দীর্ঘায়ু হোন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু
লিখেছেন লিখেছেন শহর ইয়ার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৩:৪৪:১৮ রাত
২০০৭ সালের মার্চ-এপ্রিলের কোন একদিন।সিলেটের বিয়ানীবাজার থেকে ছেড়ে আসা শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা যাচ্ছিলাম। বড়লেখা ষ্টপ থেকে উঠে যে সিট পেয়েছিলাম সেটি পিছন দিকে ছিল। পুরো বাস যাত্রীতে পরিপূর্ণ। নির্দিষ্ট দু-চারটি সিট ফাঁকা ছিল পরের ষ্টপেজ কুলাউড়ার জন্য। ঘন্টাখানেক পরে বাস এসে পৌঁছাল কুলাউড়া। আমার পাশের সীটে আসন নিলেন এক পৌঁঢ়া। তিনি জানালার ধারে বসলেন। আমি উঠে জায়গা করে দিলাম।
দূরপাল্লার বাসভ্রমণে একাকী যাত্রা করাটা মাঝে মাঝে বিরক্তিকর লাগে। দুইজন হলে গল্পগুজব করেই সময় পার করা যায়। আর একাকী ভ্রমণে যদি সহযাত্রী সেরকম সহৃদয় হন তাহলেও যাত্রা উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে আমি অবশ্য কোন সুযোগ পেলেই কারো সাথে আলাপচারিতা জমানোর চেষ্টা করি। এ যাত্রায়ও তার ব্যতিক্রম হলনা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আলাপচারিতা জমে উঠল। কুলাউড়া শহরেই তার পিতৃনিবাস। এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে এসেছিলেন এখানে। আবার ফিরে যাচ্ছেন ঢাকা। দুজনেই সিলেটের লোক। কিন্তু তিনি কথা বলছিলেন শুদ্ধ বাংলায়। নিজেই বললেন আমার নাম রওশন আরা বাচ্চু। আমি একজন ভাষা সৈনিক। বেশ সপ্রতিভভাবেই নিজের পরিচয় তুলে ধরলেন তিনি। এমন একজন উঁচু মাপের মানুষকে সহযাত্রী হিসাবে পেয়ে নিজের ভাগ্যকেই ধন্যবাদ জানালাম।
ভাষা সৈনিক ছাড়াও তার অন্য যেসব গুণাবলী রয়েছে শুধুমাত্র সেগুলো তুলে ধরলেই তিনি যে অন্য সবার চেয়ে আলাদা সেটা না বললেই চলে। তবে সবিনয়ে তিনি সেগুলো উপেক্ষা করে চলেন। পুরো যাত্রায় আমি ছিলাম একজন মনোযোগী শ্রোতা। তিনিই শুধু কথা বললেন। নিজের কথা, পরিবারের কথা, ভাষা আন্দোলনের কথা।
নিজের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, চল্লিশের দশকে যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী শেষ করলেন, তখন তার সাথে আর মাত্র দুইজন ছাত্রী ছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষে তার পরিবার পড়লেন বেকায়দায়। বিয়ে দিতে উপযুক্ত পাত্র পাচ্ছিলেন না। সিলেটের মেয়ে। তার উপর মাষ্টার্শ পাস। পরিবারের লোকজন আত্মীয়স্বজন গলদগর্ম হচ্ছিলেন তার বিয়ে নিয়ে উপযুক্ত পাত্রের অভাবে। অবশেষে যাকে পাওয়া গেল তিনি উত্তরবঙ্গের লোক। তার চেয়ে বয়সে দশ বছরের বড়।
বেশ অকপটেই কথাগুলো বলছিলেন রওশন আরা বাচ্চু।
আমার বয়স ৭৫ বছর। আর আমার স্বামীর বয়স ৮৫। শুধুমাত্র মনের জোরে বেচেঁ আছি আমরা। আমার স্বামী বাড়ি করার জন্য অনেক পরিশ্রম করে একটি জায়গা বের করেছিলেন। তার পছন্দ ছিল মসজিদের আশেপাশে বাড়ি করার। যাতে আজানের পরেই বাসা থেকে গিয়ে জামাতে নামাজ পড়তে পারেন।
রওশন আরা বাচ্চু একটি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। বললেন রিটায়ার করেছেন। সেটি সম্ভবত: বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ হবে (পুরোপুরি মনে পড়ছে না)। ছেলেমেয়ের কথা বলতে গিয়ে বললেন আমার তিন মেয়ে। এরা আসলে ছেলেদের মতই। আমি তাদের সেভাবেই গড়ে তুলেছি। এক মেয়ে উচ্চশিক্ষায় বৃত্তি নিয়ে পড়ালেখা করছে কানাডায়। আরেকজন আমেরিকায়। আর ছোট মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেশ তৃপ্তির সুরেই কথাগুলো বললেন তিনি।
সময়ের পরিক্রমায় আট বছর পরে হয়তো ব্যক্তি জীবনে আরো অনেক পরিবর্তন হয়েছে রওশন আরা বাচ্চুর। তবে পরিবর্তন হয়নি তাদের মূল্যায়নে। এখনো অনেকটা অবহেলায় পড়ে আছেন হয়তো। দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ থেকে প্রাপ্যটুকু কখনোই পাননা তারা। নাহলে একজন রওশন আরা বাচ্চুকে আমার মত সাধারন একজন যাত্রীর সাথে দূরপাল্লার বাসের পিছনের সিটে বসতে হবে কেন?
উন্নত দেশে এই মাপের মানুষরা রোল মডেল হয়ে থাকেন। রাষ্ট্র তাদের পৃষ্টপোষকতা করে। বাসস্থান, যাতায়াত সবকিছুতেই ভিআইপি সুবিধা দেওয়া হয়। আর আমাদের দেশে ভিআইপি সুবিধা পান দুর্নীতিবাজ আমলা, মন্ত্রী, রাজনীতিবিদরা।
বছর ঘুরেই আবার আসে একুশে ফেব্রুয়ারী। সারা বছর ভুলে থাকলেও এদিন আমরা কিছুটা হলেও স্মরণ করি আমাদের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের, ভাষা সৈনিকদের। আজ সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ভাষা শহীদদের। আর জীবিত সকল ভাষা সৈনিকদের।
এই বিশেষ দিনে আপনাকেও বিশেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। ভাল থাকুন। দীর্ঘায়ু হউন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন