মিডিয়ার শচীন বন্দনা এবং বাস্তবতা
লিখেছেন লিখেছেন শহর ইয়ার ১৭ নভেম্বর, ২০১৩, ০৪:৪২:১৪ রাত
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে শচীন টেন্ডুলকার এই মর্ত্যের কেউ নন। অন্য গ্রহের কোন বাসিন্দা। বাংলাদেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা যেভাবে ভারতীয় ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকারের বন্দনায় নেমেছে তা দেখে ভারতীয় পত্রিকাগুলো লজ্জা পেতে পারে!
শচীন টেন্ডুলকার একজন অসাধারন ব্যাটসম্যান তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার অবসরের কারনে ক্রিকেট বিশ্ব কিছুটা ম্রিয়মান হবে ঠিকই। কিন্তু তাকে তো থামতে হবে একটা সময়! আর অবসর নিলেই এতটা পূজো করতে হবে?
ক্রিকেট ঈশ্বর, ক্রিকেট দেবতা কোন অভিধা বাকি থাকেনি শচীন টেন্ডুলকারের বেলায়। সবই বাংলাদেশের (!) সুশীল পত্রিকা প্রথম আলোর কীর্তি!
কীর্তি অবশ্য পুরোপুরি প্রথম আলোর একথাটি বলতে পারছি না। এটি ওপারের দাদা বাবুদের কাজ। প্রথম আলো শুধু অনুবাদ করে প্রকাশ করে যাচ্ছে। এবার মহামানব শচীন টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারের দিকে তাকানো যাক।
২০০ টেষ্টে ১৫৯২১ রান করেছেন টেন্ডুলকার। ৪৬৩ ওয়ানডে ম্যাচে ১৮৪২৬ রান। বেশ ভাল রেকর্ড। ক্রিকেটের ইতিহাসে অনেক দিন বেঁচে থাকবেন টেন্ডুলকার। কিন্তু যদি বলি শুধু রেকর্ড আর টাকার জন্যই খেলে গেছেন তিনি। তাহলে কী খুব বাড়াবাড়ি হবে? এবার টেন্ডুলকারের এক সময়ের প্রতিদ্বন্দী ছিলো যারা, তাদের সাথে তার একটু তুলনা করি।
উ'ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা এক সময় ছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের সবচে বড় প্রতিদ্বন্দী। টেস্ট শুরু করেছিলেন শচিনের এক বছর পর। টেষ্ট থেকে অবসর নিয়েছেন আজ থেকে ৭ বছর আগে। ৩২৯ ইনিংসে শচীনের রান ১৫৯২১। গড় ৫৩.৭৮। সর্বোচ্চ দুর্বল বাংলদেশের বোলিং আক্রমনের বিরুদ্ধে ২৪৮ রানে অপরাজিত । ব্রায়ান লারা ১৩১ টেষ্টের ২৩২ ইনিংসে ৫২.৮৮ গড়ে ১১৯৫৩ রান। সর্বোচ্চ ৪০০ রান ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ক্রিকেট যখন আর উপভোগ করছিলেন না, তখন অনানুষ্টানিকভাবেই সরে পড়েন। তার জন্য এত বন্দনার মুখাপেক্ষী ছিলেন না তিনি।
টেন্ডুলকারের আরেক প্রতিদ্বন্দী অষ্ট্রেলিয়ার রিকি পন্টিং টেষ্ট ক্রিকেটে আসেন ১৯৯৫ সালে, টেন্ডুলকার খেলায় আসার ৬ বছর পর। ১৬৮ টেষ্টে ২৮৭ ইনিংসে ৫১.৮৫ গড়ে করেছেন ১৩৩৭৮ রান। তিনি যদি আরো ৬ বছর খেলতেন তাহলে তার রেকর্ডটা শচীন থেকে তেমন একটা দূরে থাকতো না। কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না তার দেশ অষ্ট্রেলিয়া বলেই। কারণ তারা রেকর্ডের জন্য খেলে না।
টেন্ডুলকারের চেয়ে ৩ বছরের ছোট কিন্তু টেষ্ট শুরু করেছেন তার চেয়ে ৬ বছর পর, যিনি এখনো টেষ্ট খেলছেন সেই দক্ষিন আফ্রিকান অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস ১৬৪ ম্যাচের ২৬৯ ইনিংসে করেছেন ১৩১৪০ রান। তার গড় উল্লিখিত সবার চেয়ে বেশি ৫৫.৪৪। একই সাথে তিনি টেষ্টে নিয়েছেন ২৮৮ উইকেট, যেখানে অন্যরা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়েন না ( শচীন ৪৬টি টেষ্ট উইকেট নিয়েছেন)। অল্প সময়ে হয়তো অবসরে যাবেন তিনিও। ইতিমধ্যেই ঘোষনা দিয়েছেন ২০১৫ বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলবেন না। ক্যালিসও নিশ্চয়ই রেকর্ডের জন্য খেলেন না।
ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে শচীনকে বলা হত বিস্ময় বালক। এরপর মাষ্টার ব্লাষ্টার, লিটল মাষ্টার আরো কত কী। এখন তো তিনি ক্রিকেট ঈশ্বরই হয়ে গেছেন। লজ্জা পেলাম এই কথাটি বাংলাদেশের সেরা অলরাউন্ডার মাশরাফি বলেছেন দেখে। তিনি অনেক দিন থেকেই প্রথম আলোর ভাড়াটিয়া কলামিষ্ট। হয়তো বা বাংলাদেশ দলে স্থান পেতে হলে প্রথম আলোর নেক নজরে থাকা লাগে। এজন্যই মাশরাফিও আজ তেল ঢালছেন!
তবে কী শচীন বাহবা পাবার মত কেউ নন? সে কথা বলার মত দু:সাহস দেখাচ্ছি না। আবার যতঠুকু স্তাব করা হচ্ছে সেটা মেনে নিতে পারছি না। কারন টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারে বেশিরভাগ রান এসেছে ভারতের ফ্লাট উইকেটে, যেখানে পেস বোলারদের জন্য তেমন বাউন্স থাকে না। বিদেশের মাঠিতে টেন্ডুলকার সময় বিশেষ ঝলসে উঠেছেন বৈকি! কিন্তু সেটা তার দলের জন্য তেমন একটা কাজে লাগেনি। শুধুই ব্যক্তিগত রেকর্ডের শান বাড়িয়েছেন মাত্র। প্রমান চান? ৯৮-৯৯ সালে শচীন যখন সেরা ফর্মে, তখন অষ্ট্রেলিয়ায় ৩-০ ম্যাচে টেষ্ট সিরিজে হোয়াইট ওয়াশ হয়েছিল ভারত।
ক্যারিয়ারের পড়ন্ত লগ্নে এসে শচীন ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য হয়েছিলেন গত বিশ্বকাপে। যদিও বেশিরভাগ ক্রিকেট বোদ্ধাদের বিবেচনায় শ্রীলংকার বিরুদ্ধে ভারতের ম্যাচটি পাতানো ছিল! সেসব কথা শচীনের বিদায়লগ্নে অবশ্য বলাটা সুন্দর দেখায় না। তবে প্রথম আলোসহ কয়েকটি সুশীল মিডিয়া যেভাবে শচীন বন্দনায় মেতে উঠেছে তা দেখে ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজেই ছিড়ি। আর কিছু করা তো সম্ভব নয় এই নগন্য সাধারণের পক্ষে!
স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে বলা হয় সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। মাত্র একটি বাউন্ডারি বেশি মারতে পারলেই যার ব্যাটিং গড় হত ১০০। তিনি রেকর্ডের কথা চিন্তা করলে হয়তো আরো ১০০টা বাউন্ডারি বেশি মারতেন! সেই ডন ব্র্যাডম্যানের শেষ দিনগুলোতে তাকে নিয়ে অনেক টানা হেঁচড়া শুরু হয়েছিল মিডিয়ায়। অষ্ট্রেলিয়ার সাংবাদিকরা তো বটেই, ভারতের ক্রীড়া সাংবাদিকরাও ডনের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যদি এক মিনিটের একটা ইন্টারভ্যু করা যায়! অনেক সাধনার পর হয়তো কোন এক ভারতীয় সাংবাদিকের খোঁচাখুঁচিতে বলেছিলেন, আমার বউয়ের কাছে বলেছি, শচীনের ব্যাটিং আমার মতই।
ব্যস আর যায় কোথায়? সেই থেকে শুরু হল স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে কোট করা। শচীন সম্পর্কে বলতে গেলে ডনকে কোট করা লাগবেই! সাংবাদিকদের বাড়াবাড়িতে স্যার ডন তার মৃত্যুর পর ডেডবডিকেও আর নিরাপদ মনে করেননি। পাছে কেউ কবর থেকে তার দেহাবশেষ তুলে নিয়ে যায়, এই ভয়ে তিনি একটি উইল করে যান। মৃত্যুর পর তার দেহাবশেষ যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, স্যার ডন মোক্ষম কাজটিই করেছিলেন! ভারতের (এবং বাংলাদেশের) চাটুকার মিডিয়ার যন্ত্রনা থেকে বাঁচতে শচীন কী করেন সেটাই দেখার বিষয়।
বিষয়: বিবিধ
১৭১৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন