ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছে বামদলগুলো
লিখেছেন লিখেছেন আমলক ২৮ মার্চ, ২০১৩, ০২:৫৭:৩৬ দুপুর
http://www.natunbarta.com/politics/2013/03/28/18456/83b5fa79a4563406cbb787f53affe94a
সাগর আনোয়ার
নতুন বার্তা ডটকম
ঢাকা: স্বাধীনতার পর এই প্রথম ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছে বামদলগুলো। আর এ জন্য তাদের সওয়ার হতে হয়েছে দেশের প্রধান বড় দল আওয়ামী লীগের ঘাড়ে। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে শতাধিক ভোট পেয়েছেন এমন নেতারাও মহাজোটের শরিক হয়ে এখন মন্ত্রী, এমপিসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে অবস্থান করছেন। নেপথ্য থেকে তারা নিয়ন্ত্রণ করছেন সরকারি ও রাজনৈতিক অনেক সিদ্ধান্ত।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বামদলগুলো বিকল্প শক্তি হতে চাইছে।
জাসদের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নূরুল আম্বিয়া এ সম্পর্কে বলেন, “একটা নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে মহাজোট গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অন্যতম। এই বিচার শেষ হলে আমরা নতুন করে চিন্তা করব।” তিনি আরো বলেন, “শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ আমাদের একটা বার্তা দিয়েছে, জনগণ বিকল্প একটা রাজনৈতিক শক্তি চাইছে।”
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন নতুন বার্তা ডটকমকে বলেন, “দল গঠিত হয় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। আমরাও এর বাইরে নই। আমরা শ্রমিকশ্রেণীর শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করছি। একটি বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ১৪ দলীয় জোট করেছি।”
বাসদের কেন্দ্রীয় সদস্য বজলুর রশিদ ফিরোজ নতুন বার্তা ডটকমকে বলেন, “৪২ বছর ধরে শাসকশ্রেণীর ব্যর্থতার কারণেই গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যেহেতু তরুণদের দাবি মেনে নেয়নি, ধাপে ধাপে এই আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধেও চলে যেতে পারে। তখন তরুণরা সিদ্ধান্ত নেবে কারা ক্ষমতায় থাকবে, আর কারা ক্ষমতায় যাবে।”
এর আগে স্বাধীনতার পরপর বামদলগুলোর জাগরণের একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। তাদের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-এর স্লোগান তখন তরুণদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছিল। এমনকি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার তৎপরতা দেখা গেছে তাদের মধ্যে।ওই সময় সরকারের সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্কের কারণে পঁচাত্তর পূর্ববর্তী সময়ে বামদলের বহু নেতাকর্মী খুন হন। তখনকার সরকারের হাতে তাদের ৩০ হাজার কর্মী খুন হয়েছেন বলে বামদলগুলোর অভিযোগ।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে একে একে ভেঙে যেতে থাকে বামদলগুলো। চীনপন্থী-মস্কোপন্থী ভাঙনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত নেতৃত্ব ও আদর্শিক কারণেও দলগুলোর মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। দলের নামকরণের ক্ষেত্রে ব্র্যাকেটবন্দী হতে থাকেন শীর্ষ নেতা। যেমন, ন্যাপ (মোজাফ্ফর), ন্যাপ (ভাসানী), কমিউনিস্ট পার্টি (তোয়াহা), জাসদ (রব), জাসদ (ইনু), বাসদ (খালেক), বাসদ (মাহবুব), ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন) এমন নামে খণ্ড-বিখণ্ড হয় বামদলগুলো। ফলে জাতীয় নির্বাচনে দেশজুড়ে প্রার্থী দেয়ার সামর্থ্য হারায় তারা।
দেশের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বামদলগুলো বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রার্থী দিলেও তার ফলাফল তাদের জন্য কখনোই সুখকর হয়নি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বামদলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবার এই এরশাদের শাসনামলেই বামদলগুলো দু-দুবার নির্বাচনে অংশ নেয় এবং তাতে তারা বেশ সফল হয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (রব) আ স ম আবদুর রব ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন।
স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত নয়টি নির্বাচনী ফল পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে বামদলগুলো পায় চারটি আসন। এর মধ্যে জাসদ একটি, ন্যাপ (মোজাফ্ফর) একটি, ন্যাপ (ভাসানী) একটি এবং বাংলাদেশ জাতীয় লীগ পায় একটি আসন।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সব কটি দল বিলুপ্ত করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। সিপিবির একাংশ বাকশালে যোগ দেয় এবং অন্য অংশ আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন চালাতে থাকে।
১৯৭৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় বামদলগুলো পেয়েছিল নয়টি আসন। বর্তমান মন্ত্রিসভার দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সে সময় একতা পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বামদলের একাংশ তাদের দল বিলুপ্ত করে জিয়াউর রহমানের বিএনপিতেও যোগ দিয়েছিল।
সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের অধীনে ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নেয় বামদলগুলো। এরশাদের সঙ্গে সমঝোতায় এ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি ছয়টি, ন্যাপ পাঁচটি এবং জাসদ চারটি আসন পায়। ওই সময় বামদলগুলো এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরে কাজী জাফর আহমেদ ও আনোয়ার জাহিদের নেতৃত্বে বামদলগুলোর একাংশ যোগ দেয় জাতীয় পার্টিতে। এই নির্বাচনে বিএনপিসহ পাঁচ দল অংশ নেয়নি।
১৯৮৮ সালে ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে দেশের সব দল যখন বর্জনের ডাক দেয়, আ স ম রব ও জাসদ তখন এরশাদের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে। এই নির্বাচনে জাসদ (রব) ১৭টি আসন পায়।স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দলের ১৬ জন সংসদ সদস্য নিয়ে ৩৩ জনের সম্মিলিত বিরোধী দলের নেতা হন আ স ম আব্দুর রব। সেবার ক্ষমতার কিছুটা উত্তাপ বামদলগুলো ভোগ করে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বামদলগুলোতে আবার ভাঙন ঘটে।কিছু নেতা গণতান্ত্রিক দলে যোগ দেন। অন্যরা বিভিন্ন দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট বাঁধে।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে কোনো বামদল অংশ নেয়নি। আর ১৯৯৬ সালের জুনে সপ্তম এবং ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে কোনো আসনই পায়নি বামদলগুলো।
১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয় ব্যর্থতা, দলীয় বিভক্তি আর বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বাম রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, তখন ত্রাতা হয়ে আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচনে হাসানুল হক ইনুর দল জাসদ মশাল প্রতীক নিয়ে ৭৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটি আসনেও জয়ী হতে পারেনি। সেই জাসদ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে সাতটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটি আসন পায়। মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার সাড়ে তিন বছর পর ইনুকে বানানো হয় তথ্যমন্ত্রী। একইভাবে রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি কাস্তে প্রতীকে ২০০১ সালের নির্বাচনে ৩২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোট পেয়েছিল মাত্র দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। তারা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মহাজোটের শরিক হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুটি আসন লাভ করে।
মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মেননকে বানানো হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল চেয়ার প্রতীকে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোট পায় মাত্র ৯৭২টি। তিনি নিজে পান মাত্র ৩১০ ভোট। আওয়ামী লীগের শরিক হওয়ার সুবাদে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও টেকনোক্র্যাট কোটায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব পান দিলীপ বড়ুয়া।
আওয়ামী লীগের আরেক শরিক গণতন্ত্রী পার্টি ২০০১ সালের নির্বাচনে পায়রা প্রতীকে ১১টি আসনে অংশ নিয়ে ভোট পায় মাত্র ৩১৯০টি, যা ছিল মোট ভোটের দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নুরুল ইসলাম নির্বাচনের আগে খুন হওয়ায় তার স্ত্রী কবি রুবি রহমান সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একইভাবে সংরক্ষিত আসনে মহিলা সংসদ সদস্য পদ লাভ করেন ন্যাপের আমেনা বেগম।
স্বাধীনতার পর বামদলগুলো বর্তমানে সবচেয়ে ভালো সময় পার করছে। আর তাতে দলগুলোর মধ্যে ভবিষ্যতে এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার গুঞ্জনও ডালপালা মেলছে। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ এই গুঞ্জনে সঙ্গত করছে। তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির পুরোধা হতে পারে বামদলগুলো।
নতুন বার্তা/ সাআ/মোআ
বিষয়: বিবিধ
১০৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন