মায়ের কথা
লিখেছেন লিখেছেন শহর ইয়ার ১২ মে, ২০১৪, ০৩:৫২:৩৯ রাত
মা দিবস বলেই মায়ের কথা লিখতে হবে এমন নয়। অনেক দিন থেকেই ভাবছি মায়ের সম্বন্ধে দুটি কথা লিখব।কিন্তু পরম মমতাময়ী মাকে নিয়ে কিছু লেখার মত সক্ষমতা এখনও অর্জন করতে পেরেছি বলে মনে হয়না। মায়ের কোন বিষয়টি রেখে কোনটি লিখব খুঁজে পাই না। সারা জীবন মায়ের কাছ থেকে শুধুই পেয়েছি। বিনিময়ে কিছুই দিতে পারিনি।
আমার মা একজন সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে। নানা বাড়ির বিশাল ভূ-সম্পত্তি ছিল একসময়। তিনশ বিঘার ও বেশি কৃষি জমি। অনেকগুলো টিলা।আমাদের এলাকায় একটি মার্কেট। নানা ছিলেন ব্যবসায়ী। সে আমলে আমার নানারা জাহাজে করে হজ্জে গিয়েছিলেন। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি প্রতি বছরই নানা বাড়িতে ৬-৭টি গরু জবাই করে গরিবদের খাওয়ানো হত। এমন অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে হলেও আমার মা অতি সাধারন জীবন যাপনে অভ্যস্ত। বাবার সাথে সংসার জীবনের প্রথম দিকে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী।
সংসারে বাবার পরিশ্রম আর মায়ের শক্ত হাতে হাল ধরার কারণে একসময় আমাদের পরিবারও আর্থিক সচ্চলতার মুখ দেখে। আমাদের ভাই-বোনদের প্রত্যেকের পড়ালেখায় মায়ের উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেও আমাদের নয় ভাই-বোনের প্রত্যেকেই কমপক্ষে এসএসসি পাশ করেছি। এরমধ্যে ৭জন গ্র্যাজুয়েট ও চারজনের স্নাতকোত্তর লেভেলে পড়াশুনা রয়েছে। ইন্টারমিডিয়েটে থাকাকালীন দুইবোনের বিয়ে হয়ে যাবার কারণে বেশি পড়ালেখা করতে পারেননি। আমাদের সবার এই সাফল্যের পিছনে মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিরন্তর উৎসাহ কাজ করেছে। নিজে না খেয়ে না পরে আমাদের দুইহাত ভরে দিয়েছেন। নিজের ভোগবিলাস বিসর্জন দিয়ে আমাদের চাহিদা পূরণ করেছেন। এমন নি:স্বার্থ ভালবাসা পৃথিবীতে বাবা-মা ছাড়া আর কার কাছে আশা করা যায়?
মায়ের একটি গুণ সবাইকে আপ্যায়ন করানো। আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-পরিজন যারাই মায়ের কাছে আসেন কোন দরকারে কিংবা এমনি সবাইকে মা কিছু না কিছু দিয়ে আপ্যায়ন করান। খাবারের সময় হলে চারটা ডাল ভাত হলেও মা কাউকে খাওয়াতে পারলে খুশি হন। মায়ের কাছে যে বা যিনিই আসুন না কেন কমপক্ষে চা-পানসুপারি সবার জন্যই বরাদ্দ থাকত। একারনে বাবার কাছে যারা চিকিৎসা করাতে আসতেন এমন মহিলা রোগীদের অনেকেই মাকে এক নজর না দেখে যেতেন না!
আমাদের প্রত্যেক ভাইবোনকেই আলাদাভাবে যত্ন নিয়েছেন মা। এর মধ্যে শারীরিকভাবে বরাবরই দূর্বল আমি মাকে কষ্ট দিয়েছি বেশি! ছোটবেলা থেকেই মাইগ্রেন এ ভুগছি নিয়মিত। কিন্তু মায়ের বিশেষ পরিচর্যায় কখনোই রোগব্যাধি ঘায়েল করতে পারেনি। কখনো বিরক্তিহীনভাবে মাথা টিপে দিয়েছেন, কখনো মাথায় পানি ঢেলেছেন নলকূপ থেকে আবার কখনো চা বানিয়ে দিয়েছেন কড়া করে (লাকড়ির চূলায় আগুন জ্বালানোটাও কষ্টকর ছিল বৈকি!)।
পড়ালেখা করার জন্য ঢাকায় ছিলাম এক দশক। প্রায় প্রতি মাসেই গ্রামের বাড়িতে যেতাম বাবা মাকে দেখতে। বাবার কাছ থেকে পেতাম যাবতীয় খরচের টাকা। আসার সময় মা লুকিয়ে দিতেন আরো কিছু টাকা।গরমে ভ্রমণের সময় মাথা ধরাটা আমার নিত্যসঙ্গী। বেশি গরম পড়লে মাথা ধরা থেকে বাঁচতে যেন ট্রেনের এসি কামরায় বসে যাই সে জন্যই সব সময় অতিরিক্ত টাকার ব্যবস্থা করে রাখতেন মা।হাতে টাকা দিয়ে সেখান থেকে আবার কিছু টাকা চেয়ে নিতেন তিনি! কারণ পথে যাতে কোন বিপদ আপদ না হয় তার জন্য বিশ-পঞ্চাশ টাকা গরিবদের দান খয়রাত করতেন। মা্যের তুলনা শুধু তিনিই।
সারা জীবন সংসারের কাজকর্ম করে এখনো প্রতিটি ক্ষণ নিজেকে ব্যস্ত রাখেন মা। শারীরিকভাবে খুবই দূর্বল। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত। তবুও কাজ করতে ভালবাসেন তিনি। সংসারের কাজ নেই ঠিকই তবে শখের কাজ নিয়ে তিনি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। হস্তশিল্পে মা খুবই পারদর্শী। এক সময় বেতের তৈরি বিভিন্ন জিনিস বানাতেন শখের বশে। এখন উল দিয়ে বুনেন নিজের পছন্দের জিনিস। উল দিয়ে বুনেন গেন্জি, সুয়েটার, টুপি, মাফলার, মাথায় গোঁজার গোলাপসহ বিভিন্ন রকমের ফুল, হাতের বন্দনী, বাচ্চাদের দুধের বোতলের কভার, মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ আরো কত কী! দেশের বাইরে মা আছেন ২০০৬ সাল থেকেই। থাকেন আমেরিকায়। মাঝে মাঝে লন্ডন আসেন আমাদের দেখতে। কিন্তু যেখানেই থাকুন না কেন, আত্মীয় স্বজনেরা এখনো সমানেই আসেন মাকে দেখতে। এবং অবধারিতভাবেই মা সবাইকে কমপক্ষে হাতে বোনা একটি গোলাপ উপহার দেন!
মা সারাজীবন কারো কাছে কিছু চাননি। মানুষকে সাহায্য করেই যাচ্ছেন সমানতালে। আত্মীয়স্বজনদের কে সাহায্য করার জন্য আমাদের সাথে দেনদরবার করেন নিয়মিতই। অতীতে যারা বিভিন্নভাবে আমাদের সাহায্য করেছে তাদের প্রত্যেকের অবদানই মা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন।
মায়ের চাওয়া পাওয়ার তেমন কিছু নেই। নানা বাড়ি থেকে সামান্য কিছু জায়গা নিয়ে সেখানে প্রতিষ্টা করেছেন একটি মসজিদ। সেখানে নিয়মিত নামাজ পড়া হয়। বাচ্চাদের জন্য আছে একটি মক্তব। তবে মসজিদের এখনো অনেক কাজ বাকি। ইমাম সাহেবের বেতন টেনেটুনে দেয়া গেলেও মসজিদের নির্মান কাজ শেষ করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। এতদিন মায়ের প্রচেষ্টায় মসজিদের কাজ অনেক এগিয়েছে। মা সব সময়ই চান আমরা সবাই মিলে যেন মসজিদের বাকি কাজ সম্পন্ন করি। হয়তোবা সেটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে সমাজের দশজনে হাত বাড়ালে এটা এমন কোন শক্ত কাজ হবে বলে মনে হয় না। মায়ের এই ইচ্ছেটি পূরণের জন্য সহৃদয় পাঠকের দোয়া চাইছি। আর আমার মায়ের জন্যও দোয়া চাইছি সবার কাছে।
বিষয়: বিবিধ
২২২৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন