বর্নমাউথের সোনালী সৈকতে

লিখেছেন লিখেছেন শহর ইয়ার ২৮ জুন, ২০১৩, ০৪:৩৩:৪৩ বিকাল



মানচিত্র দেখে যুক্তরাজ্যকে মোটামুটি একটি দ্বীপ দেশই বলা যায়। আয়ারল্যান্ডের সাথে সংযুক্ত কিছু ভুমি ছাড়া পুরোপুরি আটলান্টিক মহাসাগর পরিবেষ্টিত।সারা বছর তীব্র শীতের কারনে সমুদ্র সৈকতে যাবার ইচ্ছা এমনিই উবে যায়। যদিও লন্ডনের অতি নিকটে এসেক্স কিংবা ব্রাইটন গেলেই সাগর তীরে ঘুরে বেড়ানোর অতি চমৎকার ব্যবস্থা। বন্ধুদের গাড়িতে করে যাবার সুযোগও মেলে মাঝে মাঝে ।কিন্তু সেসব স্থানে গিয়ে সাগর তীরে খালি পায়ে হাঁটার সুখ মেলে না। কারন এসব স্থানগুলোতে সমুদ্র সৈকত নুড়িময়। নির্ভেজাল বালি নেই।

সহকর্মীদের পছন্দে স্যান্ডি বিচে ঘুরে বেড়ানোর জন্য লন্ডন থেকে ৮৬ মাইল দুরে বর্নমাউথের সাগর তীরে যাবার সুযোগ এল। প্রায় ২৫-৩০জনের গ্রুপ। লন্ডন থেকে ট্রেন কিংবা বাসে যাবার পরিকল্পনা ছিল। ট্রেনে গেলে শহরতলী থেকে সাগরতীর একটু দূরে। কিন্তু বাসে গেলে একদম সাগর তীরে স্টপেজ। তাই ন্যাশনাল এক্সপ্রেসের বাসই আমরা বেছে নিলাম। যদিও ভাড়ার ব্যবধান সামান্যই। তবে গ্রুপ টিকেট কিনে নেওয়াতে টিকেটে একটা বিশেষ ডিসকাউন্ট পাওয়া গেল।



সহকর্মীদের একাংশ

যুক্তরাজ্যের প্রায় সব জায়গাতেই বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টের ব্যবসা রয়েছে। ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টের নামে যে ব্যবসাটি চলে তার সিংহভাগ মালিকানা বাংলাদেশীদের। বাংলাদেশে যেমন চাইনিজ রেষ্টুরেন্টের নামে চলে বাংলাদেশী সব খাবারের আয়োজন, এখানেও সেরকমই ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে চলে সব বাংলাদেশী খাবার। এসব খাবারে অবশ্য অরুচি নেই বিশ্বের অন্য দেশের মানুষেরও। এ রকম একটা রেষ্টুরেন্টে আমাদের খাবারের অর্ডার আগেই দেয়া ছিল।

লন্ডনের ভিক্টোরিয়া বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রা শুরু। সকালের নাস্তার জন্য খাবারের বিশাল ভান্ডার। কলা, আপেল, বিস্কুট, টি-কেক, চকোলেট, চিপস (এখানে বলা হয় ক্রিপস),মিনারেল ওয়াটার ও জুস মিলিয়ে অনেক আয়োজন।বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই শুরুর হল পরিবেশন। কিন্তু মুহুর্তেই শেষ হয়ে গেল সেসব! আমাদের মধ্যে খাদকদের পরিমান একটু বেশিই ছিল। সহকর্মীদের হৈ হুল্লোড়ে শুরু হল উপভোগ্য এক দিনের যাত্রা।

প্রায় দুইঘন্টা বাস চলার পর আমরা পৌঁছালাম বর্ণমাউথ শহরে। এটি ইংল্যান্ডের ডরসেট কাউন্টির অন্তর্গত একটি শহর। মূলত বিখ্যাত এর দীর্ঘ ৭ মাইল লম্বা সোনালী বালুময় সৈকতের জন্য। যুক্তরাজ্যের শীর্ষ দশটি সীবিচের মধ্যে জনপ্রিয়তায় এটি শীর্ষে।

প্রথমে বাস থামল রেল ষ্টেশনের সামনেই। আমাদের অনেকেই বাস থেকে নামা শুরু করলে ড্রাইভার জানাল আরেকটা ষ্টপেজ বাকি আছে। সেখানেই সীবিচ।

মেঘলা আকাশ আর কনকনে হাওয়ায় আমরা নামলাম বাস থেকে। সুন্দর পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সবখানে।সাগর তীরের মনোরম পরিবেশে খালি পায়ে হেঁটে চলাটা খুবই আনন্দের। নানা রকম সামুদ্রিক পাখির কলরব আর বড় ছোট ঢেউয়ের কলতান ক্ষণকালের জন্য হলেও আমাদের নিয়ে যায় অন্যভূবনে।যদি ও পানিতে পা ভেজানো মাত্রই পুরো শরীরে বয়ে গিয়েছিল এক বরফ শীতল পরশ। পানি খুবই ঠান্ডা। তবুও এই ঠান্ডা উপেক্ষা করে আমাদের দলের কয়েকজন নেমে পড়ল পানিতে। আনন্দময় এই উপলক্ষ উদযাপনে ঠান্ডা পরাভূত হল!



একজন সহকর্মীকে পাঁজাকোলো করে পানিতে ফেলা হচ্ছে!

কিছুক্ষণ সাতার কাটার পর সাতারুদের গা গরমের পালা। আমাদের দল দুইভাগ হয়ে সীবিচে আয়োজন করলাম এক ফুটবল ম্যাচের। কিছুক্ষণ খেলার পর অনেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। দুই একজন আবার হাঁটুতে চোটও পেল। মাত্র পনের মিনিট খেলার পরেই দম হারিয়ে আমি ইস্তফা দিলাম সেখান থেকে! কিন্তু অনেকেই পূর্নোদ্যমে চালিয়ে গেল খেলা। আফ্রিকান গুলো এক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর।

ইতিমধ্যে আমাদের দুপুরের খাবার চলে এসেছে। চিকেন ও ল্যাম্ব বিরিয়ানী। আমি ল্যাম্ব বিরিয়ানী নিলাম। সাথে সব্জির ঝোল।বাংলাদেশী বাবুর্চির হাতের রান্না। যদিও ঢাকার বিরিয়ানীর সাথে এখানকার বিরিয়ানীর অনেক তফাৎ। ঢাকায় তৈরি বিরিয়ানীতে যে স্বাদ পাওয়া যায় সেটা আর কোথাও মিলে না। তবে কিছুটা ক্ষুধার্ত থাকায় এই ল্যাম্ব বিরিয়ানী পুর্ণ তৃপ্তিসহকারে উদরপূর্তি করলাম।

বর্নমাউথ শহরের মূল অংশ অনেক উপরে। সাগর তীরে প্রসারিত হয়ে এই বর্ধিতাংশটুকুই লাভজনক ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।সীবিচের তীর ঘেষে দাড়িঁয়ে আছে অশিনারিয়াম।অ্যাকুরিয়ামে সামুদ্রিক পরিবেশে এখানে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরণের সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ, কাকড়া, হাঙর, সরীসৃপ ও অন্যান্য প্রাণী। বিপরীত দিকে পানির উপর তৈরি করা হয়েছে একটি দর্শনীয় ক্যাসিনো যেখানে বড় ছোট সবার জন্যই রয়েছে লটারীসহ বিভিন্ন ধরণের খেলার ব্যবস্থা। আছে দূর সমুদ্রের ঢেউ দেখার জন্য টেলিস্কোপ।

সীবিচ থেকে শহরের প্রবেশদ্বারে রয়েছে একটি বিশাল উদ্যান। খুবই গোছানো ও পরিপাটি এই উদ্যান। নানা রকমের বাহারী ফুলের গাছ রয়েছে এখানে। ভিতরে হেঁটে যাবার ছোট ছোট অনেকগুলো রাস্তা। আছে কয়েকটি আইসক্রিম পার্লার।হাতে আইসক্রিম নিয়ে পার্কের রাস্তায় দেখাগুলো অনেককেই। আমিও একটি আইসক্রিম কিনে নিয়ে হাঁটা দিলাম। পার্কের এক প্রান্তে অনেক গাছগাছালীর মাঝ দিয়ে ছোট একটি রাস্তা। সেটি ক্রমশ: উঁচু হয়ে শহরের মূল অংশে পৌঁছেছে।

সেদিকে পথ চলতে চলতে এক সময় খুঁজে পেলাম শহর। শহরের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সব রকম দোকানপাট রয়েছে এখানে। মূল কেন্দ্রস্থলে দেখলাম ছোটখাট জটলা। অনেকগুলো সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই এখানকার কলেজ ইউনিভার্সিটির। হাতে প্লে কার্ড। তাতে লেখা ফ্রি হাগ। মানে বিনামূল্যে আলিঙ্গন। পর্যটকদের স্বাগত জানাতে এই মেয়েরা জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করছে! আর এটা সবার জন্য উন্মুক্ত । ফ্রি হাগ! ফ্রি হাগ !! বলে সজোরে চেচাঁচ্ছে তাদের অনেকেই।



প্রমোদ নগরী হিসাবে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরের নামঢাক আছে অনেক আগে থেকেই। আর তাদের ট্যুরিজমকে প্রমোট করার বিভিন্ন রকম কায়দাকানুনও বৈচিত্র‍্যময়। আর এসব করেই পর্যটন থেকে তাদের আয়ের বড় একটা অংশ চলে আসে। এই শহরে যেমন হাজার হাজার ট্যুরিষ্ট আসেন বেড়াতে।সেটা দিয়েই এখানকার মানুষের উপার্জন অনেকটাই নির্ভরশীল।

শহর থেকে আবার ফিরে গেলাম বালুময় সাগর তীরে। সবাই চেয়ারে বসে খোশগল্পে মত্ত। আমিও একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম। একেকজন একেকরকম আকর্ষনীয় গল্প বলছে। নানা চটকদার গল্প। অনেক মাল মশলা মিশিয়ে সেটাকে যতঠুকু আকর্ষনীয়ভাবে উপস্থাপন করা যায় সেভাবে। সত্য মিথ্যা যাচাইয়ে না গিয়ে এই মুখরোচক গল্পগুলো উপভোগ করাই শ্রেয়। আমাদের জীবন তো এরকম অনেকগুলো ছোট ছোট গল্পেরই সমষ্টি!

বিষয়: বিবিধ

২৪৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File