ইবনে বতুতার দেশে

লিখেছেন লিখেছেন শহর ইয়ার ২৪ মার্চ, ২০১৩, ১০:২৫:৩৮ রাত

এক.

ষ্ট্যানস্টিড এয়ারপোর্টের দূরত্ব লন্ডন শহর থেকে ৪০ মাইল। বাসে যেতে ক্ষেত্রভেদে ৪৫ মিনিট থেকে দেড় ঘন্টা লাগে। এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি চেকিংয়ে যে পেরেশানি গেল তার ধাক্কায় মনে হল এক ঘন্টার বাস জার্ণি কিছুই না।জিন্স প্যান্টের বোতাম বা এ জাতীয় কিছুর কারণে আমি যখন সিকিউরিটির ডিজিটাল গেট পেরিয়ে আসি তখন একটা মৃদু এলার্ম বেজে উঠেছিল।ব্যস, আর যায় কোথা? হাতে স্ক্যানার নিয়ে দাড়িয়ে থাকা সিকিউরিটি কর্মীটি বলল, ফেস মী স্যার।



আমি টাইটানিকের নায়কের ন্যায় দুই হাত পা ছড়িয়ে তার দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম। তারপর সে স্ক্যানার দিয়ে পরীক্ষা করল। এবার আর কোন শব্দ হল না। তবুও ইশারায় নড়াচাড়া না করতে বলল। এবার আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দুই হাত দিয়ে টিপে টিপে দেখল। তারপর বলল রাইট। হ্যান্ড লাগেজ টা একটু দেখতে হবে।

লাগেজ আসে অন্য লাইনে মেশিনে স্ক্যান হয়ে। সেটাতে কোন এলার্ম বেজেছিল কিনা জানি না। তবুও বললাম, নিশ্চয়ই। কিন্তু সেটাতো এখনও লাগেজ স্ক্যানারেই আছে। কয়েকটি লাগেজ দেখিয়ে আমাকে প্রশ্ন করল, কোনটা? আমি আমার হ্যান্ড লাগেজ টেনে নিয়ে বললাম এটাই।

লাগেজ পরীক্ষায় আরেক অফিসার। হাতে গ্লাভস লাগিয়ে একটা একটা করে আমার জিনিসপত্র খুলে দেখল। তারপর সবকিছু বের করে লাগেজের প্রতিটি ভাঁজ পরীক্ষা করল স্ক্যানার দিয়ে। কিছুই মিলল না। এবার তাদের চিরায়ত ভদ্রতার মুখোশে বলল, ইউ আর অলরাইট স্যার। আপনার অসুবিধার জন্য দু:খিত।

সিকিউরিটির এই কঠিন মূহুর্ত পেরিয়ে যখন হ্যান্ড লাগেজ ঠেলে এয়ারপোর্টের ভিতরে গেলাম তখন টের পেলাম গলা শুকিয়ে গেছে। যদিও ভয় পাবার কিছু ছিল না, যেহেতু আমার

সাথে এমন কিছুই ছিল না যেটা বহন করা যাবে না। বোতলজাত কিছু সাথে নেয়া যাবে না দেখে পানিও নেই নাই। তাই তৃষ্ণা নিবারনের জন্য এক বোতল পানি কিনে নেয়ার জন্য গেলাম চেইন ডিপার্টমেন্টাল শপ ডব্লু এইচ স্মিথ এ।

এক বোতল বাক্সটন ব্রান্ডের পানি হাতে নিয়ে কাউন্টারে গেলাম দাম পরিশোধে। সেখানে বসে থাকা মহিলাটি আমাকে বললেন যদি শুধু পানি নেন তাহলে এটার দাম এক পাউন্ড ঊনআশি পেন্স আর যদি আজকের ডেইলী মেইল পত্রিকাটি কিনেন তাহলে এটা ফ্রি। আমি জিজ্ঞেস করলাম পত্রিকার দাম কত? মহিলাটি বললেন এক পাউন্ড। বললাম তাহলে পত্রিকার দামই রাখুন। যেহেতু পানিটা ফ্রি পাচ্ছি।পাঠক, এখন বুঝুন কী কারণে তারা আমাদের থেকে সব দিক থেকেই এগিয়ে!



রায়ান এয়ারলাইন্স ইউরোপের ইকোনমি পরিবহনের জন্য বেশ নাম করেছে। ছোট ছোট যাত্রায় এক শহর থেকে আরেক শহরে যাবার জন্য তাদের ব্যবসায়িক পলিসি অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের টিকেটের দাম বাস বা ট্রেনের চেয়েও সস্তা। তবে সব সময়ই নানা শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ। যেমন, অনলাইনে অগ্রিম টিকেট কিনতে হবে, যাত্রার তারিখ পরিবর্তন বা ক্যান্সেল করা যাবে না (যাবে, তবে বড় অংকের টাকা গচ্চা দিয়ে), প্লেনের ভিতরে কিছূ খেলে তা কিনে খেতে হবে, ব্যাগ বা লাগেজের ওজন ১৫ কেজির বেশি হলে তার জন্য ফি পরিশোধ করতে হবে ইত্যাদি।

ইউরোপিয়ানরা সব কিছুর জন্যই অগ্রিম পরিকল্পনা করে। তাই এসবে তারা অভ্যস্ত।প্লেনে আরোহনের জন্য গেট খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল যাত্রীরা। সাড়ে তিনশ আসনের প্লেনে সিট খালি থাকবে বলে মনে হল না। এসব প্লেনের ইকোনমি সীট আর আমাদের ঢাকার লোকাল বাসের সীটের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। শক্ত দেয়ালে পিঠ ঠেকানোর মত হেলান দেয়া আর সামনের দিকে হাঁটু চেপে ধরা আসনে বসার পর ভ্রমনের আনন্দ বেশ পাঁনসে হয়ে যায়।



এসব যাত্রায় আমি সবসময়ই করিডোর সীট পছন্দ করি, কারন তাতে নড়াচড়া করার একটা স্বাধীনতা থাকে। পাশের যাত্রীকে বিরক্ত না করেই যখন তখন উঠবস করা যায়। আমার সীট করিডোরে পড়েছিল দেখে বেশ খুশিই হয়েছিলাম। কিন্তু সীটে বসতে না বসতেই মাঝবয়সী এক বৃটিশ মহিলা এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে। বুঝলাম তিনি ভিতরে যাবেন। আমি দাঁড়িয়ে তাকে ভিতরে যাবার পথ করে দিতেই আমাকে অনুরোধের সুরে বললেন জানালার সিটে আমার বসতে কোন অসুবিধা হবে কীনা, কারণ তারা প্রায় ৮জনের মত একটি গ্রুপ। করিডোরের সীটটি হলে তাদের জন্য সুবিধা। অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মত আমি বললাম সমস্যা নেই।

ভাবছিলাম কে বসে আমার পাশে। তাদের দলে ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি সবাই আছে। কিন্তু সবাইকে সামনে পিছনে বসিয়ে দিয়ে নেত্রী গোছের সেই মহিলাটিই আমার পাশে বসলেন।বেশ সপ্রতিভ।খুব মজার কিছু বলছেন, এমনভাব নিয়ে ফিসফিস করে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে যা বললেন, তাতে বাংলায় আমার অনুবাদে যে অর্থ দাঁড়ায় তা হল, ছেলেবুড়ো সবাই বেড়াতে যেতে চায়। কাকে রেখে কাকে নিই! আমিও তার কথায় বেশ মজা পেয়েছি এমনভাব করে মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।

একটু পরে প্লেন যাত্রা শুরু করল। উড্ডয়নপর্বে প্রচন্ড শব্দ প্লেনের ভিতরে পৌঁছে না ঠিকই, কিন্তু ভাইব্রেশনের জেরে কান তালি লেগে যাবার মত অবস্থা হয়। জানালা দিয়ে দেখছিলাম সবকিছু ছোট হয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ল। প্লেনের জানালার পাশের আসনে বসে থাকা এক ব্যক্তি জীবনের প্রথম আকাশযাত্রার উত্তেজনায় সবকিছুতেই নতুনত্ব দেখছিলেন। আগে এর কাছে, ওর কাছে এটা ওটা শুনেছেন। এবার সবকিছু তিনি নিজেই পরখ করার সুযোগ পেয়েছেন। প্লেন মাত্রই স্টার্ট করেছে, রানওয়েতে তখনো দাঁড়িয়ে আছে। কাঁপা উত্তেজনায় পাশে বসে থাকা যাত্রিকে বললেন, ভাই দেখেন, প্লেন ছাঁড়তে না ছাঁড়তেই নীচের মানুষজনকে পিঁপড়ার মত দেখাচ্ছে!

পাশের যাত্রীটি বেশ ধীরে সুস্থে বললেন, এটা আসলে পিঁপড়াই। প্লেন এখনো ছাড়েনি।

শখের বশে মাঝে মাঝে ভ্রমণ করি আর সেটা একটু আধটু অক্ষমভাষায় বর্ণনার চেষ্টা করি। এই ব্লগে যারা আমার পোষ্টগুলোতে মনের ভুলে কদাচিৎ চোখ বুলিয়ে থাকেন, তাদের অনেকেই আমার চেয়ে বহুগুন বেশি ভ্রমণ করেন। তাদের অভিজ্ঞতা, জানাশুনা এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আমার চেয়ে ঢের গুণ বেশি। তাই আমার সীমাবদ্ধতা সবিনয়ে জানিয়ে বলছি, আমি হলাম গল্পের সেই প্রথম যাত্রীর মতই। তাই কোন তথ্য বা বর্ণনা আপনাদের অভিজ্ঞতার সাথে পুরোপুরি না মিললে মনে করবেন এটা নিতান্তই লেখকের অক্ষমতা।

জানালার পাশে বসাটা অবশ্য ভালই হয়েছিল। নীল আকাশে সারি সারি সাদা মেঘের স্তর পেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা অবশ্যই উপভোগ্য।বসন্তের শেষে কিংবা গ্রীষ্মের শুরুতে যেমন শিমুল তুলা বাতাসে উড়ে বেড়ায়, আকাশে ভাসমান মেঘরাশি গুলোও সেরকম তুলোর মতই উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রাচীন সংস্কৃত কবি কালিদাস তার মেঘদূত কবিতায় আকাশের মেঘকে দূত হিসাবে ব্যবহার করেছেন।কর্তব্যে অসাবধানতায় রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত যক্ষ তার প্রেমিকার কাছে বার্তা পাঠানোর কোন বাহন না পেয়ে শেষমেষ নববর্ষার প্রথম মেঘের আশ্রয় নেয়।



প্রায় দুইঘন্টার ভ্রমণশেষে পৌছালাম ইবনে বতুতার দেশ মরক্কোতে। মারাকেশের আকাশ থেকে হলুদ রংয়ের অনেকগুলো বিল্ডিং দেখে বুঝলাম এসে গেছি মরক্কো। প্লেন অবতরণ করার পরপরই বেশ একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল নেমে যাবার জন্য। আমার অবশ্য হুড়োহুড়ি নেই। কারণ আগে গেলেও ইমিগ্রেশনের হার্ডল পেরোতে আমার অনেক সময় লাগবে। তারচেয়ে ইউরোপীয়ানরা যেতে থাকুক। আমি লাইনের একদম পিছনে দাঁড়াবো।



বেশ সাদামাটা এয়ারপোর্ট মারাকেশ। পুরনো বিল্ডিং, অনেক আগে তৈরি করা মেজে। সেগুলো আস্তে আস্তে পরিবর্তনের কাজ চলছে। ইমিগ্রেশনের অনেকগুলো কাউন্টার। কিন্তু কাজে কোন দ্রুততা নেই। ইউরোপীয়ানদের পাসপোর্টগুলোতেও অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। ভীড়ের তুলনায় যে রকম শম্ভুক গতিতে লাইন আগাচ্ছে তাতে এক ঘন্টার আগে আমার সিরিয়াল আসার কোন লক্ষণ দেখছি না। তাই নির্ভারভাবেই একটি লাইনের পিছন দিকে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আজ এ পর্যন্তই।

বিষয়: বিবিধ

১৩৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File