মসজিদের নাম কুতুবিয়া

লিখেছেন লিখেছেন শহর ইয়ার ১০ জুন, ২০১৩, ০৫:০২:০০ সকাল

ইবনে বতুতার দেশে-৪

মারাকেশ শহরের জামা আল ফিনা চত্বরের বিপরীত দিকে এক বিশাল খোলা প্রান্তর। লাল ইটে বাধাঁই করা সমতল ময়দানের একপাশে উঁচু মিনার। পিছন দিকে সবুজ মরুদ্যান। মসজিদের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেই এক মরোক্কান তরুন আমাকে দেখে স্বগতোক্তি করল, এটা হাজার বছরের পুরনো মসজিদ। হুজুর (স: এর ওফাতের মাত্র চারশ বছর পরে এই মসজিদটি নির্মিত হয়।



কথা হচ্ছিল মসজিদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। দরজা তালা দিয়ে রাখা। তরুনটিকে জিজ্ঞেস করলাম ভিতরে যাওয়া যাবে কীনা। সে বলল নামাজের সময় হলে যেতে পারবেন। অমুসলিমদের মসজিদের ভিতরে যাওয়া বারণ। ঘড়ি দেখে সে বলল, আর এক ঘন্টা পর যোহরের নামাজ। আজান হলে গেট খোলা হবে। তখন যেতে পারবেন। আমি বললাম, তথাস্তু।

সময় কাটানোর জন্য মসজিদের পিছনের পার্কে গেলাম। প্রতিকুল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে এ রকম কিছু গাছের সমাহার সেখানে। বেশিরভাগ গাছে ফল ধরেছে। কমলা লেবুর মত দেখতে ফলটি। তবে সেই তরুনটি বলল এটা কমলা লেবু নয়। এই ফলটি ঔষধ তৈরিতে কাজে লাগে।



একা একা পার্কে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। কাছেই ফাস্টফুড চেইন কেএফসি। ভাবলাম নামাজের আগেই কিছু একটা খেয়ে নিই। ফ্রাইড চিকেনের একটি মিল নিলাম ১৬ দিরহাম দিয়ে। মরোক্কান খাবারের চেয়ে আমার কাছে এগুলোই অনেকটা সহনীয়। কিন্তু সামান্য খাওয়ার পরেই চিকেনে দেখতে পেলাম পশম। খাবারের ইচ্ছা উবে গেল। ইউরোপের যেকোন দেশে হলে পুরো খাবারের বিল সম্পূর্ণ ফেরত নেয়া যেত। কিন্তু এখানে কথা বলে কোন লাভ হবে না বলেই মনে হল।

ততক্ষণে আজান হয়ে গেছে। মসজিদের মুল গেট খোলা হয়েছে। খুব বেশি মুসল্লী নেই। ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল নিপূণ কারুকাজ। মসজিদের ভিতরের পিলারগুলো একটি আরেকটির সাথে সংযুক্ত খাঁজকাটা গম্বুজ আকৃতির দেয়াল দিয়ে। মনে হয় একেকটি আকর্ষনীয় তোরণ। নীচে লাল রঙ্গের পুরু কার্পেট। ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতেই এক অনাবিল প্রশান্তির ছোঁয়া লাগল মনে।



ভিতরের আঙিনায় অযু করার স্থান। পুরনো ভাব গাম্ভীর্য ধরে রাখতেই কীনা, অযুর পানি রাখা হয়েছে একটি কুয়ার মত স্থানে। এটি বাধাই করা। নীচে অনেকগুলো খালি পাত্র। অযূর পাত্রে পানি নিয়ে অযূ করা হলে পানির সাশ্রয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে বায়তুল মোকার্রম সহ কিছু মসজিদে এ ব্যবস্থা থাকলেও এটা বহুল ব্যবহৃত নয়। আমরা হয়তো পানির অপচয় বেশি করতে পছন্দ করি বলেই এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাই না।

মসজিদের পুরনো মিম্বরটি সম্ভবত: এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। সেটি ব্যরিকেড দিয়ে রাখা। পাশেই নতুন মিম্বর। এটাও শুধুমাত্র জুম্মা এবং ইদের সময় ব্যবহৃত হয়। টি-শেপের এই মসজিদটির ভিতরের পরিবেশ মনোরম। যোহরের নামাজ শেষ হলে মনে হল কিছুক্ষণ গদিওয়ালা মোলায়েম কার্পেটে শুয়ে পড়ি। পরক্ষণে ভাবলাম এটা ঠিক হবে না। নামাজ শেষ করে মসজিদের এক পাশে বসে বৈঠক করছেন কয়েকজন মুসল্লী। অনেকেরই মাথায় পাগড়ী। এদের মধ্যে একজন কিছু একটা বয়ান করছেন। অন্যরা মশগুল হয়ে শুনছেন তা।

মসজিদ থেকে বের হবার পথ ধরে গেট পর্যন্ত এসেই আটকে গেলাম। বলা যায় আটকা পড়লাম! প্রধান ফটকটি নামাজ শেষ হতে না হতেই বন্ধ করে ফেলা হয়েছে।হাজার বছরের পুরনো বিশাল এই দরজা খুবই শক্তভাবে লাগানো। ফটকের পাশেই নামাজ শেষ করে কুরআন তেলাওয়াৎ করছেন কয়েকজন মহিলা। আমাকে দেখে পরষ্পরের মুখের দিকে তাকালেন হাসিমুখে। একজন ইঙ্গিত করে দেখালেন এক বয়স্ক ভদ্রলোককে। আমাকে ইত:স্থত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেই মুরুব্বী ইঁশারায় তাকে অনুসরন করতে বললেন।

ভদ্রলোকের নাম আহমদ। এই মসজিদের একজন খাদেম। আমাকে আবার নিয়ে গেলেন মসজিদের ভিতরের কয়েকটি কক্ষে। সেই কক্ষগুলো অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জ্বিনের থাকার ঘর ছাড়াও আজান দেয়া হয় যেখান থেকে সেই কক্ষটিও দেখলাম। এরপর আহমদ সাহেব আরেকটি দরজা খুলে আমাকে ভিতর দিকে যেতে বললেন। উঁচু সুড়ুঙ্গের ন্যায় পথ। একটু উপরে গিয়ে আবার ফিরে এলাম। এসে দেখি আহমদ সাহেব উধাও।



অগত্যা আবার সেই উঁচু সিড়ি ধরে হাটতে লাগলাম। অন্ধকার ঢালু পথ। এটি মসজিদের মিনারে উঠার রাস্তা। কাঠের তৈরি পাঠাতন। পাকা দেয়াল। প্রতি দুইতলা পরে একটি কক্ষ তৈরি করা। একসময় হয়তো এই কক্ষগুলোতে বহু বুজুর্গ থাকতেন। সময়ের পরিক্রমায় এখন সেগুলো পরিত্যক্ত। ইতিহাস বুকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

দেখুন নীচতলায় মুয়াজ্জ্বিনের কক্ষের দেয়ালের ছবি





কুতুবিয়া মসজিদ নামটি এসেছে বই বা কিতাব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এখানে রাস্তায় দাড়িয়ে কিতাব বিক্রি করতেন যেসব পুস্তক ব্যবসায়ী, তারাই এই মসজিদটির গোড়াপত্তন করেন। সেই কিতাবিয়া থেকেই কুতুবিয়ার উৎপত্তি। প্রথম মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলা হয় সেটা পুরোপুরি ক্বিবলামুখি ছিল না বলে।তারপর দ্বিতীয় এই মসজিদটির নির্মান শুরু হয় ১১৫৪ সালে।

সিড়ি বেয়ে একাকী উপরে উঠেই চলেছি। অনেক উপরে উঠার পর বয়স্ক দুইজন ব্যক্তির দেখা পেলাম। তারাও মিনারের উপরে উঠছেন। এই মিনারটির উপরের উঠার রাস্তা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে মুয়াজ্জিন ঘোড়ায় চড়ে সোজা উপরে চলে যেতে পারেন। মিনারের উচ্চতা ৭৭ মিটার। মোটামুটি উঁচু বলা যায়।উঁচু স্থান থেকে যেমন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ত আজানের সুমহান বানী, তেমনি মুয়াজ্জিনদেরও বহন করতে হত কিছুটা গ্লানি, এ রকম স্তূতিও আছে।

কুতুবিয়া মসজিদের ঠিক বিপরীতে ছিল ততকালীন রাজ পরিবারের হেরেম। উঁচু মিনার থেকে সেই হেরেম সরাসরি অবলোকন করা যেত। তাই হেরেমের যেকোন অনাকাংখিত দৃশ্যাবলী বাইরের লোকজনের দৃষ্টিসীমার আড়ালে রাখতে শাষকগণ সবসময়ই অন্ধ মুয়াজ্জিন নিয়োগ দিতেন।

অনেকক্ষণ হেটে প্রায় ঘর্মাক্ত অবস্থায় পৌঁছলাম মিনারের শেষ প্রান্তে। অপ্রশস্ত জায়গা। পুরনো ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের তৈরি পাঠাতন। নীচের দিকে তাকাতেই পা কাঁপতে লাগল। এখান থেকে পড়লে ইহলীলা সাঙ্গ হবে। বেশিক্ষণ সেখানে না থেকে নিচে নামা শুরু করলাম। কাছাকাছি আসতেই শুনলাম আহমদ সাহেব জোর গলায় সূরা ক্বেরাত পড়ছেন। সেখানে যেতেই আবার বসার ইঙ্গিত করলেন তিনি। এরপর ধরলেন এক দীর্ঘ্য মুনাজাত। আমাদের মাওলানারা যেরকম দোয়া পড়েন। মুনাজাত শেষে আমি তাকে হাদিয়া দিলাম। যদিও তিনি যে পন্থা অবলম্বন করেছেন সেটা আমার মন:পুত হয়নি।

কুতুবিয়া মসজিদ থেকে বের হবার পথে এর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য নকশা আবারও দেখছিলাম মুগ্ধনয়নে। মনে হল এক সময় কতই না সমৃদ্ধ ছিল এই জনপদের মানুষদের জীবনধারা!

বিষয়: বিবিধ

২০৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File