আম আছে মাছি নেই

লিখেছেন লিখেছেন শহর ইয়ার ২৫ জুন, ২০১৩, ০৮:১১:৩০ রাত



একটি অনলাইনে দৈনিকের শিরোনাম 'আম আছে মাছি নেই' দেখে পুরনো একটি ঘটনা মনে পড়ল। সেটি বলার আগে এ প্রসঙ্গে দুটি কথা বলে নিই।

ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আমাদের মৌসুমী ফলের মধ্যে জনপ্রিয়তায় আমের অবস্থান শীর্ষে। বইয়ে পড়েছি, 'আম পাকে বৈশাখে কূল পাকে ফাগুনে, কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে।' বাজারে পাকা আম,কাঠাল,লিচু পাওয়া যায় বলে জৈষ্ঠ্য মাস মধু মাস হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। আম পাকতে শুরু করে গ্রীষ্মের শুরুর দিকে, বিশেষ উপায়ে তা বাজারে বর্ষা শেষেও বিক্রির জন্য রাখা হয়।যদিও এখন ক্ষেত্রবিশেষে সারা বছরই বাজারে আম কিনতে পাওয়া যায়, তবু স্বাদ, মান কিংবা দামের কারণে সেটি সবার আয়ত্বের মধ্যে পড়ে না।

একটা সময় ছিল যখন দুধ ছিল অত্যন্ত সহজলভ্য। অন্তত আমাদের ছোটবেলায় তো ছিলই। তো মৌসুমী আম দুধ-ভাতের সাথেও অত্যন্ত পরিচিত একটি পদ। তারপরও সেটা অবশ্য আম-ভাত হিসাবে পরিচিতি পায়নি! দুধভাতই রয়ে গেছে। ঘরের মধ্যে দুধ ঢেকে রাখলে তাতে মাছি সমাগম হয় না। কিন্তু আম ঘরের মধ্যে রাখলেই, তা যেখানেই রাখুন, মাছি আসবেই। দুধের মাছি নামে একটি বাগধারা প্রচলিত আছে, যা দিয়ে সুসময়ের বন্ধু বোঝানো হয়। কিন্তু আমের মাছি নামে কোন বাগধারা নেই। কি অদ্ভুত বৈষম্য!

ফল হিসাবে আমার প্রথম পছন্দ আম। দেশে থাকতে তো ছিলই, বিদেশে আমার গত অর্ধযুগের অবস্থানকালীন সময়েও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আমের মৌসুমে প্রতি সপ্তাহেই আম কিনি। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় সেটা খাবার সময় পাই না। অনেক সময় অফিসে নিয়ে যাই।

দুপুরের খাবারের পর ডাইনিংয়ে টিভির সামনে বসে আম খাই। পাকা আম। টিস্যু পেপার দিয়ে জড়িয়ে মুখ দিয়েই খোসা ছাড়িয়ে খাই। আমার সহকর্মীরা আড় চোখে তাকায়। দুই একজন বাকা কমেন্ট করে ।স্বাদ কেমন, কোথাকার আম এই সব প্রশ্নও করে। আমি উত্তর দিই। কিছু মনে করি না।

সেদিন এক ইংলিশ সহকর্মী থাকতে না পেরে আমাকে একটি অনুরোধ করে বসল। তার ব্রাজিলিয়ান বউ আম খুবই পছন্দ করে। সেখানকার আমগুলো নাকি খুবই মিষ্টি (যখন সে বেড়াতে গিয়েছিল তখনকার অভিজ্ঞতায়)।

গত সপ্তাহে সে এক বক্স আম কিনেছে। কিন্তু সেগুলোতে কোন টেষ্টই নাই। তাই আমি যদি সামান্য কিছু আম তাদের জন্য নিয়ে আসি, তার বউ খুবই খুশি হবে। এই বলে আমার পকেটে জোর করে সে কিছু টাকাও ঢুকিয়ে দিল।

আমি বললাম তোমার বউ দেখতে খুবই সুইট, কোন সন্দেহ নেই। তাই বলে তোমার শ্বশুরের দেশের আম ও যে খুবই মিষ্টি, সে তথ্য কোথায় পেলে? তুমি কী জানো, ব্রাজিলিয়ান আমগুলো এই দেশে খুবই সস্তা। কোন স্বাদ নেই বলে কেউ কেনে না।

সে বলল, না না, সেখানকার আম খুবই মিষ্টি। আমি নিজেই গাছ থেকে পেড়ে খেয়ে দেখেছি। এই বিতর্কে যোগ দিল অন্যরাও। সবার কৌতুহল আম নিয়ে আমাদের এই বিতর্কে। আমি বললাম, তুমি আমের জানো কী হে? তোমাদের দেশে কিছু আলু, গম, চেরী আর বেরী ছাড়া কী আছে। তুমি আমের কী বুঝ?

আফ্রিকান কিংবা ব্রাজিলিয়ান আম আমাদের যেসব আম আছে তার সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। আমার আফ্রিকান আর ক্যারিবিয়ান সহকর্মীরা মিটিমিটি হাসল। কেউ কোন প্রতিবাদ করল না। সবাই জানে প্রতিবাদ করে লাভ নেই। আর ভারতীয় কলিগরা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল।

যাই হোক, পরের সপ্তাহে আমি তাদের কে এক বক্স আম কিনে দিয়েছিলাম। সেটা খেয়ে আমার ইংলিশ সহকর্মী বলল, তার বউ আমাকে একটি বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছে। আর সেও স্বীকার করে নিয়েছে আমাদের আমগুলোই সেরা।

বাংলাদেশে কত দুই দশক ধরে মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্যে এক সময়ের সহজলভ্য আম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। গাছে মুকুল আসতে না আসতেই রাজশাহীর আমের গাছগুলো বিক্রি হয়ে যায়। অল্প দামে কেনা সেই আমগুলিই এমনকি ভরা মৌসুমেও চড়া দামে বিক্রি হয়। যেন সে গুলি শোকেসে সাজিয়ে রাখার আইটেম। ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না।

এবার গল্পটির কথা বলি। আওয়ামীলীগের ৯৬-২০০১ সালের টার্মে ঢাকা শহরের সব জায়গায় অপেন এয়ার কনসার্ট নামক এক সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। একদিন ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা কমপ্লেক্সের একটি কনসার্টের ঘটনা।সেখানে কয়েকজন তরুন কিছু মেয়েকে উত্যক্ত করছিল। একথা সেকথা বলে তাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই সেই মেয়েগুলির দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারছিল না। অগত্যা হতাশ হয়ে গলা চড়িয়ে একজন বলছিল, আ'মে (য়েয়ে)র যা দাম, (....) হাত দেওন যায় না!

ছেলটি হয়তো অন্য কিছু বুঝাতে চেয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে আমাদের দেশে আমের দাম যে পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, তাতে কয়জন সেটা কিনে খেতে পারে সেটাই একটা প্রশ্ন। এক সময় প্রকৃতির নির্ভেজাল এই সুস্বাদু ফলটি পশু-পাখি কিংবা কীটপতঙ্গের খাদ্যের তালিকায় থাকলেও, ফরমালিন মেশানোর কারনে আজকাল তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাকি রইলাম শুধুই আমরা। অনলাইন দৈনিকটি কিন্তু বলেনি আম আছে ক্রেতা নেই, বলেছে আম আছে মাছি নেই। কারন আজকাল মাছিও যেটা খায় না, আমরা সেটাই খাই!

দেখুন মুল খবরের লিঙ্ক

বিষয়: বিবিধ

১৬৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File