দূরের নক্ষত্র (মা কে নিয়ে গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন ধ্রুব নীল ১৩ মার্চ, ২০১৩, ০৫:৫৪:৪৪ বিকাল
০১
-মা এখন যাই।
-যাই বলেনা বাবা, বল আসি।
-আচ্ছা মা আসি।
এই বলে স্টেশনের দিকে হাঁটা ধরল রেহান। সে আজ ঢাকা যাচ্ছে। এইচ.এস.সি পাশের পর বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে কঠিন ভর্তিযুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম দিকে কোথাও চান্স হচ্ছেনা দেখে সে হতাস বোধ করে। মাকে হতাসার কথা জানায় না। শুধু বলে পরীক্ষা দিচ্ছি। মা ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পারেন। ছেলেকে শান্তনা দেন। বলেন- 'আল্লাহর উপর ধৈর্য্য রাখ বাবা। তিনি তোর দিকে মুখ ফিরে চাইবেনই'। রেহান কিছু বলেনা। শুধু হাসে।
-ভাল করে একটু দোয়া করবে তো মা। তোমার দোয়া থাকলে সব হবে।
-না বাবা। শুধু আমার দোয়া থাকলেই হবেনা। তুইও একটু নামাজ পড়িস। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে যা চাবি তিনি তাই দেবেন। তিনি কারো চাওয়া অপূর্ণ রাখেন না।
আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা। রেহানের জন্য দিনটি স্মরণীয় হতে পারে আবার দু:স্বপ্নও হতে পারে। কারন এরপর আর কোথাও পরীক্ষা নেই। যদি এখানে চান্স না হয় তবে মাকে আর মুখ দেখাতে পারবেনা। অভাবের সংসারে কত কষ্ট করে মা সংসার চালাচ্ছেন তা শুধু রেহানই জানে। সম্পদ বলতে সামান্য কিছু ধানী জমি ছাড়া আর যে তাদের কিছুই নেই। নিজে না খেয়ে থেকে রেহানের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছেন তারপরো কারো কাছে হাত পাতেন নি। সেই মাকে সে কষ্ট দিতে পারবেনা। কখনোই না।
০২
যথা সময়ে রেহানের পরীক্ষা শেষ হয়। অপেক্ষা শুধু ফলাফলের জন্য। এক সময় সেই দিনটি আসে। আল্লাহর নাম জপতে জপতে রেজাল্ট বোর্ডে যায় সে। বেশিক্ষণ রোল নম্বর খুঁজতে হয়না। মেধা তালিকায় তার রোল রয়েছে। রেহানের বিশ্বাস হয়না। এডমিট কার্ডের সাথে মিলিয়ে দেখে। একই রোল। তার মানে সে চান্স পেয়েছে। দু'চোখে কিছুটা অশ্রু জমে। মাকে খবরটি দেয়ার জন্য মন অস্থির হয়ে ওঠে। চান্স পাওয়ার সংবাদ শুনলে মা যে কি পরিমান খুশি হবে! রাতেই ট্রেনেই বাড়ি চলে যায়। দেখে মা উঠোনে ভাত রাঁধছে। রেহান মনে মনে ঠিক করে মাকে খবরটি একটু অন্যভাবে দেবে। প্রচন্ড মন খারাপ করার ভান করে মায়ের পিছনে গিয়ে মাকে ডাকে। মা পিছনে ফিরে তাকায়। ছেলের হতাস মুখ দেখে। বুকটা আঁতকে ওঠে তার। তার মানে এখানেও চান্স হলনা! রেহান কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে 'মা আমি চান্স পেয়েছি ই ই ই......'। মা-ছেলের আনন্দের দৃশ্যটুকু আর নাই বা বললাম।
আজ যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। সন্ধ্যার দিকে সে ঢাকা পৌছাঁয়।
সৃষ্টিকর্তা যখন কাউকে কোন কিছু দিতে চায় তখন উজাড় করে দেয়। রেহানও যে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে কিছু পাবে তা যেন আগেই লেখা ছিল। ভর্তি হতে না হতেই এস.এম হলে থাকার জায়গা হলো, পরিচিত এক ভাইয়ের সহযোগীতায় দুটি টিউশনিও যোগার করে ফেলল। মাকে চিঠিতে সব বিস্তারিত জানাল সে। এখন নিজেকে মেলে ধরবার পালা।
০৩
আর এক সপ্তাহ পরেই ক্লাস শুরু হবে। দুদিন পরই টিউশনি। ভেতরে ভেতরে খুব টেনশন হচ্ছে। পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশনি চালাতে হবে। সবকিছু ঠিকভাবে চালাতে পারবে তো সে? এই সময় মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে তাকে না দেখা পর্যন্ত মনে শান্তি আসবেনা। গতবারও এরকম হয়েছিল। টেস্ট পরীক্ষার আরমাত্র চারদিন বাকি, হঠাত্ মাকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠল। বাড়ি যাওয়ার জন্য স্যারের কাছে অনুমতি নিতে গেল; পরীক্ষার আগে স্যার কিছুতেই যেতে দিলেন না। অস্থিরতার ভিতর দিয়ে পরীক্ষাগুলো দিল সে। রেজাল্টও খুব একটা ভাল হলনা। এবারো মাকে দেখার জন্য মন ছটফট করছে। যে পরিমান টাকা আছে তা দিয়ে বাড়ি যাওয়া আসা করা যাবে কিন্তু পুরো মাস চলবে কি করে? গ্রামের মাতবর চাচার কথাটি বারবার মনে পড়ছে। একদিন মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন- 'কোন কিছুতে ভয় পাবিনা। উপরে একজন দেখনেঅলা আছেন। তার নজর সবার দিকে আছে'। রেহানও মনে মনে বলে 'দেখনেঅলার নজরটা যেন তার উপর থেকে কখনো সরে না যায়'।
রেহান জানে মা তার জন্য অনেক চিন্তা করে। কিন্তু মা কি জানে রেহান মাকে নিয়ে কতটা চিন্তা করে? অনেক কিছুই ভাবে সে মাকে নিয়। একদিন পড়ালেখা শেষ করে বড় একটা চাকুরী করবে, তারপর মাকে আর গ্রামে থাকতে দেবেনা। সুন্দর দেখে দুটো রুম ভাড়া নেবে। মা নির্জনতা পছন্দ করেন। তাই বেছে বেছে এমন রুম ভাড়া নেবে যেখানে শহরের কোলাহল কম থাকে। আর হ্যাঁ, রুমের জানালা হতে হবে পূর্ব দিকে। মা ফজরের সালাত শেষে জানালা খুলে দেন। জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় কুরআন শরিফ পড়েন। তিনি কোথায় যেন শুনেছেন সকালের সূর্যের আলোয় কুরআন শরিফ পড়ার মধ্যে বরকত বেশি। কথা সত্য হোক আর মিথ্যা হোক মা'র যেটা পছন্দ রেহান সেটাই করবে।
০৪
এখন যা করতে হবে তা হল দুটি মোবাইল কেনা। প্রায় সাত মাস হয়ে গেল সে মাকে দেখেনা। মা গত চিঠিতে লিখেছেন 'তার নাকি শরীরটা ভাল না। রাতে ঘুমুতে গেলে দু:স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেন। তারপর গায়ে জ্বর আসে। প্রচন্ড জ্বর। ফজরের আযান দেয়ার সাথে সাথে জ্বর সেরে যায়। রেহানের খুব টেনশন হয়। এবার বাড়িতে গেলে মাকে ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে। তাদের গ্রামের আশেপাশে তেমন ভাল ডাক্তার নেই। গ্রাম থেকে প্রায় ন'মাইল দূরে মিজু হাটে এম.বি.বি.এস ডাক্তার বসেন। আগামী মাসের ০৩ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তির টাকা পাবে সে। টিউশনি থেকে পাওয়া কিছু টাকা জমানো আছে। এসব দিয়ে মার জন্য মোবাইল আর ডাক্তার দেখানোর খরচটা হয়ে যাবে। মা চিঠিতে লিখেছে 'তার নাকি শরীরটা আরো খারাপ করেছে। আগে শুধু রাতের বেলায় জ্বর আসত, এখন দিনের বেলাতেও আসে'। রেহানের আর দেড়ি সয়না। কখন সে তার মায়ের প্রিয়মুখ টি দেখতে পাবে?
০৫
আজ পাঁচ তারিখ। রেহান রাতের ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছে। এখন শীত বেশি পড়েছে। মার জন্য একটা চাদর কিনেছে সে। কেনার সময় দোকানি বলল- 'ভাই ভেড়ার পশম দিয়ে তৈরী। তাই দামটা একটু বেশি'। ভেড়ার পশম দিয়ে তৈরী না হলেও চাদরটা যে অনেক ভাল, তা গায়ে দিয়েই বোঝা যায়। চাদরটা গায়ে জড়ানোর সাথে সাথে এক ধরনের উষ্ঞতা তৈরী হয়। মা এটা পেলে খুবই খুশী হবে। আর মাকে কালই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তার শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চিঠিতে লিখেছেন 'তিনি নাকি শুনতে পান বাবা তাকে ডাকছে। কবরে একা থাকতে তার ভাল লাগেনা'। এসব কথা যে মা কেন লেখে! রেহানের বুক ফেঁটে কান্না আসে। এত সহজেই সে মাকে মরতে দেবে? আরো অনেকদিন মা বেঁচে থাকবেন। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে মায়ের মুখে কখনো হাসি দেখেনি। কি পরিমান কষ্ট আর সংগ্রাম করে সংসার চালাচ্ছেন তা মনে হলে রেহান ফুঁপে ফুঁপে কাঁদে। যিনি এত কষ্ট করলেন তার মুখে হাসি না ফুটিয়ে মরতে দেবে সে? কখনোই না। মা চায় রেহান নামাজ পড়ুক, আল্লাহর ইবাদাত ঠিকমত করুক। রেহানও ঠিক করে বাড়িতে গিয়ে নামাজ শুরু করে দেবে। মুনাজাতে সে আল্লাহর কাছে চাইবে- 'হে আল্লাহ, মাকে তুমি আরো অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখো'।
ষ্টশন থেকে গ্রামে আসতে সকাল নয়টা বেজে গেল। মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। কতদিন মাকে দেখিনা। মায়ের মুখে 'বাবা' ডাক শুনিনা। 'আজ পথ শেষ হতে এত সময় লাগছে কেন? উফ, আর যে ধৈর্য্য বাঁধ মানছে না। কখন বাড়িতে যাব? কখন মায়ের মুখটি দেখতে পাবো? এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির উঠোনে চলে আসে রেহান।
আজ বাড়িতে এত মানুষ দেখা যাচ্ছে কেন? আর ঘরের ভিতর থেকেই বা মহিলাদের কান্নার শব্দ আসছে কেন? কি হয়েছে আমার মায়ের? আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর যায় সে। দেখে পর্দার আড়ালে কাকে যেন খালি চকিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা কাপর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। রেহান ডেকে ওঠে- 'মা, মাগো'। কে যেন পিছন থেকে এসে রেহানকে জাপটে ধরে। তোর মা আর নাইরে...... ।
০৬
এশার আযান দিয়েছে। রেহান পুকুর পাড়ে বসে আছে। বাদ জোহর মায়ের মাটি হয়েছে। তখন থেকেই এখানে বসে আছে সে। সন্ধ্যার দিকে আতিক ভাই এসে বাড়ির ভিতর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। রেহান যায়নি। সে আকাশে তারা ওঠার অপেক্ষায় আছে। সে শুনেছে 'মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়'। রেহান বসে আছে 'মা-তারা' দেখার জন্য। আকাশে অনেক তারা উঠেছে। এগুলোর মধ্যে নিশ্চই তার মা আছে। আতিক ভাই বলেছে- 'যে চলে যায়, সে আর ফিরে আসেনা'। রেহানের বিশ্বাস হয়না কথাটি। মা কোথায় যাবে তাকে ছেড়ে? কাল রাতেও তো ভাল ছিলেন। নিজে রান্না করেছেন, খেয়েছেন, নামাজ পড়েছেন। ঘুমুতে গিয়ে আর উঠবেন না, এ হতে পারেনা। মার জন্য নিয়ে আসা মোবাইল আর চাদর যে এখনো দেয়া হয়নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্র ও হাজারো তারার মাঝে সে তার মাকে খোঁজে। মনে মনে বলে- 'মা, তোমার মোবাইল আর চাদর নিয়ে যাও.......'।।
বিষয়: Contest_mother
৪১৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন