ইবনে বতুতার দেশে
লিখেছেন লিখেছেন শহর ইয়ার ২১ এপ্রিল, ২০১৩, ০৫:৫৫:০৯ বিকাল
দুই.
মারাকেশ এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন ট্যাক্সি লাগবে কিনা। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই ঠিকানা জানতে চাইলেন। আমি বললাম এভিনিউ আবদেল করিম আল খাত্তাব এলাকায় আমিন হোটেল। এখানে যাত্রী দেখেই ট্যাক্সি ড্রাইভারদের হুমড়ি খেয়ে পড়ার মত দৃশ্য চোখে পড়ল না। কয়েকজন লোক খুবই শৃঙ্খলার সাথে সবকিছু ম্যানেজ করছেন।অবশ্য আমি বেরিয়েছি প্রায় সবযাত্রী চলে যাবার পর। একারনেই হয়তোবা বেশিরভাগ ট্যাক্সিচালক সেখানে ছিল না।
এয়ারপোর্ট থেকে শহরে যাবার জন্য ট্যাক্সি ছাড়া বাসের ব্যবস্থাও আছে।তবে দুই বাসের মধ্যবর্তী সময়ে বিস্তর ফারাক। অচেনা জায়গায় ট্যাক্সি নেয়াটাই ঝামেলামুক্ত থাকার সবচেয়ে সহজ উপায়। তবে নতুন লোক পেয়ে ভাড়া কিছুটা বেশি নেয়ার যে প্রবণতা এখানেও তার ব্যত্যয় হল না। প্রায় আড়াইগুণ বেশি ভাড়া গুণতে হল!
বিকেলের অস্তগামী সূর্য তখন অন্ধকারে বিলীন হচ্ছে। ৩০ডিগ্রীর উপরে তাপমাত্রা। মোটামুটি গরম। ট্যাক্সীর উইন্ডো খুলে দিলাম দুইপাশ দিয়েই। রাস্তার দুইপাশে সবুজ আবহ আনার জন্য অনেকগুলো খেজুর গাছ লাগানো। তবে সারি সারি নয়।পুরনো মডেলের অনেক রিকন্ডিশন্ড গাড়ি রাস্তায় চোখে পড়ল। গাড়ি চলছে ডান পাশ দিয়ে। রাস্তার বাতিগুলো ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে। তবে এক পাশে। রাস্তার অন্যপার্শ্ব অন্ধকার।
সারা দিনের ব্যস্ত সময় পার করে শহরের অধিবাসীরা ঘরে ফিরছেন। সাইকেল, মটরসাইকেল, ট্যাক্সি, কার আর বাসে ঘরফেরত যাত্রীদের আনাগোনা। চোখে পড়ার মত বিষয় হল এখানকার মেয়েরা মোটরসাইকেল এ চেপে চলাফেরা করছেন পুরুষের তুলনায় সমান তালে। বেশিরভাগই ভেসপা চালাচ্ছেন।কোন সংকোচ নেই। একটি উদারপন্থী মুসলিম দেশ হিসাবে মেয়েদের নিরাপত্তাবিধানের ক্ষেত্রে তারা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই যে এগিয়ে তা আর না বললেও সমস্যা নেই।
মরক্কোর চতুর্থ বৃহত্তম শহর মারাকেশ। দীর্ঘকাল ছিল রাজধানী শহর। সেটা অবশ্য ইতিহাসের পাতায়।১০৬২ সালে বারবার উপজাতির নেতা আবু বকর ইবনে উমর এই শহরের গোড়াপত্তন করেন। ইতিহাসে উত্তর আফ্রিকার যে এলাকাটি মাগরিব নামে পরিচিত মারাকেশ ছিল তার একটি প্রধান শহর ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র। সে সময়ে অসংখ্য মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মিত হয় যার অনেকগুলো এখনও বর্তমান। মারাকেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় এক মিলিয়ন।
ট্যাক্সি এসে থামল এভিনিউ আব্দেল করিম আল খাত্তাব এলাকায়। বিশাল উঁচু বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা একটি বিল্ডিংয়ের সামনে। বেশ সুরক্ষিত । দেখে মনে হল পুরনো আমলের কোন এক দুর্গ । এখনকার সময়ে বেশিরভাগ এলাকায় সেগুলোকে মিউজিয়াম বা জাদুঘরে রূপান্ত্রর করা হয়েছে। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কিসের বিল্ডিং? সে বলল এটাই আপনার হোটেল।কোন প্রকার রাখঢাক না করেই বখশিশ চাইল সে। বললাম আমার কাছে তো চেঞ্জ নেই। কোন সমস্যা নেই। এখানে চেঞ্জ পাওয়া যাবে। আমার কাছে দিন। সে বলল। আমি বিশ ব্রিটিশ মুদ্রা দিলাম বের করে। সে চেঞ্জ নিয়ে আসল। সেখান থেকে বিশ দিরহাম দিলাম বকশিশ হিসাবে।
হোটেলের বাইরের উঁচু প্রাচিরের মাঝখানে প্রবেশ পথ। প্রথম ফটকের পর ভিতরে আরেকটি গেট। দুই জায়গাতেই প্রহরী দন্ডায়মান। বেশ রাজকীয় কারবার। হোটেলের সামনে অবশ্য উদ্যানের মত জায়গায় বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ লাগানো। দেখতে বেশ মনোরম। নারিকেলের শক্ত আঁশ ও কঠিন খোল ভাঙ্গতে পারলে যেমন সুমিষ্ট খাদ্য ও পানীয় পাওয়া যায়, এখানকার গেট ও প্রহরীদের পেরিয়ে ভিতরের নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী দেখেও সে রকম অভিভূত হতে হয়।
আমিন হোটেলের রিশিপশনিষ্ট আমাকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ডশেকের জন্য। জিজ্ঞেস করলেন আরবী কথা বলতে পারি কিনা।আমি না বলতেই ভদ্রলোক বললেন সে কিহে। মুসলমান অথচ আরবী ভাষা জানো না। আমি বললাম আরবী পড়তে পারি কিন্তু কিছু বুঝি না। তবে এখানে দেখলাম অনেকেই ইংরেজী বলতে পারে না।তিনি বললেন এটা তো আমাদের মাতৃভাষা নয়। আমাদের ও আরবী মাতৃভাষা নয় একথা আমি বলতেই হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি। নো প্রবলেম বলেই পাসপোর্ট চেয়ে নিলেন ফটোকপি করার জন্য।
এই হোটেলটি মারাকেশের প্রধান সড়কে অবস্থিত। কাছেই বাস স্টপেজ। শহরের প্রাণকেন্দ্র বা সিটি সেন্টারে যাওয়া আসার জন্য তাই তেমন কোন সমস্যা নেই। আর একাকী চলাফেরায় হারিয়ে যাবারও ভয় নেই। অনলাইনে বুকিংয়ের সময় হোটেলের রিভিউ দেখেছিলাম। ভালমন্দ দুইরকমের মন্তব্যই আছে। একজন অবস্থানকারী লিখেছেন লোকেশনের দিক দিয়ে ভাল। আরেকজন মন্তব্য করেছেন ষ্টাফদের বাজে আচরনের বিষয়ে।
আমার রুম পড়েছে তিনতলায়। বারান্দা ও বাথরুমসহ বেশ বড় একটি রুম। বারান্দা থেকে নীচের সুইমিংপুল দেখা যায়।চাবি দিয়ে দরজা খুলছি এই অবস্থায় দুই তরুন এগিয়ে এলেন। একজন আফ্রিকান, আরেকজন ইউরোপীয়ান। তাদের সাথে একজন এশিয়ানও আছে, শ্রীলংকান। আমাকে দেখে হয়তোবা মনে করেছিল আমিও এরকমই হবো। সকলেই খেলোয়াড়। বলল পরিচিত হতে এলাম। পরিচয়ের পালা শেষ করে বললাম, আবার দেখা হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য আবার তাদের সাথে দেখা হল।এবার তিনজনই এসেছে হোটেলের সুইমিংপুলে। তাদের সাথে আমি যোগ দেয়াতে চারজন। অনেক সময় নিয়ে সাঁতারের পোষাক পরল তারা।মাথায় টুপি ও চোখে গ্লাস লাগিয়ে নামল পানিতে। বিশাল সুইমিংপুলের একপাশ থেকে ধপাশ করে পানিতে পড়ার শব্দ এল। জলহস্তী হঠাৎ করে পানিতে নামলে যে রকম শব্দ হয়। চেয়ে দেখি ইউরোপীয়ান দম্পতি তড়িঘড়ি করে শেষ করছেন তাদের সুইমিংপর্ব । হয়তো তারা অনেকক্ষণ ছিলেন সেখানে।
সাঁতার কাটলে ক্ষুধা লাগে।কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা টের পেলাম। তাই রুমে ফিরে শাওয়ার করে নিলাম। হোটেলের আছে নিজস্ব রেস্টুরেন্ট। তবে সেখানে গেলে বাহিরের কিছুই আর দেখা হবে না এটা ভেবে বেরিয়ে গেলাম মেইন রোডে।মিনিট দুয়েক যেতেই পেলাম বেশ সুন্দর একটি রেস্টুরেন্ট । সাইন বোর্ড আর খাবারের মেনু সবই আরবী আর ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা। কিছুই বুঝার উপায় নেই। ছবি দেখে একটি মেনু অর্ডার দিলাম। ল্যাম্ব চপ বা বিশেষ আকারে কেটে বানানো ভেড়ার গোশত, সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ, সামান্য ভাত ও তাতে একটু সস, সালাদ হিসাবে একটু লেটুস পাতা এবং স্লাইস করে কাটা কমলা লেবু দিয়ে সাজানো ডিশ।সাথে বন রুটি এবং জয়তুনের আচার। একটি কোকের বোতল ও ছিল।
মোটামুটি পরিচিত খাবার। কিন্তু যতঠুকু উপাদেয় হবে ভেবেছিলাম ঠিক সে রকম কিছু ছিল না। কারন মরোক্কান ফ্লেভার। তারা খাবারে ঝাল খায় বলে মনে হল না। আর আমাদের ঝাল খেয়ে অভ্যাস। তাছাড়া গোশত যে কায়দায় গ্রীল করা হয়েছে সেটা মসলার কারনে হোক বা কম পোড়ানোর কারনে হোক একটা আঁশটে গন্ধ এসে নাকে লাগল। তবুও কষ্ট করে হলেও সেটা গলাধঃকরণ করলাম।সদাহাস্য মুখে ওয়েটার জিজ্ঞেস করল কেমন ছিল আমাদের খাবার? ভাল কিছু বলাটাই সাধারণ ভদ্রতা।মাথা নেড়ে বললাম, ডেলিশিয়াস। খুবই ভাল।
বিষয়: বিবিধ
১৩১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন