম ছিল না । ওদের একটু অসুস্থতা মাকে ব্যাকুল করে তুলত , অনেক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন । রাত জেগে অসুস্থ বাচ্চাদের সেবা করতেন, তাদের শিয়রে বসে থাকতেন।
এই সবের মাঝে মা নিজের কথা একদম ভুলেই গেলেন । একটু একটু করে মা অসুস্থ হতে থাকেন । আমি মায়ের এই করুণ অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলাম। আমি জোর করে মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মায়ের শরীরে মরণ ব্যাধি কান্সার ধরা পড়ল । আমি নির্বাক হয়ে পড়ি । সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসছে । মা আমার পাশে এসে আমাকে জরিয়ে ধরে সান্তনা দিলেন । এই কিছু না বাবা । মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে গ্রহণ করতে হবে। একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে।
এর কিছু দিন পরে মা আমাকে একা করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে । মা বিহীন এই পৃথিবীটা আমার কাছে এখন শূন্য, গাছ-পালা, লতাপাতা হীন এক নির্জন মরুভূমি ।
বিষয়: বিবিধ
৩৮৯৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন