ভারতে আনন্দ ভ্রমণে হারানো ঈদ

লিখেছেন লিখেছেন শহর ইয়ার ০৯ আগস্ট, ২০১৩, ১২:২৩:৪৭ রাত



এক.

ঈদের অফুরন্ত আনন্দ আবার কখনো হারাতে পারে কী? নিশ্চয়ই না। তবে দেশভেদে সময়ের ফারাকের গ্যাড়াকলে পড়ে একবার ঈদ উল ফিতর খুঁজে পাইনি।ভ্রমনের এই কাহিনীটি একটু পূরনো হলেও ব্যতিক্রম অনুভূতির এই অভিজ্ঞতাটি প্রায়ই মনে পড়ে।



কয়েক বছর আগে ব্যক্তিগত কাজে দিল্লী যাবার জন্য ভারতের ভিসা নিয়েছিলাম রোজার আগেই। উদ্দেশ্য ছিল মধ্য রমজানে ভারতে গেলে ঈদের প্রয়োজনীয় শপিংয়ের কিছুটা সেরে নেয়া যাবে। রোজার সপ্তাহখানেকের মধ্যে বাসের টিকেট করতে গিয়ে পড়লাম মহা সমস্যায়। মতিঝিল, কমলাপুর, কলাবাগান কোথাও বাস টিকেট নেই। সব বিক্রি হয়ে গেছে! বিশেষ করে মধ্য রমজান থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত কোন টিকেট নেই। টাকা বেশি অফার করেও ম্যানেজ করতে পারলাম না।

অবশেষে কমলাপুরে টিআরটিসির অফিসে একটা টিকেট মিলল ঈদের দিনে। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার একটা ব্যাপার ছিল দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম সেদিনই যাত্রা করবো। কাউন্টার থেকে জানালো সকালে ঈদের প্রথম জামাতে নামাজ পড়ে যেতে পারবো। সে হিসাবে ঈদের নামাজ পড়ে যাত্রা শুরু করতে কোন সমস্যা ছিল না আমার। টিকেট কনফার্ম করে ফেললাম।

নির্দিষ্ট দিনের আগের সন্ধ্যায় দেখা দিল সমস্যা। ঈদের পরম কাংখিত সেই চাঁদ দেখা গেল না। তার মানে পরের দিন রোজা থাকছে।তাই রোজা রেখেই পরের দিন সকালে রওনা দিলাম টিআরটিসির বাসে। সারাদিন যাত্রা শেষ করে যখন কলকাতার সল্টলেকে পৌঁছালাম তখন শেষ বিকেলের আলো সরিয়ে অন্ধকারের চাঁদর নেমেছে। সল্টলেক থেকে নিউমার্কেট এলাকা মোটামুটি দূরের পথ। বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।কয়েকজন বাস যাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম ধর্মতলায় কত নাম্বার বাস যায়। কিন্তু এরা কেউ জানাতে পারলেন না।

ঢাকার গাবতলী কিংবা সায়েদাবাদ টার্মিনালে নেমে ঢাকা শহরের যেকোন স্থানে যাবার পথ বাতলে দিতে পারবেন ঢাকার যে কোন অধিবাসি। কিন্তু কলকাতায় মনে হল শহরের একস্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়াটা দূর মফস্বলে কদাচিৎ বেড়াতে যাবার মতই ব্যাপার। হয়তোবা এই অভিজ্ঞতাটি শুধু আমার বেলাতেই ঘটেছিল!

যাইহোক অনেকক্ষণ পর এক যাত্রী জানালেন সেই বাসের নাম্বার। আরও কিছুক্ষণ পর বাস এল। নিউমার্কেটগামী বাসে উঠে যাত্রা শুরুর পর একটি ষ্টপেজে উঠলেন কয়েকজন তরুন। সাদা পাজামা-পান্জাবী আর মাথায় টুপি পরা। এদের কাছ থেকে জানলাম ভারতে সেদিন ঈদ পালন করা হয়ে গেছে। মানে শেষ সময়ের সিদ্বান্তে সৌদির সাথে মিল রাখার কারনে হোক আর চাঁদ দেখা যাবার কারনেই হোক সেদিন জাতীয়ভাবে ঈদ উদযাপন করা হচ্ছে।তাই ঈদ পালনে দুইদেশের দুই রকম সিদ্ধান্তে সে বছর ঈদের নামাজে শরিক হতে পারিনি। এভাবেই জীবন থেকে হারিয়ে যায় ঈদের একটি দিন।

নিউমার্কেট এলাকায় বাস থেকে নেমে হোটেলের খুঁজে বেরিয়ে পড়লাম।পরিচিত দুই একটা হোটেল ছিল। কিন্তু সেগুলোতে সিট পেলাম না।নতুন হোটেল খুঁজে বেড়াচ্ছি এই অবস্থায় পিছু নিল কয়েকজন দালাল। তারা বলল আমাকে কম দামের হোটেলে নিয়ে যাবে।আমি বললাম এখানে অনেকগুলো হোটেল আমি চিনি। আপনাদের সাহায্য লাগবে না। তারপরও লোকগুলো নাছোড়বান্দা। আমি বললাম এভাবে আমার পিছনে আপনারা আসবেন না।



এদের একজন বলল, বাবু আমরা গরীব মানুষ। আপনার উসিলায় আমরা দুটি পয়সা পাব। আপনার তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। আমি বললাম আপনাদের সাহায্যের আমার দরকার নেই। অন্য কাউকে হোটেল খুঁজে দিন।আমি নিজেই বের করতে পারবো হোটেল। দুইজন চলে গেল। কিন্তু অপরজন শেষ পর্যন্ত আমাকে ফলো করতে লাগল। আমার ধারনা ছিল এদের রেফারেন্সে যেখানেই যাবো সেখানেই এদের কমিশন বাবদ হোটেল যে টাকাটা দিবে সেটা আমার কাছ থেকেই বেশি নেবে।

একটা হোটেলে উঠে গেলাম কিছুক্ষণ পর। রুমে গিয়ে কাপড় পাল্টে হোটেলের লবিতে এসে বসলাম। এখানে দেখলাম কয়েকটি পত্রিকা রাখা। এগুলোতে একটু চোখ বোলাতে ছিলাম।কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখলাম সেই দালালদের একজন রিসেপশনে এল। কাউন্টার থেকে ম্যানেজার বিশ রুপি বের করে দিল। লোকটি চলে যাবার পর ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম টাকাটা কি আমাকে রেফার করার জন্য। ম্যানেজার হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।আমি বললাম সেতো আমাকে রেফার করেনি। ম্যানেজার বলল এদের টাকা না দিয়ে উপায় নেই! আরেকজন এখানে আসতে চাইলেও নানা বদনাম করে অন্য হোটেলে নিয়ে যাবে।



পরদিন দিল্লী যাবার ট্রেন টিকেট করার জন্য গেলাম হাওড়া ষ্টেশনে।বন্ধুদের কাছে শুনেছিলাম দিল্লী যাবার জন্য রাজধানী এক্সপ্রেস সবচেয়ে দ্রুতগামী এবং সার্ভিসও নাকি খুবই ভাল। হাওড়ার প্লাটফর্মের কাছাকাছি যেতেই আমাকে ঘিরে ধরল দালালরা। এদের আধিপত্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। কোথায় যাবেন,কবে যাবেন,কয়জন যাবেন, কোন ট্রেনে যাবেন এরকম হাজারটা প্রশ্ন। সর্দার গোছের একজন বলল, রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকেট দিতে পারবে। আড়াই হাজার রুপি লাগবে। আমি বললাম টিকেট লাগবে না। সে বলে কেনো লাগবে না?

আমি বললাম কেনো লাগবে না সে কৈফিয়তও দিতে হবে নাকি? আবার বলে আপনি নেবেন না কেন? আমি বললাম আমি নেব না আমার ইচ্ছা। তারপরও এই দালালগুলো পিছু ছাড়ে না। পাশেই পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। তবুও কোন বিকার নেই। এগিয়ে গেলাম টিকেট কাউন্টারের দিকে। কাছে যাবার উপায় নেই।দালালরা ঘিরে আছে। ভীড় নেই এরকম একটা কাউন্টারে গিয়ে বললাম, আমি ফরেন কোটায় রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকেট কিনতে চাই। লোকটি জিজ্ঞেস করল কয় তারিখের। বললাম আজকের। বলল আজকের সব টিকেট শেষ হয়ে গেছে। তবুও আপনি ফেয়ারলি প্লেসে গিয়ে দেখুন।

দেখলাম এই লোকটি নির্ভরযোগ্য। আমাকে ফেয়ারলি প্লেসে কিভাবে ট্যাক্সি না নিয়েই যেতে পারি সেই পথও বাতলে দিল। হাওড়া ষ্টেশনের অনতিদূরে হুগলী নদীর ঘাট।সেখান থেকে ইন্জিন নৌকায় করে কম সময়েই যাওয়া যায় ফেয়ারলী প্লেসে। যেখানে পর্যটকদের জন্য ট্রেনের টিকেট বিক্রি করা হয়।

আমাদের বুড়িগঙ্গা নদী যেখানে প্রায় মরে গেছে সেখানে কলকাতার হুগলী নদী সগৌরবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এখনো শহরের একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার জন্য নৌযানের জমজমাট সার্ভিস রয়েছে হুগলীকে ঘিরে।

ফেয়ারলি প্যালেসের একপাশে অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের জন্য কাউন্টার। অন্যপাশে বিদেশীদের জন্য।অভ্যন্তরীণ কাউন্টারে সেই একই দৃশ্য। দালালদের দৌরাত্ব্য। তবে পর্যটকদের জন্য যে কাউন্টার সেখানে প্যাসেন্জারদের মোটামুটি জামাই আদর দেয়া হয়।আমার মত নগন্যকেও হাসি মুখেই বরন করা হল। তার মাহাত্ম্যটাও বুঝলাম কিছুক্ষণ পরেই।

টিকেট বিক্রেতা বাংলাদেশের খোঁজখবর নিলেন। তারপর আমাকে জানালেন রাজধানী এক্সপ্রেসের আগামী তিনদিন পর্যন্ত কোন টিকেট নেই। তবে আজ সন্ধ্যায় গেলে আরেকটি ভাল ট্রেনের টিকেট তিনি দিতে পারবেন। সেটাতে রাজধানী এক্সপ্রেসের চেয়ে মাত্র চার ঘন্টা সময় বেশি লাগবে।কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে রাজধানী এক্সপ্রেসে লাগে আঠার ঘন্টা, এটাতে লাগবে ২২-২৩ ঘন্টা। এটা নাকি শর্টকাট রাস্তায় যায়।

আমি বললাম বেশ তো তাই দিন। তিনি বললেন, এই ট্রেনের নাম কালকা মেল। পনেরশ রুপি টিকেট। এরপর কোন রাখঢাক না করেই বললেন, আমাদের জন্য দিতে হবে আরো দুইশ। আমি বললাম কেন? তিনি বললেন, এটাই নিয়ম।

বিষয়: বিবিধ

২৩১৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File