এক প্রাণবন্ত শহর মারাকেশ

লিখেছেন লিখেছেন শহর ইয়ার ২৬ মে, ২০১৩, ০৫:৫৮:২১ সকাল

ইবনে বতুতার দেশে-৩

মারাকেশ শহরের প্রাণকেন্দ্র জামা আল ফিনা। মানে লোকজন জমায়েত হয় যেখানে। এককালে বাদশাহী ফরমান আর প্রকাশ্য বিচারের জন্য উন্মুক্ত এই প্রান্তরে জড়ো হতেন স্থানীয় অধিবাসীরা। ক্রমেই এর রূপান্তর ঘটে একটি ব্যস্ত নগরী হিসাবে। ১০৬২ সালে আল-মোরাভিদ শাসনকর্তা আবু বকর ইবনে উমর এই শহরটির গোড়াপত্তন করেন। শহরটির বয়স প্রায় হাজার বছর । এখনও সগৌরবে ইসলামের স্বর্ণযুগের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।



মারাকেশের পর্যটন কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে জামা আল ফিনাকে ঘিরেই। এই চত্বর ঘিরে আছে সারি সারি ঘোড়ার গাড়ি, ট্যাক্সি আর বাস। ইউরোপীয় স্টাইলে রয়েছে দ্বিতল ট্যুরিষ্ট বাস, যা শহরের আকর্ষনীয় স্থানগুলোতে পর্যটকদের নিয়ে যাচ্ছে। এসব বাসে ২৪ ঘন্টার টিকেটের মূল্য ১৩০ মরোক্কান দিরহাম। ২৪ ঘন্টা বললেও অবশ্য বাস চলাচল করে সকাল ৭টা থেকে সন্ধা ৭টা পর্যন্ত।

জামা আল ফিনার উন্মুক্ত চত্বরে আছে অসংখ্য ফল ব্যবসায়ীর স্টল। মূলত বিভিন্ন আকৃতির কমলাই বেশি বিক্রি হয় এখানে। দোকানীরা কমলার ফ্রেশ জুস বানিয়েও বিক্রি করেন। এখানে একজন ফল ব্যবসায়ীকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার কমলার বিশেষত্ব কী? এসব কমলা তো সব জায়গাতেই পাওয়া যায়।তিনি বললেন এটা বিশ্বের শ্রেষ্ট কমলা।চ্যালেন্জ!! তার সাথে অবশ্য আর কথা বাড়ালাম না।নিজের পণ্য সব বিক্রেতার কাছেই সেরা!



একটু দূরে বাতাসে ভেসে আসছে উচ্চ আওয়াজে ড্রামের শব্দ। সেদিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম ছোটখাটো এক জটলা। কয়েকজন সাপুড়ে খেলা দেখাচ্ছে। অবশ্য এটা কে সাপের খেলা না বলে সাপ দেখাচ্ছে বলাটাই উত্তম। কয়েকটি আধ মরা সাপ নির্বিষভাবে ফনা তুলে দাড়িয়ে আছে। বেহালায় বাজছে অ্যারাবিয়ান মিউজিক। সাপুড়ে চিল্লাচিল্লি করে আরবীতে কি বলছে জানি না। ক্যামেরা বের করে একটি ছবি নিতেই একজন সাপুড়ে তার মাথার টুপি খুলে সেটি মেলে ধরল আমার সামনে। নজরানা দিতে হবে। ১০ দিরহাম দিলাম তার টুপিতে।



আমাদের দেশে সাপুড়েরা অবশ্য সাপের খেলা দেখানোর জন্য কোন নজরানা নেননা। গভীর রাতের অন্ধকারে গ্রাম্য মেঠো পথে চলতে গিয়ে আপনি যদি না দেখে সাপের লেজে পাড়া দেন, তাহলে তাকে যতই দোহাই দেন, সে মানবে না। আপনার পায়ে কামড় দিবেই। কিন্তু যদি বিশেষ একটি তাবিজ আপনার হাতে কিংবা কোমরে বাঁধা থাকে, তাহলে সেই সাপ আপনাকে প্রণাম জানিয়ে মাথা নুইয়ে কিংবা লেজ গুটিয়ে পালাবে।কথিত সেই বিশেষ তাবিজটিই বিক্রি করেন সাপুড়েরা। আর উপরি পাওনা হিসাবে আছে তাদের দলের চৌকষ পকেটমার বাহিনীর কারুকাজ। শুনলাম জামা আল ফিনাতে তাবিজ না থাকলেও আছে সেই পকেটমার বাহিনী ।

দুপুরের তপ্ত রোদের দহনে সাপের খেলা বেশিক্ষণ জমল না। দর্শক সমাগম না হওয়ায় সাপুড়ে চিল্লাচিল্লি বন্ধ করল। আমি কিছুটা দূরে যেতেই আমার পিছনে দেখলাম নানা রঙের কাপড়ে তৈরি অদ্ভুত পোশাক পরে এক পানি বিক্রেতা আসছে। আরবী আর ফ্রেন্চ ভাষায় সে কি বলল কিছুই বুঝলাম না। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্যই এমন রঙ-বেরঙের পোশাক পরিধান। কিন্তু পাত্রে রাখা খোলা পানি তার কাছ থেকে কিনে পান করার মত যথেষ্ট পর্যটক এখনও আছে কীনা বলতে পারবো না। বড়জোর তার সাথে ছবি তুলে কিছু টাকা দেয়া যেতে পারে।



আকর্ষনীয় বেশে সাজানো ঘোড়ার গাড়িগুলো ইউরোপীয়ান পর্যটকদের প্রথম পছন্দ। একাকী অনেক মহিলাকেও দেখলাম ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসতে। অসংখ্য ঘোড়ার গাড়ির আনাগোনা এর চাহিদার প্রমাণ রাখে। কিন্তু প্রদীপের নীচেই অন্ধকার! ঘোড়ার মলমূত্রের দূর্গন্ধে সেখানে নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ইউরোপীয়ান শহরগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয় বলে এসবের কোন ছাপ থাকে না। কিন্তু মারাকেশে মনে হল পানি খুবই দামি একটি জিনিস। তাদের মিউনিসিপলিটি শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে অনেক পিছনে পড়ে আছে।

জামা আল ফিনার শেষপ্রান্তে শুরু হয়েছে একটি মার্কেটের গলি। আমাদের ঢাকার গুলিস্তানের মার্কেটগুলোর মতই। বিভিন্ন ব্রান্ডের কাপড়চোপড় আর জুতো ডিসপ্লে করে রাখা। দাম অনেক বেশি।যদিও ব্রান্ডগুলো আসল না নকল সেটা সন্দেহের উর্ধে নয়। তাই কিছু কিনলাম না সেখান থেকে। বিক্রেতাদের চাপাচাপিও অবশ্য নেই সেখানে যেমনটা আমাদের দেশে আছে। আর ভিক্ষুকদের উৎপাত এখানে সামান্য পরিমানে আছে ভদ্রভাবে। কোন উপায়েই বিদেশীদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জো নেই সেখানে।

মারাকেশ শহরের ব্যবসা বাণিজ্যে মহিলাদের অংশগ্রহন চোখে পড়ার মত।কাপড়, সব্জি, ফল সবকিছুই বিক্রি করছেন তারা। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ল বিভিন্ন রকমের পিঠা, পাউরুটি, স্যান্ডুইচ বান ও ক্রোসন বিক্রি করতে। বাজারে পণ্য বিক্রি করলেও তারা পর্দা প্রথা মেনেই কাজ করছেন।প্রচন্ড গরমেও তাদের আপাদমস্তক আবৃত রেখেই ব্যবসার কাজ করছেন। এমনকি ফুটপাতে নির্দিষ্ট স্থানে নামাজ পড়তেও দেখলাম তাদের।



এখানে খাবারের দোকানগুলোতে সামনের শোকেসে গোশ্ত সাজিয়ে রাখা হয়। বিভিন্ন রকমের কাবাব তাদের পছন্দের তালিকায়। কাষ্টমার যা অর্ডার করবেন সেটা তখনই তৈরি করে দেয়া হবে। এ রকম একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে একটি কাবাবের অর্ডার দিয়েছিলাম। ওয়েটার কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার পরিবেশন করল। কিন্তু একি! খাবার নাকের নীচেই নিতে পারি না। মনে হল কাঁচা মাংসের গন্ধ। অনেক কষ্টে কিছুটা গেলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাতে মনে হল ভেতর থেকে সবকিছু বের হয়ে আসবে। ওয়েটার কে বললাম বিল নিয়ে আসতে। সে মনে করল খাবারটি হয়তো ভাল হয় নাই। তাই আবার নতুন করে নিয়ে আসল।

কিন্তু এবারো একই অবস্থা। তবে যেহেতু সে আমাকে খুশী করার জন্য আরেকবার খাবার নিয়ে এসেছে, তাই না খেয়েই কিছুক্ষণ বসলাম। কোক পান করে সময় কাটালাম। অত:পর তাদের বিল পরিশোধ করে ওয়েটারকে টিপস দিয়ে বের হয়ে এলাম।এবার ফেরার পালা। পাখি উড়ে চলে যায়। পড়ে থাকে পালক। মানুষ দূরে চলে যায়। রয়ে যায় স্মৃতি।

বিষয়: বিবিধ

১৯২৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File