স্বপ্নালু কন্যার স্বপ্ন (পর্ব-১)
লিখেছেন লিখেছেন ইশরাত জাহান রুবাইয়া ১৮ মার্চ, ২০১৪, ০১:৫৪:১২ দুপুর
......এই এই, আপু, তুই আমার কবিতার খাতাটা ধরছিস কেন!! দে বলছি, প্লিজ! কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো অবন্তী।
অবন্তীর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো ওর ইমিডিয়েট বড় বোন সাওদা।
- দেবো তো! আগে দেখে নেই জনাবা কবিনী কি লিখেছেন!
- দেখ, আমাকে কবিনী বলবিনা! আমি কোন কবিনী নই! আমি হলাম শিক্ষানবিস! দে বলছি আমার খাতা! খপ করে বোনের হাতে ধরা খাতাটা কেঁড়ে নিতে চেষ্টা করলো অবন্তী। কিন্তু অবন্তীকে হাত বাঁড়াতে দেখেই খাতাটা ওর নাগালের বাইরে নিয়ে গেল সাওদা।
কাগজ মেলে ধরে সুর করে পড়তে লাগলো সে।
- “কপাল ভাসিয়া গেল দুই নয়নের জলে,
এক ঠ্যাং বাঁধা ছিল আমগাছের ডালে!
মাটিতে ঝুলিতেছিল আরেক ঠ্যাং,
সে পথ দিয়ে যেতো যারা মারতো তাতে ল্যাং!”
আসতাগফিরুল্লাহ! এই ধরণের কবিতা তুই কোত্থেকে শিখেছিস? চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলো সাওদা।
- শিখিনি কোথাও, প্রথম লাইনটা কই যেন পড়েছিলাম, বাকিটা নিজে নিজে লিখেছি। গাল ফুলিয়ে বললো অবন্তী।
- এহ! কি অনন্য কাব্য প্রতিভা! মুখ ভেঙচিয়ে পরের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বললো সাওদা।
পরের কবিতাটা পড়তে গিয়ে চোখ দুইটা মাথায় উঠলো তার!
“আমার এ ঘর বাঁধিয়াছে যেবা আমি ভাঙি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদে যে আমার লাগি, তারে করি আমি পর।
যে মোরে দিয়াছে বড় বাড়ি-গাড়ি, আমি তারে দেই লাঠির বারি,
ফুল পেয়ে তারে কাঁটা করি দান সারাটি জনমভর।
আপন করিতে কাঁদে যে আমার লাগি আমি তারে করি পর।”
ইন্নালিল্লাহ! জসিমউদ্দীনের এত সুন্দর “প্রতিদান” কবিতাটার কি হাল করেছে! কিসব বিধ্বংসী কথা বার্তা! এজন্যই তো তুই তোর এই খাতাটা লুকিয়ে লুকিয়ে রাখিস! যাই আব্বুকে উনার স্বনামধন্য কন্যার অনন্য কাব্য প্রতিভা সম্মন্ধে একটু ওয়াকিফহাল করে আসি!
- দেখ আপি, প্লিজ এমন করিসনা, প্লিজ!
সাওদা কি আর এত কথা শোনে? খাতাটা হাতে নিয়ে নাচতে নাচতে বাবার কাছে চলে গেলো।
বড় ভাইবোনগুলি এমন পঁচা কেন! সব কিছুতেই খালি বাগড়া দেয়! ভাবতে ভাবতে নিঃষ্ফল ক্রোধে ফেটে পড়ে অবন্তী।
ঘটনাটা অনেক আগের। অবন্তী তখন নিতান্তই ছোট। পড়ালেখার পাশাপাশি গল্প-কবিতার বইয়ে প্রচন্ড নেশা তার। তার কাছে অবসর মানেই বই পড়া। অবন্তীর রাজ্য জুড়ে শুধু বই আর বই। অবন্তীর প্রায়ই মনে হতো, এমন একটা রাজ্য যদি থাকতো, যেখানে খালি বই আর বই দিয়ে ভরা, আর সেই রাজ্য থাকতো অবন্তীর একার! তখন সে সেই রাজ্যে ঢুকে প্রধান ফটকে তালা দিয়ে বই পড়তো, আর ফাঁকে ফাঁকে কাব্যচর্চা করতো। কেউ ঢুকতেও পারতোনা, তাকে বিরক্ত করতেও পারতোনা! কেমন হতো?
কিন্তু তা কি আর সম্ভব! তাই রুমে বসেই বই পড়তে হয়। সারাদিন রাত সুযোগ পেলেই বই পড়তে থাকে। আর সাওদা এসে নানাভাবে বিরক্ত করে তাকে। অবন্তীকে অনর্থক খুঁচিয়ে আনন্দ পায় সে! শুধু কি সাওদা? রাত জেগে জেগে অবন্তী বই পড়ে, এই নিয়ে বিস্তর অভিযোগ পরিবারের সবার! বাবা বলেন এই মেয়ে বই পড়তে পড়তে একদিন চোখের দৃষ্টির বারোটা বাজাবে! আর মা দুদিন পরপরই অবন্তীর বিছানার তোষক উল্টিয়ে ১০/১৫টা করে গল্পের বই পান! আত্মীয়-স্বজনের অভিযোগ মাত্রাতিরিক্ত বইপ্রীতি অবন্তীকে দিন দিন অসামাজিক করে দিচ্ছে। একদিন ছোট চাচু তো বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললেন,
- কিরে, এই বয়সের মেয়েরা বান্ধবীরা একসাথে বসে কত মজার মজার গল্প করে, কত জায়গায় ঘুরতে যায়, তুই এসব করিসনা কেন?
অবন্তী চাচুকে অবাক করে দিয়ে বলে,
- আমিতো নিত্যই ওদের সাথে নানা মজার আড্ডা দেই! এমন অনেককিছুই ওরা আমাকে বলে, যা আমি আগে জানতামইনা! আমি ওদের সাথেই অনেক জায়গায় ঘুরি, অনেক দেশে যাই, যেখানে তুমি কখনো যাওনি!
- তাই নাকি! ওরা কারা?
অবন্তীর উত্তর, ওরা হলো বই, বই আর বই!
নাতনির এহেন বইপ্রীতি দেখে অবন্তীর নানু প্রায়ই বলেন, আগে ভাবতেন বইয়ের দোকানে সাজানো সারি সারি বই কোন পাগলে কেনে? এখন দেখেন সেই রকম একটা বইপাগলি তাঁদের বাসায়ই বাস করে!
এভাবে প্রতিনিয়ত নানা অভিযোগ শুনতে শুনতে অবন্তীর একসময় মনে হলো হলো, আসলে সবকিছুতেই ব্যাল্যান্স রাখা উচিত। বিশৃংখলভাবে বই পড়ে সে নিজের ক্ষতিও করছে। তাই সে সারাদিনে বই পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু সময় নির্ধারিত করে রাখলো। আর শুধু গতানুগতিক গল্পের বই না পড়ে, জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য যেসব বই পড়া জরুরী, সেগুলির লিস্ট করে ধারাবাহিকভাবে মন দিয়ে পড়তে শুরু করলো। এভাবে নানা রকম বই পড়তে পড়তে একসময় অবন্তীর চিন্তাভাবনা জুড়ে নানারকম শব্দরা ছুটোছুটি করতে শুরু করলো।
অবন্তীর মনের গহীণে লেখক হবার বাসনা জেগে উঠলো। কিন্তু লেখক হওয়াতো আর এত সহজ নয়! কলমের সুঁচ দিয়ে কাগজের বুকে সেই ছুটোছুটি করা শব্দগুলি দিয়ে নকশি কাঁথা বোনা, কিংবা শব্দের সাথে শব্দ যোগ করে শিউলী ফুলের মত মালা গাঁথা কি এতই সোজা! তবুও নিজের বিক্ষিপ্ত নানা ভাবনার সমষ্টিকে যোগ করতে কলম তুলে নিল সে! কখনো শব্দেরা ঠিকঠাক বসতো, কিন্তু কখনো অভিমানে তার সাথে আড়ি নিত! একদম নবীন হলে যা হয় আরকি! তখন নতুন এক বুদ্ধি বের করলো সে, কিছু মাথায় না এলে বিখ্যাত কবিদের কবিতার প্যারোডি রূপ দেয়া শুরু করলো! অবশ্য এসবের পাঠকও একান্ত সে নিজেই ছিল! কবিতার একটা খাতা ছিল, ওটা সবসময় লুকিয়ে রাখতো, আর দূর্ভাগ্যক্রমে সেই খাতাটাই পড়লো কিনা সাওদার হাতে! সাওদার কল্যাণে বাবা তাঁর কিশোরী কণ্যার অনন্য কাব্য প্রতিভা দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলেন!
চলবে......
বিষয়: বিবিধ
১৬৮০ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তয় আমারে চিন্তা করতে পারে, আমিও ব্যাচেলর
এইটা একটা কথা বললেন!!!!এই জন্য জীবন শেষ করে দিবেন!! চেষ্টা করুন।
বইটা পড়ে কেমন লাগলো বললেননা তো!
....হাসতে হাসতে চেয়ার শুদ্ধু উল্টে পড়েছিলাম যে ! ভালো লাগলো খুব, আপুমনি !
আল্লাহ বাঁচিয়েছে!
আপনাকে আনন্দিত করতে পেরে আমারো ভালো লাগলো! তবে ব্যাথা পাননি তো?
গল্পটা মাত্র দুই পর্ব। দিয়ে দিয়েছি।
ফার্স্ট গার্লের লেখার মতোই উপযুক্ত পোস্ট!
মাশাআল্লাহ...
এগিয়ে চলুন অবন্তী...স্যরি...
রুবাইয়ামণি...
ফার্স্ট গার্লের মত লেখা এইটা! কি যে বলেন!
ধন্যবাদ ভিশুজ্বী।
তবে সত্যি কথা, কবি জসীমউদ্দীনের কবিতার যে হাল হয়েছে সেটাই আজকের সঠিক চিত্র।
সাথে আছি মেধার স্ফুরনের আরো বহিঃপ্রকাশ দেখার জন্য।
নিজের অনন্য(!!!) মেধায় নিজেই টাস্কিত হয়ে গিয়েছিলাম!
এমন একটা অবস্থা হয়েছিল, ক্লাসে ম্যাডাম "প্রতিদান" কবিতা বলতে বললে আমি ভুলে আমার বানানোটাই বলে ফেলতাম!!আর কি এক অবস্থা!
আসলেই এই সমাজে কবিতাটির পুরো উল্টো রূপ দেখছি আমরা এখন।
কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় আপুজ্বী।
এইরকম কবিতা লেখা হয়েছিল ঠিকই তবে অবন্তীর মত বড়বোনের সাথে এমন কান্ড ঘটেনি। আব্বুর হাতে আমার কবিতার খাতাও পড়েনি, আর বই পড়ার জন্য বান্ধবীদের সাথে গল্প বা আড্ডাও বাদ ছিলনা!
সহমত আপনার সাথে। দুআ করবেন আল্লাহ যেন তাওফীক দেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন