অনুবাদ গল্প -- "কুড়ি বছর পর"

লিখেছেন লিখেছেন যুমার৫৩ ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৯:৩৭:৫৬ সকাল

কুড়ি বছর পর

লেখকঃ ও'হেনরি

অনুবাদঃ যুমার৫৩



হেঁটে হেঁটে টহল দেয়া পুলিশম্যানটা খুব ভাব নিয়ে আসা-যাওয়া করছিলেন। তাঁর এই ভাব নেয়াটা অবশ্যি নির্ভেজাল স্বভাবজাত, মোটেও লোক-দেখানো নয়। আর দেখবেই বা কে? দশটাও বাজেনি, কিন্তু হিমেল হাওয়া আর বৃষ্টি এসে ওই এভিনিউটা থেকে লোকজনকে একদম বিদেয় করে দিয়েছে।

জটিল আর শৈল্পিক ছন্দে হাতের ছড়িটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে, পাশের প্রতিটি বাড়ির দুয়ারের পানে সতর্ক চাহনি ফেলতে ফেলতে আর শান্ত হয়ে আসা এই রাজপথের এমাথা-ওমাথা নজর বোলাতে বোলাতে আমাদের এই বলিষ্ঠদেহী, জাঁকালো অফিসারটি তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। সব মিলিয়ে তিনি যেন "শান্তির অভিভাবকের" এক নিঁখুত প্রতিমূর্তি। দোকানপাট প্রায় সবই বন্ধ; শুধু একটা-দু'টো বিড়ি-সিগ্রেটের দোকানেই হয়তো মাঝে-সাঝে একটু আলো দেখা যাচ্ছিলো।

একটা ব্লকের মাঝামাঝি এসে পুলিশকর্মীটি হঠাত তাঁর গতি কমিয়ে দিলেন। ওখানে, কলকব্জা বিক্রির একটা অন্ধকার দোকানের দুয়ারে একটা লোক ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ছিলো। মুখে তার না জ্বালানো একটা চুরুট।

"কোনো সমস্যা নেই অফিসার" পুলিশটি তার দিকে এগিয়ে গেলে লোকটি তাড়াতাড়ি আশ্বস্ত করে বললো, "আমি সির্ফ এক দোস্তের জন্যে এখানে অপেক্ষা করছি। শুনলে আপনি হয়তো হাসবেন, কিন্তু বিশ বছর - হ্যাঁ বিশটি বছর আগে সেই দোস্তকে কথা দিয়েছিলাম যে ঠিক এইখানটায় আমি বিশ বছর পর তার সাথে আবার দেখা করবো। এখানটায় "বিগ জো ব্র্যাডি'স রেসটুরেনট" বলে একটা খাবারের দোকান ছিলোনা?

"ছিলো", বললেন পুলিশম্যান, "পাঁচ বছর আগে ওটা ভেঙে ফেলা হয়েছে।"

দীপশলাকা জ্বেলে চুরুট ধরালো লোকটা। সেই আলোতে তার ফ্যাকাসে চার-কোনাচে মুখ, তীক্ষ্ণ দুটো চোখ আর ভ্রুর নিচের সাদা কাটা দাগটা দেখা যাচ্ছিলো। তার গলায় বাঁধা রুমালটার জন্য যে স্কার্ফপিন - সেটা একটা বড় হীরক দিয়ে বাঁধানো। হিরেটা অবশ্য ঠিকঠাক মতো বসানো হয়নি।

"হ্যাঁ, বিশটি বছর আগে, ঠিক এই তারিখের রাতে...." বলছিলো লোকটা, "আমি এখানে ডিনার করেছিলাম। সঙ্গে ছিলো আমার জানি-দোস্ত জিমি ওয়েলস। ও ছিলো এই দুনিয়ার সবচে' ভালো লোক। ঠিক যেন দুটো ভাইয়ের মতো আমরা নিউ ইয়র্কে বড় হয়েছি। ও বলতো নিউ ইয়র্ক হলো দুনিয়াতে একমাত্র ভালো জায়গা। তো, আমরা দু'জনে ওয়াদা করেছিলাম, বিশ সাল বাদে, ঠিক একই তারিখ ও সময়ে, আমরা ঠিক এই জায়গায় আবার মিলিত হবো। ততদিনে আমরা আমীর হই কি ফকির হই, এই শহরেই থাকি বা সহস্র যোজন দূরে - এখানেই এসে মিলবো আমরা, তকদীর আমদের জীবনকে যেভাবেই গড়ে তুলুক না কেন।

"ইনটারেসটিঙ," বললেন পুলিশকর্তা, "দুই দেখার মাঝে কুড়িটি বছর বড়ই লম্বা সময়। তা শহরত্যাগের পর আপনার বন্ধুর সাথে আর কোন যোগাযোগ করেননি?"

"হ্যাঁ, প্রথমদিকে চিঠি বিনিময় হতো," বললো লোকটা, "কিন্তু তার বছর দুয়েক বাদে আমরা যোগাযোগ হারিয়ে ফেলি। বোঝেন তো, পশ্চিম তো পশ্চিমই - বিরাট ব্যাপারস্যাপার। পশ্চিমে গিয়ে জীবিকার খোঁজে আমি নানান জায়গাতে দাবড়িয়ে বেড়াই। কিন্তু আমি ঠিক জানি যে, আমার দোস্ত জিমি যদি এতোদিনে বেঁচে থাকে তাহলে সে আলবত আমার সঙ্গে এখানে এসে দেখা করবে। আমার দোস্ত কখোনো তার ওয়াদা ভাঙবেনা, কখোনো তার ওয়াদা ভুলবেনা। এই দোকানের দরজার সামনে দাঁড়ানোর জন্যে আমি হাযার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। কিন্তু এটা ব্যাপারই না, যদি আমি আমার পুরোনো বন্ধুর দেখা পাই।"

লোকটা পকেট থেকে সুন্দর একটা ঘড়ি বের করলো, ঘড়ির ঢাকনায় হীরক বসানো। "দশটা বাজতে তিন মিনিট" বললো সে, "কুড়ি সাল আগে ঠিক দশটাতেই এই রেস্তোঁরার দরজায় আমরা একে অন্যকে বিদায় জানিয়েছিলাম।"

"পশ্চিমে আয়-উন্নতি ভালোই করেছিলেন, তাই না?" শুধালেন পুলিশটি।

"তা আর বলতে? বেচারা জিমি বোধহয় আমার অর্ধেকও কামায়নি। ও একটু ঢিমেতালা কিসিমের লোক, কিন্তু মানুষটা খাঁটি। বুঝলেন, পশ্চিমে অনেক ধারালো মেধার লোকের সাথে লড়ে আমি আমার পয়সার স্তুপ বানিয়েছি। আসলে কি জানেন, এই নিউ ইয়র্ক শহরটা মানুষকে আলসে বানিয়ে গর্তে বসিয়ে রাখে। আর অন্যদিকে পশ্চিমের ধারালো তলোয়ার মানুষকে লড়াকু করে গড়ে তোলে।"

পুলিশ কনস্টেবল ছড়ি ঘুরিয়ে দু'কদম এগোলেন। "ওয়েল, আমি আমার কাজে চললাম। আশা করি আপনার বন্ধু সময় মতোই এসে যাবেন। তো কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন আপনি ?"

"অন্ততঃ আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করবো। জিমি যদি বেঁচে থাকে তাহলে ঐ সময়ের মধ্যেই সে আসবে। বিদায়, অফিসার।"

"গুড নাইট", বললেন পুলিশম্যান, আর আগের মতোই ভাব নিয়ে, আগের মতোই সতর্ক দৃষ্টি মেলে টহল দিতে দিতে এগিয়ে চললেন।

এবার গুঁড়িগুঁড়ি শীতল বৃষ্টি শুরু হলো, আর বাতাসটাও অনিশ্চিত দমকা থেকে এখন টানা বইতে শুরু করলো। দু'চারজন পথচারী যা ছিলো, তারাও মুখ বুঁজে, জেবে হাত ঢুকিয়ে, কলার উঁচু করে তুলে দ্রুত সরে পড়ছিলো। আর দোকানের সামনে দাঁড়ানো, উদ্ভট অনিশ্চিত এক প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে হাযার মাইল পেরিয়ে ছোটবেলার বন্ধুর সাথে দেখা করতে আসা আমাদের সেই পশ্চিমি লোকটা চুরুট ধরিয়ে পথ চেয়ে রইলো।

মিনিট বিশেক পেরিয়েছে। এমন সময় লম্বা ওভারকোট পরা, কান পর্যন্ত কলার তুলে দেয়া একটা দীর্ঘকায় লোক রাস্তা পেরিয়ে সোজা ঐ অপেক্ষমান লোকটির দিকে এগিয়ে এলো।

"বব, তুই নাকি?" দ্বিধান্বিত গলায় শুধালো নতুন আগন্তুক।

"জিমি ওয়েলস? তুই???" চিতকার করে উঠলো পশ্চিম থেকে আসা লোকটা।

তারা দু'জন দু'জনের হাত চেপে ধরলো। "আমার হৃদয় ধন্য হোক। বব, তুই ই তো!! আমি জানতাম তুই এখানে আসবিই, যদি বেঁচে থাকিস। কুড়ি বছর! ওহ, কী লম্বা সময়! পুরোনো রেস্তোরাঁটা নেইরে! থাকলে সেখানেই আবার একসাথে ডিনার করতে পারতাম। তা পশ্চিম তোকে কেমন খাতির করলো? ছিলি কেমন ?"

"ফাটাফাটি !", বললে বব, "যা চেয়েছি, পশ্চিম আমাকে তা সবই দিয়েছে। কিন্তু তুই যে অনেক পাল্টে গেছিস! এতটা লম্বা ছিলি নাকি তুই?"

"হ্যাঁ.... মানে আমি পরে আরো একটু লম্বায় বেড়েছিলাম।"

"তা নিউ ইয়র্কে কেমন চলছে তোর, জিমি?" শুধায় পশ্চিমের লোকটি।

"এই মোটামুটি। সরকারি একটা চাকুরি করছি। চল বব, তোকে আমার চেনা একটা জায়গায় নিয়ে যাই, কাছেই জায়গাটা। প্রাণ খুলে আমরা পুরোনো দিনের কথা বলবো।"

দুই বন্ধু হাতে হাত রেখে চললো। সাফল্যের গর্বে বুক ফুলিয়ে পশ্চিমি লোকটা তার ক্যারিয়ারের কাহিনী শোনাচ্ছিলো। অন্য লোকটা - ওভারকোটে ডুবে থেকে - শুনে যাচ্ছিলো আগ্রহ নিয়ে।

রাস্তার মোড়ে ছিলো ইলেকট্রিক আলোতে ঝলমল করা একটা ওষুধ-পত্রের দোকান। এই জোরালো আলোতে যখন তারা দাঁড়ালো, তখনই দু'জন দু'জনের মুখের দিকে পূর্ণভাবে দৃষ্টিপাত করলো।

পশ্চিমের লোকটা ঝট করে তার হাত ছাড়িয়ে নিলো। ধারালো গলায় বললো...

"কে আপনি? আপনি তো আমার বন্ধু জিমি ওয়েলস নন। কুড়ি সাল লম্বা সময়, কিন্তু এতোটা লম্বা নয় যে একটা মানুষের রোমানদের মতো খাড়া নাক সেই সময়ের মধ্যে বোঁচা নাক হয়ে যাবে!!!"

"ঠিক কথা, কিন্তু কুড়ি বছরে একটা মানুষ ভালো থেকে অনেক খারাপ হয়ে যেতে পারে, তাইনা ? ইউ আর আনডার অ্যারেস্ট মিস্টার "সিলকি" বব। শিকাগো থেকে আমরা বার্তা পেয়েছি যে তুমি এখানে এসেছো, আর তারা তোমার সাথে একটু বাতচিত করতে চায়। খুব চুপিচুপি কেটে পড়েছিলে, তাই না ? ও হ্যাঁ, থানায় নেয়ার আগে তোমার হাতে একটা চিঠি দিতে চাই। ওটা তুমি এই জানালায় দাঁড়িয়ে পড়তে পারো। চিঠিটা লিখেছে কনস্টেবল ওয়েলস, যে এই রাস্তায় একটু আগে পাহারা দিচ্ছিলো।

পশ্চিমের লোকটা দৃঢ় হাতেই খুললো ভাঁজ করা কাগজটা, কিন্তু পুরোটা পড়া শেষে তার হাত যেন একটু কেঁপে উঠলো। চিঠিটা ছোট।

" বব, আমি সময়মতোই সেখানে পৌঁছেছিলাম। যখন তুই ম্যাচ জ্বালিয়ে চুরুট ধরালি, তখন আমি দেখলাম তুইই সেই লোক যার নামে শিকাগো পুলিশ "ধরিয়ে দিন" ইশতাহার জারি করেছে। কিন্তু তোকে আমি নিজের হাতে গিরেফতার করতে পারিনি রে। তাই থানায় পৌঁছে সাদা পোশাকের একজনকে দিয়ে কাজটা করালাম।

ইতি,

তোর দোস্ত

জিমি ওয়েলস"

বিষয়: সাহিত্য

১৮০৭ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

359924
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সকাল ১০:১৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০৯:০৮
298357
যুমার৫৩ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
359939
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ দুপুর ১২:০৯
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : খুব খারাপ লাগল শেষটা। মিলনটা ভাল হলনা।
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০৯:১৩
298358
যুমার৫৩ লিখেছেন : ও হেনরি'র গল্পগুলোর শেষ প্রান্ত সবসময়ই এমন বিস্ময়কর হয়ে থাকে। একদম শেষে এসে পাঠক হতবুদ্ধি হয়ে যায়। আপনি হয়তো ওনার বিখ্যাত গল্প 'দি গিফট অফ দি মেজাই' পড়েছেন। আমাদের আমলে গল্পটা উচ্চমাধ্যমিক ইংরেজি বইতে ছিলো। মনে আছে শেষটা কেমন অপ্রত্যাশিত হয়েছিলো ?

ধন্যবাদ
359953
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ দুপুর ০৩:২৫
আফরা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ ।
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০৯:১৩
298359
যুমার৫৩ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
359969
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০৯:১৫
শেখের পোলা লিখেছেন : এটি একজন পুলিশের কর্তব্যের কথা জানিয়ে গেল৷৷ আপনাকে ধন্যবাদ৷

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File