লন্ডনে বাস ভ্রমণ এবং টিকেট বৃত্তান্ত

লিখেছেন লিখেছেন শহর ইয়ার ১০ মার্চ, ২০১৩, ০৬:১৪:১৫ সকাল

পূর্ব লন্ডনের ষ্ট্রাটফোর্ড বাস টার্মিনাল। দাঁড়িয়ে আছি ৪৯৭ নং বাসের অপেক্ষায়। গন্তব্য কেমব্রিজ পেরিয়ে বেরী সেন্ট এডমুন্ডস নামক স্থান। দুই ঘন্টার জার্নি। বেলা সাড়ে বারটা বাজে। আরো আধ ঘন্টা অপেক্ষা। একটায় আসবে বাস। ফ্রি পাওয়া মেট্রো পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছি।সময় কাটছে না। সামনে একটি লোক সিগারেট ফুকছে। চোখে সান গ্লাস।হাতে একটি ব্যাগ। তাকিয়ে আছে আমার দিকে।



পত্রিকার পাতায় উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই।প্রিন্স উইলিয়ামস আফঘানিস্তানে যুদ্ধের ময়দানে। ওয়াক ইন সেন্টারে ডা্ক্তারের খামখেয়ালীপনায় শিশুর মৃত্যু। প্রথম পাতায় এই দুটি সংবাদ, সাথে দুইটি ছবি। নীচে ঢাউস সাইজের বিজ্ঞাপন।পত্রিকার পাতায় মন বসছে না। লোকটি এবার আমার নিকটে এসেছে।

এক্সকিউজ মী! হোয়া'আর ইউ গোয়িন? লোকটি শুধাল আমাকে।

আই'ম গোয়িং বেরি সেন্ট এডমুন্ডস- আমি বললাম।

-টিকেট আছে?

-না, নেই।

-নো প্রবলেম।

আমি ভাবলাম লোকটি হয়তো টিকেট কালোবাজারী হবে। বাংলাদেশের কথা বাদ দিলাম। ভারতের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে এদের দেখা মিলবে না।কিন্তু ঐসব তো তৃতীয় বিশ্বের দেশ। বৃটেনে এসব আসবে কো-থ্থেকে?

তোমার টিকেটের দাম সাড়ে তের পাউন্ড। আমাকে দশ পাউন্ড দিলেই তুমি যেতে পার!আমি বললাম বাস এখনো আসে নাই। বাস থেকে কিনব।

-বাস আসার দরকার নেই। আমার থেকে তুমি এখনই নিতে পার। বাস আসলে তোমাকে পুরো দাম দিয়ে নিতে হবে।

পুরো দাম দিতে হবে না। আমার কাছে ষ্টুডেন্ট ডিসকাউন্ট কার্ড আছে। ওটা দিয়েই কিনব।ধন্যবাদ। লোকটিকে উপেক্ষা করতে চাইলাম। কী দরকার বাড়তি ঝামেলার!

ডিসকাউন্ট কার্ড থাকলেও তোমাকে দশ পাউন্ডের বেশি দিতে হবে। তাছাড়া বাসে তুমাকে ভাংতি টাকা নাও দিতে পারে। মনে রেখ বাস এখানে দাঁড়ায় মিনিট দুয়েক।



লোকটির কথায় যুক্তি আছে। আমার কাছে বিশ পাউন্ডের নোট। এই বাসের পরের বাস চারটায়। বাস ড্রাইভার যদি চেন্জ না দেয় তবে তিনটা অপশন- এক, পুরো টাকা তাকে অফার করা কিন্তু সে সেটা নেবে না, দুই, যাত্রীদের কাছে ভাংতি চাওয়া- যা থাকতেও পারে নাও পারে, তিন, পরের বাসের জন্য নেমে পড়া। কোন বিকল্পই মনঃপূত হচ্ছে না।

আমাকে ভাবতে দেখে লোকটি এবার বলল,ইয়ংম্যান, তুমি হয়তো আমাকে বিশ্বাস করছো না। আমি এই বাসের ড্রাইভার। এই দেখ আমার আইডি। বলেই পকেট থেকে বের করল তার ড্রাইভিং আইডি।সাথে আরো ডকুমেন্ট। বাস চালান, পকেট বুক আরও কী কী যেন!

আমি তো হতবুদ্ধি! এই রকম আইডি না হয় নকল বানানো যায়, কিন্তু লোকটি যা করছে তা তো ভীষণ ঝুকিপূর্ন। এই টার্মিনালে সব দিকে নিরাপত্তা ক্যামেরা লাগানো, পাশেই পুলিশের আনাগোনা।বুকের পাটা কত বড় হলে এরকম প্রকাশ্যে দুই নাম্বারী করা যায়!ভাবলাম সব কিছুই তো অন রেকর্ড। খামোখা ঝুলে থাকার মানে কী! দশ পাউন্ডের ঝুকি নেয়া যায়। তাছাড়া বাস যদি হাউসফুল হয়, যা নিয়মিত ঘটে থাকে, তাহলেও নেমে যাবার সম্ভাবনা নেই, যেহেতু ড্রাইভার নিজেই টাকা খাচ্ছে!

বিশ পাউন্ডের নোটটি সযতনে বাড়িয়ে দিলাম। ড্রাইভার খুশি মনে দশ পাউন্ড ফিরিয়ে দিল।

বাসের সময় ঘনিয়ে আসছে। বড় বড় ব্যাগ আর লাগেজ নিয়ে যাত্রিরা লাইন দিয়েছে।দূরপাল্লার বাসের চেনা দৃশ্য। হাতে অনলাইন থেকে কেনা টিকেট। কেউ কেউ মোবাইলে টেক্সট বের করে রেখেছে।মোবাইল টিকেট। আরও দুইজন যাত্রী এক কর্নারে দাড়িয়ে আছেন। ভারতীয় বা বাংলাদেশী হবেন। হাতের মুঠোয় সিগারেটের মত করে টাকা রেখেছেন। তারা ঠিক লাইনে না হলেও সামনের দিকে আছেন।

বাস এসে গেছে। সেন্ট্রাল লন্ডনের ভিক্টোরিয়া টার্মিনাল থেকে ছেড়ে এসেছে বাস। এখানে ড্রাইভার পরিবর্তন হল। আমার কাছ থেকে যে লোকটি টাকা নিয়েছে তাকেই দেখলাম বাসে উঠতে। চালকের আসনে বসে সবকিছু বুঝে নিতে মিনিট খানেক লাগল। এবার যাত্রীরা উঠছেন একজন একজন করে। আমিও উঠলাম। ইশারায় ড্রাইভার অনুমতি দিলেন ভিতরে যাবার। সেই দুই যাত্রী উঠলেন না। আমি সামনের দিকে একটি সীটে বসলাম।

কিছুক্ষন পর ড্রাইভার নামলেন। দুই যাত্রী হাতের মুঠোয় কী যেন দিলেন! ড্রাইভার ওয়েলডান বলে তাদের ইংগিত করলেন বাসে উঠতে। নীচে তখনো অপেক্ষায় রয়েছেন আগের ড্রাইভার। সংক্ষিপ্ত কথার ফাঁকে দুই চালক টাকা ভাগাভাগি করলেন মনে হল!শেষের দুই যাত্রীর বিশ পাউন্ড সমানভাগে দুইজনের পকেটে ঢুকলো! আমারটি এখনকার চালকের বোনাস!

বাস এগিয়ে চলেছে। শহরের ট্রাফিক সিগন্যাল পেরিয়ে মোটামুটি ফ্রি রাস্তা। চালক গতি বাড়িয়ে দিলেন। একা একা ভাল লাগছে না। সেই দুই যাত্রীর একজন আমার অপর পাশের সীটে বসেছেন। আমার সীট পড়েছে করিডোরের পাশে।ডানে এক মধ্যবয়সী মেম। মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছেন। এদের এই একটা গুণ চোখে পড়ার মত।



সেই দুই যাত্রীর একজন বাংলাদেশী। নরউইচ নামক জায়গায় যাচ্ছেন। রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। সাপ্তাহিক ছুটিতে লন্ডন এসেছিলেন।নাম বললেন আলী। আলী ভাই। এই রুটে চলাচল করেন বছর দুয়েক। আমার মনে সেই টিকেটের কৌতুহল। এ কথা সে কথার পর টিকেট প্রসংগ এল। বললেন এই রুটে চলাচলকারী বেশিরভাগ ভারতীয় কিংবা বাংলাদেশি টিকেটের পরিবর্তে নগদ টাকা দিয়ে ভ্রমন করেন,যেখানে টিকেটের দামের অর্ধেক মুল্যে চলাচল করা যায়।চালকরাও সেটা পছন্দ করেন।বাড়তি টু-পাইস কার অপছন্দ!

মনে পড়ল ছোটখাট দূর্নীতি কিংবা ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য পাশ্চাত্যের অংগুলি হেলন শুধু আমাদের দিকেই হয়। কিন্তু তাদের দূর্নীতিগুলো তুলে ধরার যথাযথ মাধ্যম কোথায়?

বিষয়: বিবিধ

২৮৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File