রাজনীতির চেনাশোনা শব্দগুলো
লিখেছেন লিখেছেন যুমার৫৩ ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৯:১৬:৪৩ রাত
রাজনীতির জগতে আমরা প্রতিনিয়ত কিছু কথা শুনে থাকি, যে কথাগুলো কীভাবে চালু হলো তা হয়তো আমরা জানিনা। এমন কিছু শব্দের প্রকৃত অর্থ নিয়েই আজ আমার এই লেখা।
১। গোয়েবলসীয় প্রচারণা
ইয়োসেফ গ্যেবলস (Joseph Goebbels) ছিলেন নাত্সী জার্মানির প্রচারণামন্ত্রী এবং হিটলারের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। তীব্র বাগ্মীতা দিয়ে তিনি মানুষের মনে উন্মাদনা তৈরী করতে পারতেন। মিডিয়ার ওপর তার আধিপত্যকে তিনি নাত্সী মতাদর্শ প্রচারে অপ্রতিরোধ্যভাবে ব্যবহার করতেন। কিনতু বের্লিনের পতন যখন সুনিশ্চিত হয়ে ওঠে তখন নিজের ছয়-ছয়টি বাচ্চাকে হত্যার পর নিজের স্ত্রীসহ আত্মহত্যা করেন।
যখন কোন মিথ্যাকে ব্যাপক, অব্যাহত এবং সংঘবদ্ধভাবে প্রচার করা হয়, তখন একে গোয়েবলসীয় প্রচারণা বলা হয়ে থাকে।
২। বামপন্থী
ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে র্যাডিক্যাল (আমূল পরিবর্তনবাদী), রাজতন্ত্রবিরোধী এবং পুরোহিততন্ত্রবিরোধী সেকুলার দলগুলো পার্লামেনটে প্রেসিডেনটের বামদিকের আসনগুলোতে বসতো। অন্যদিকে সাবেক রাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভুতিশীল, রক্ষণশীল ও ধর্মঘেঁষা দলগুলো বসতো ডানদিকে।
এরপর থেকে বামপন্থী শব্দটা ছড়িয়ে পড়ে। সমাজতন্ত্রী, সাম্যবাদী, সেকুলার, মোল্লাবিরোধী, শ্রমিকবান্ধব, বিপ্লবী - এদের সকলকে একবাক্যে বামপন্থী বলে ডাকা শুরু হয়।
৩। আঁতাত
বাংলাদেশে শব্দটা দালালি করা অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিনতু আসলে এটা খারাপ কোন শব্দ নয়। এটা ফরাসি ভাষার শব্দ (Entente)। এর অর্থ হলো 'কূটনৈতিক বোঝাপড়া' - যা দুই বা ততোধিক দেশের মধ্য হতে পারে।
৪। গডফাদার
শব্দটাকে আমরা বাংলাদেশীরা একেবারে পচিয়ে ফেলেছি - শুনলেই মনে হয় যেন সমাজবিরোধী সন্ত্রাসী। আসলে শব্দটা খৃষ্টধর্মের সাথে সম্পর্কিত। একটা এতিম খৃষ্টান বাচ্চাকে যিনি ধর্মের জ্ঞান দান করেন, তাকে লালনপালন করে ভালো খৃষ্টান হিসেবে গড়ে তোলেন, তিনিই হলেন ঐ বাচ্চার গডফাদার।
৫। মৌলবাদী
যেসব খৃষ্টান অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে মনে করেন যে, বাইবেল একেবারে নির্ভুল এবং তথাকথিত আধুনিকতাবাদীরা বেশী উদার হতে গিয়ে ধর্মকে হালকা করে ফেলেছে - তাদেরকে মৌলবাদী (Fundamentalist) বলা হয়। শব্দটি সূচনা করেন ব্যাপটিস্ট সম্পাদক কারটিস লি লওস (১৯২০ সালে) - যখন তিনি বলেন যে, "যেসব খৃষ্টান বুনিয়াদী বিশ্বাস (Fundamentals) রক্ষার স্বার্থে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে চায়...."। এভাবেই ঐ শব্দটির জন্ম হলো। এখন ইসলাম বা অন্যন্য ধর্মের ক্ষেত্রেও ঐ একই মানসিকতাসম্পন্ন লোকেদেরকে মিডিয়াতে ঐ নামেই ডাকা হয়।
৬। হরতাল
গুজরাতি শব্দ। দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, দফতরাদি বন্ধ রেখে অহিংস উপায়ে প্রতিবাদ। বৃটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনি গুজরাতের লোক ছিলেন।
৭। পঞ্চম বাহিনী
অনেকদিন আগে ঢাকার দেয়ালগুলোতে একটি দলের পোস্টারে লেখা থাকতো "পঞ্চম বাহিনীকে প্রতিহত করুন"। পঞ্চম বাহিনী বলতে মূলতঃ বাইরের শত্রুর সাথে গোপনে হাত মেলানো মীরজাফর ধরণের দালালদের বোঝানো হয়ে থাকে। কিনতু সূচনাতে শব্দটার কোন খারাপ অর্থ ছিলোনা। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় জাতীয়তাবাদীরা চারটি কলাম (বাহিনী) নিয়ে রাজধানীর কাছে পৌঁছে যায়। তারা প্রচারণা চলায় যে, রাজধানীর ভেতরে তাদের সমর্থকেরা আরো একটি বাহিনী তৈরী করে ফেলেছে, যাদের কাজ হলো ভেতর থেকে তাদেরকে সাহায্য করা এবং ক্ষমতাসীন রিপাবলিকানদের দুর্বল করে দেয়া। যারা এভাবে ভেতরে অবস্থান করে বাইরের শক্তিকে সাহায্য করে তারাই পঞ্চম বাহিনী (Fifth column).
বাংলাদেশে এরকম পঞ্চম বাহিনী আছে বৈকি, যাদের কাজ প্রতিবেশী আধিপত্যবাদী শক্তিকে প্রকাশ্য বা গোপনে সেবা দিয়ে যাওয়া।
৮। মধ্যযুগীয় বর্বরতা
রোমের পতনের পর এবং রিনেসাঁ - এর আগে, এই মধ্যবর্তী সময়টাকে ইউরোপের "মধ্যযুগ" (Medieval age) বলা হয়। এসময় অশিক্ষা - কুশিক্ষা, যুদ্ধবিগ্রহ, পুরোহিতদের দাপট, উগ্র ধর্মান্ধতা, নিষ্ঠুর রাজন্যবর্গ কিংবা সামন্তপ্রভূদের শাসন, ব্যাপক মানবাধিকার লংঘন ইত্যাদি ইউরোপকে গ্রাস করে ফেলেছিলো। ডাইনি শিকারের নামে নারীহত্যা, ভিন্নমতের জন্য বিজ্ঞানীদের আগুনে পুড়িয়ে মারাসহ নানা রকম বর্বরতা এসময়ে হয়েছে।
অথচ ঐ সময় শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সভ্যতায় মুসলিমদের ছিলো স্বর্ণযুগ - তার সাক্ষ্য এখনও পাওয়া যায় গ্রানাদা, ইসতানবুল, বাগদাদ কিংবা দিল্লীতে। তাই যারা "মধ্যযুগীয় বর্বরতা" কথাটা মুসলিমদের ওপর আরোপ করেন, তারা হয় অজ্ঞ না হয় জ্ঞানপাপী।
সূত্র: ব্যক্তিগত পড়াশোনা, ইন্টারনেট ইত্যাদি।
বিষয়: বিবিধ
১৬৪৭ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মধ্যযুগ বলতে আসলে ইউরোপিয় মধ্য যুগ কেই বুঝায়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন