একটি প্রতীক্ষা এবং দু'ফোঁটা অশ্রু
লিখেছেন লিখেছেন ধ্রুব নীল ৩০ এপ্রিল, ২০১৩, ০৬:১৯:৫১ সন্ধ্যা
পুকুর পাড়ে একটি লম্বা তালগাছ। বহুদিন ধরে তালগাছে বাসা বানিয়ে এক যুগল বাবুই পাখি থাকে। সন্ধ্যা হলেই তারা কিচির মিচির করে গান করত। গাছের নিচে একটি টিনশেড বাসা। সেই বাসার জানালা দিয়ে শহরের পথের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে নীলিমা।
কি ব্যাকুল চাহনী! যেন যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করছে তার প্রিয়জনের জন্য। মনের গভীরে বিষাদের আলপনা যেন চোখের মনিতে ফুটে উঠেছে কষ্টের কাব্য হয়ে।
বসন্তের প্রথম দিনে মনের মানুষটি আর গান গেয়ে ওঠেনা। ক্ষ্যাপানোর জন্য দুষ্টুমির ছলে রাগিয়ে দেয়না। হঠাত্ কোন একদিন একগুচ্ছ গোলাপ এনে অবাক করে দেয়না। নীলিমা অপেক্ষায় থাকে তার জন্য। প্রতিদিন। গোঁধূলিতে।
কখন যেন চোখের কোটরে দুফোটা অশ্রু জমে আসে। নীলিমা চোখের পাতা বন্ধ করে পানিকে গাল বেয়ে নিচে পরতে দেয়। প্রতিদিনই তো পরে। অথচ মানুষটা তার চোখে অশ্রু দেখতে পারত না। বলত,
- যদি কাঁদতেই হয়, আনন্দে কাঁদবে, কষ্টের কারনে নয়।
নীলিমা হেসে বলত,
- তাহলে তোমার বুকে মাথা রেখে কাঁদি কিছুক্ষণ?
- কাঁদলে সুখ পাবে?
- হুম।
- কাঁদো।
নীলিমা বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত। এই কাঁদাতেও তার সুখ। ফিরে যায় পুরনো স্মৃতিতে।
তার একাকিত্বের জীবনে অনুপম বন্ধু হয়ে এসেছিল সে। বিয়ের পর থেকে কি সব মজার মজার কথা বলে হাসাত সারাক্ষণ। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গল্পের আসর জমাত ঘরে।
ভীষণ অভিমানী ছিল ও। কিছু হতে না হতেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকত। মান ভাঙাতে সে কি যন্ত্রনা পোহাতে হত নীলিমাকে। আজ খুব মনে হয়, এমন যন্ত্রনা সে সারাজীবন হাসিমুখে পোহাতে রাজী আছে। শুধু সে ফিরে আসুক। তার ঐ লোমশ বুকের মাঝে আর একবার জড়িয়ে ধরুক নীলিমাকে। ঠিক যেমন করে ধরেছিল বিয়ের প্রথম রাতে। প্রশান্তিময় দিনগুলি বিধাতা এত তাড়াতাড়ি কেড়ে নেয় কেন? নীলিমার বুক ফেটে কান্না আসে। হু হু করে কাঁদেও কিছুক্ষণ।
কি পাগল ছিল লোকটি!! একদিন বাজার থেকে ফেরার পথে নীলিমা একটি ডিনার সেট দেখিয়ে বলল, "ঐ টা মনে হয় খুব দামি, তাইনা?" ও দাম জিজ্ঞেস করে জানল ৯ হাজার টাকা। নীলিমা জানে এত টাকা ব্যায়ে কেনার মত সামর্থ্য তাদের নেই। ওর উপার্জন দিয়ে ভালভাবে মাস চললেও অতিরিক্ত টাকা জমানোর মত অবস্থা থাকে না। সে ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বলল, "আমি এমনিতেই জানতে চেয়েছি। তুমি এমন মন খারাপ করে আছো কেন? আমি কিন্তু কেঁদে ফেলব...!" ও কথা বলেনি। মাথা নিচু করে বাসায় ফিরেছিল।
ঠিক তিন মাস পর মানুষটা ঐ ডিনার সেট নিয়ে বাসায় হাজির। নীলিমা অবাক হয়ে বলে, "এত টাকা কোথায় পেলে তুমি?" ও জবাব দেয়না। অনেক জোরাজুরি করার পর মুখ খোলে। নীলিমা সারারাত কেঁদেছিল সেদিন। ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিল। ও শত চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারেনি।
- কেন তুমি এই তিন মাস দুপুরে না খেয়ে থেকে টাকা জমিয়েছিলে? কেন বোঝনা আমার সুখ তোমার বুকের মাঝে, আভিজাত্যে নয়।
মানুষটাও সাথে সাথে জবাব দিয়েছিল,
- তোমার সুখের নামে আমি আমার জীবনটা লিখে দিয়েছি।
তাল গাছের বাসা থেকে বাবুই যুগল যেন কিচির মিচির করে ওর কথাকে সমর্থন জানিয়েছিল।
এরপর থেকে নীলিমা আর মুখ ফুটে কিছু চাইত না। আবার যদি পাগল স্বামীটা পাগলামো করে! এই ভয়ে।
একদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সে বলল, "সারাদিন বাইরে কাজ করে যতটুকু উপার্জন করি, তা দিয়ে দু'জনার ভালভাবে দিন কাটলেও কিছু জমানোর মত অবশিষ্ট থাকেনা। সামনে আমাদের ভবিষ্যত আসছে। আমার বেবীর জন্য হলেও কিছু সঞ্চয় করা দরকার।"
- কি করতে চাও তুমি?
- "আমি বরং ঢাকা যাই। কিছুদিন সেখানে থাকলে কিছু জমাতে পারব মনে হয়।"
নীলিমা যেতে দিতে চায়নি। বাসায় ফিরতে ওর একটু দেড়ি হলে নীলিমার সে কি অস্থিরতা! যে মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সে একজীবনের সবকটা দিন একবারে কাটিয়ে দিতে পারে, তাকে কিনা অনেকদিন না দেখে থাকতে হবে? এও সম্ভব!
বাস্তবতার কাছে নীলিমার আবেগ জয়ী হতে পারে নি। ও ঢাকা যায়। সপ্তাহ খানিক পরে মোবাইল ফোনে জানায়, "ও একটি গার্মেন্টেসের ম্যানেজার হয়েছে। অনেক ভাল বেতন। প্রথম মাসের বেতন পেলেই সে বাড়ি এসে দেখা করে যাবে।"
নীলিমার চোখ চিকচিক করে। আনন্দের সংবাদটি মনের মধ্যে চেপে রাখতে পারছেনা। কাউকে জানাতেই হবে। জানালার পাশে এসে বাবুই পাখিদের ডাক দেয়। "জানিস, সে আসছে। এখন একটু গান গা না! তোদের গান শুনতে ইচ্ছে করছে।" তাল গাছের বাসা থেকে পাখি দু'টো কিচির মিচির করে ওঠে।
আনন্দের পর নীলিমার মনে অস্থিরতা বাসা বাঁধে। কবে মাস শেষ হবে? কবে সে আসবে, আর কবে দেখবে তার প্রিয় মানুষটির মুখ? যে মুখটি দিকে তাকিযে থেকে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে রাজী আছে সে। বাবুই যুগল জানালার পাশ দিয়ে সাঁ করে উড়ে যায়। ওরাও মনে হয় অপেক্ষা করছে বাড়ির কর্তার জন্য।
নীলিমা দিন গুণে। ১ তারিখ ২ তারিখ এভারে ২৩ দিন পেরিয়ে যায়। ২৪ তারিখ হঠাত্ খবর শুনে, "ও যে গার্মেন্টসে চাকুরী করে, সেই গার্মেন্টসের দালান ধসে পরেছে। প্রায় পাঁচ হাজার লোক আটকা পরেছে সেখানে। ইতোমধ্যে নাকি শতাধিক মারাও গিয়েছে"।
নীলিমা চিত্কার করে ওঠে। ছোট ভাইকে ছবি ও বৃত্তান্ত সহ ঢাকায় পাঠায়।
এক সপ্তাহ পর ছোট ভাই ফিরে আসে। মৃত কিংবা জীবিত কারো মাঝে সে নেই। কোথাও পাওয়া যায়নি তাকে।
নীলিমা কথা বলেনা। মূর্তি হয়ে লোকটির ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। অশ্রু যেন স্রোতের পানির মত গড়িয়ে পরছে চোখ থেকে। এভাবে কেটে যায় সাত মাস।
আজও সে এলনা। অথচ প্রথম মাসেই তার বাড়িতে আসার কথা। এই প্রথম বারের মত মানুষটি নীলিমার কাছে কথা দিয়ে কথা রাখল না। হয়ত শেষ বারের মতও!!
নীলিমা প্রতিদিন চেয়ে থাকে জানালা ঘেঁষে। পেটের উপর হাত দেয়। ওর ভবিষ্যত্ বড় হচ্ছে। এই ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় নিয়ে এখনো ফিরল না সে। বাবুই পাখি দুটো আগের মত ডাকেনা আর। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে নীলিমার দিকে। ওদের চোখ দুটোও কি করুণ!
নীলিমা পথ পানে চেয়ে থাকে। প্রতিদিন। গোঁধূলীতে। চোখ থেকে দু'ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে। নীলিমা বাধা দেয়না। পরতে থাকুক। ও না ফেরা পর্যন্ত চোখের জলকে সে বাধা দেবে না। কোনদিনও না......।
উত্স্বর্গ:
সাভার ট্রাজেডীর পর প্রিয়জন হারানো সেই মানুষগুলোকে, যারা আজও পথ চেয়ে আছে..."সে ফিরবে বলে..!"
বিষয়: সাহিত্য
২৪২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন