ভালোবাসার রঙধনু....(শেষ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন ইশরাত জাহান রুবাইয়া ১৮ জানুয়ারি, ২০১৪, ১২:৪০:৪৯ দুপুর
........স্টাডিরুমের দরজাটা খানিকটা ফাঁক হয়ে আছে। সাঈদ সাহেব একমনে একটা ফাইলে মুখ গুঁজে আছেন। চাচুকে এভাবে থাকতে দেখে দুষ্টুমি খেলে গেল রুমাইসার মাথায়। কন্ঠে খানিকটা গাম্ভীর্যতা ফুটিয়ে বললো,
- আসসালামু আলাইকুম! মে আই কাম ইন, স্যার?
- ওয়ালাইকুমুস সালাম। ইয়েস কাম ইন! ফাইলে মুখ গুঁজে থেকে না তাকিয়েই জবাব দিলেন সাঈদ সাহেব।
ভেতরে ঢুকে স্বশব্দে নাস্তার ট্রে টা টেবিলে রাখলো রুমাইসা। মসলাদার চা আর সাথে গরমাগরম সবজির পাকৌড়া চাচুর খুব পছন্দের। ঝটপট বানিয়ে নিয়ে চাচীমাকে চা নাস্তা দিয়ে এসে চাচুর জন্য নাস্তা আর নিজের চা নিয়ে স্টাডিরুমে ঢুকেছে।
শব্দ করে ট্রেটা রাখতেই চমকে উঠে তাকালেন চাচু।
- ওহ! তুই! যেভাবে আসার অনুমতি চাইলি আমি ভেবেছিলাম বুঝি অফিসেই আছি!
- তা তো ভাববেই! বাসায়ও যেভাবে ফাইলের মাঝে মুখ গুঁজে থাকো! খোলা ফাইলগুলি বন্ধ করে একপাশে ঠেলে দিল রুমাইসা।
- কখন এলি?
- এইতো আধঘন্টা হবে।
নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিচ্ছে রুমাইসা। কথাটা কিভাবে শুরু করবে ভাবছে। চাচুকে তো আর বান্ধবীর মত লেকচার দেয়া যায়না!
পাকৌড়া মুখে পুড়ে চিবাতে চিবাতে ব্যাপারটা হঠাত্ খেয়াল হলো সাঈদ সাহেবের। বললেন,
- কি রে, তুই নাস্তা আনলি যে? তোর চাচীমা কই?
- চাচীমা বারান্দায় বসে আছেন। অনেকটা অন্যমনস্ক দেখলাম। তাই আমিই নাস্তা বানিয়ে তাঁকে দিয়ে, এখানে এলাম তোমার সাথে গল্প করতে করতে খাবো বলে।
- হুম....জানিস তোর চাচীর যেন কি হয়েছে, কদিন ধরেই দেখছি কেমন যেন হয়ে গেছে! আগের মত খুব একটা হাসেনা, বেশি একটা কথাও বলেনা, আমি সারাদিন কাজে ডুবে থাকলেও আগের মত রাগারাগিও করেনা! ইতঃস্তত করতে করতে বলেই ফেললেন চাচু।
রুমাইসা চেয়েছিলো এই ব্যাপারটা চাচুই তুলুক। নড়ে চড়ে বসলো সে।
- এমনটা কতদিন ধরে চলছে বলতো?
- কি জানি ঠিক বলতে পারবোনা! আমি ইদানিং খুব ব্যস্ত থাকি তো তাই....
- তাই আরকি খেয়াল করার মত সময়ও হয়নি, এইতো? দেখো চাচু, প্রতিটি মানুষের উপর দুইটা হক্ব আছে। একটা হলো আল্লাহর হক্ব, আরেকটা হলো বান্দার হক্ব। আল্লাহর হক্ব হলো মানুষ শুধু আল্লাহরই ইবাদাত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবেনা, তাঁর সাথে কৃত ওয়াদা পালন করবে, তাঁর সমুদয় হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে, এটা করতে সে দায়বদ্ধ। আর বান্দার হক্ব হলো সে আল্লাহর সৃষ্ট কোন জীবের অধিকার ক্ষুন্ন করবেনা। কারো উপরে অনাচার করবেনা, কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাত্ করবেনা, কাউকে অন্যায়ভাবে আঘাত করবেনা, কাউকে তার ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্য কিছু থেকে বঞ্চিত করবেনা, অর্থাত্ কারো অনিষ্ট করবেনা। এটা আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত ব্যাখ্যার দাবী রাখে। এবং এর অন্যথা করলেও আল্লাহর কাছেই জবাবদিহি করতে হবে।
কারো প্রাপ্য কিছু থেকে বঞ্চিত করাও কিন্তু এর মধ্যেই পড়ে। চাচীমা খুব উচ্ছল আর প্রানবন্ত মানুষ। হঠাত্ করেই তিনি বদলে গেছেন এবং তুমি ভেবেই পাচ্ছোনা, কেন এমনটা হলো, তাইনা?
- হুম...
- আমার মনে হয় কি, এর পেছনে আসলে তুমিই ভুমিকা রেখেছো। দিনের পর দিন তুমি কাজের মাঝে আকন্ঠ ডুবে থেকেছো, এমনকি বাসায় এসেও কাজ করেছো। তোমার পরিবার আছে, জীবনসঙ্গী আছে, তারা তো তোমার সঙ্গ চায়, তোমার সান্নিধ্য চায়, কিন্তু তা থেকে তারা ক্রমাগত বঞ্চিত হয়েছে। চাচীমার কথাই ধরো, সারাদিন তিনি অপেক্ষা করতেন তুমি কখন বাসায় ফিরবে, কিন্তু বাসায় ফিরেই তুমি আবারো কাজে ব্যস্ত থেকেছো। এভাবে দিনের পর দিন তোমার সাথে একান্তে বসে দু দন্ড গল্প করার অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন, এভাবে একসময় তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন তোমার কাছ থেকে। আবেগগুলি মরে যেতে শুরু করেছে, যেহেতু তোমার কাছে আবেগের দাম তিনি পাননি। তাঁর মনের খবর তুমি নাওনি, বরং ভেবেছো তার সাথে গল্প করে যে সময়টা কাটাবে, ঐ সময়টা তুমি আরো দুইটা ফাইল বেশি দেখতে পারবে। কিন্তু ভুলে গেছো, অফিসের ফাইলের চেয়ে জীবনের ফাইল দেখা বেশি প্রয়োজনীয়!
- কিন্তু আমি তো আমার পরিবারের ভালোর জন্যই বেশি কাজ করি, বেশি অর্থ এলে তারা বেশি সুখে থাকবে, এ জন্যই তো এত কাজের চাপে ডুবে থাকি। তাহলে অধিকার ক্ষুন্ন হলো কি করে?
- কারণ অর্থের যোগান দেয়াটাই সব অধিকার পুর্ণ করা নয়! অফিসের সময়ে অফিসের কাজ করো। পরিবার হলো মানুষের শান্তির নীড়, বিশ্রামের স্থান, এটাকেও অফিস বানিয়ে নিয়োনা। মানুষের জীবনধারণের জন্য খুব বেশি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন নেই। হালাল উপায়ে খেয়ে পড়ে মোটামুটি সচ্ছলভাবে সম্মানের সাথে জীবন অতিবাহিত করতে পারলেই যথেষ্ট। অতিরিক্ত অর্থের পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ একসময় পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্যটাই ভুলে যায়। অর্থের পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবনের অনেক মূল্যবান সময় হারিয়ে ফেলে। জীবনের শেষ পর্যায়ে গিয়ে সে উপলব্ধি করতে পারে জীবনে অতিরিক্ত অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে সে আল্লাহর ইবাদাত করার মত সময় পায়নি, পরিবারকে সময় দিতে পারেনি, অনেক প্রিয় মূহূর্ত, প্রিয় ভালোবাসার মানুষ জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, অনেক কিছুই তার অজানা রয়ে গেছে। তারপর এক অতৃপ্তি আর নিঃসঙ্গতা তাকে ঘিরে ধরে। এই নিঃসঙ্গতাই মৃত্যু পর্যন্ত তার সঙ্গী হয়ে থাকে। তখন সে সঙ্গ কামনা করে, কিন্তু সঙ্গ দেয়ার মানুষগুলি তখন অনেক দূরে থাকে নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
- তুই কি বলছিস এখন সেই অধিকার পালন করতে গিয়ে পরিবারকে সঙ্গ দেয়ার জন্য অফিসের কাজ ছেড়ে দেবো?
- না, তা কেন! বরং অফিসের কাজগুলি অফিসেই সারো। বাসায় এসে দাদুর কাছে কিছুক্ষণ বসো, চাচীমার সাথে গল্প করে কিছুটা সময় কাটাও, একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া করো, আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর নাও। অন্যান্য প্রয়োজনীয় টুকটাক কাজ থাকলে সেগুলি সারো, এবং এই প্রতিটি কাজই আল্লাহকে খুশি করার নিয়্যাতে করো। কেননা এসব কিছুই রাসূলের সাঃ সুন্নাহও বটে। ছুটির দিনে চাচীমাকে নিয়ে কোথায় ঘুরে এসো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ। এমনকি তখন মন অনেক প্রশান্ত থাকবে, অফিসে কাজ করতে গেলেও দেখবে ততটা বিরক্তি লাগবেনা।
- ওকে, আম্মিজান। তুই আসলে আমার ভাতিজি না, আমার মা! লেকচার তো মাশা আল্লাহ ভালোই শিখেছিস! এই জন্যই তোকে প্রবীণা তরুণী বলি! তোর বক্তব্য শুনতে শুনতে আমার নিজেরও মনে হচ্ছে আসলেই আমি ওর প্রতি অবিচার করেছি। এই দেখ, ফাইল দূরে সরালাম! যা তোর চাচীকে ডেকে নিয়ে আয়। গল্প করি এখুনি!
চাচুর ভঙ্গি দেখে হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি চলে এলো রুমাইসার।
- কি করবো বলো, মায়েদের কাজই তো হচ্ছে ছেলে আর ছেলের বউয়ের মধ্যে সম্পর্ক কি করে আরো ভালো করা যায়, সেই চেষ্টা করা। কারণ সন্তানের খুশিকে তাঁরা নিজেদের খুশির উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তোমার আম্মা যখন অসুস্থ, তখন আমাকেই তো সে দায়িত্ব পালন করতে হবে, তাইনা! যাহোক, এখন না, আর একটু সবুর করো, তোমাদের গল্পের মাঝখানে থেকে আলুভর্তা হতে আমি থাকতে রাজি নই! আম্মু বলেছেন মাগরিবের আগেই বাসায় ফিরতে। আমাকে এখনই যেতে হচ্ছে। চাচীমাকে ডেকে দিয়ে আমি যাচ্ছি এখন!
..........বাসায় ঢুকতেই দেখে আপু আর দুলাভাই এসেছে। আম্মু দরজা খুলতেই দেখলো ড্রইংরুমে দুলাভাই বসে আছেন। পর্দার আড়াল থেকে সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞস করে নিজের রুমে চলে এলো রুমাইসা। দেখলো ওর রুমে বড় আপু মুখ ভার করে বসে আছে। হেসে ফেললো রুমাইসা। নিশ্চয়ই তাঁদের মাঝে খোঁচাখোঁচি হয়েছে আবার!
- আবার কি হলো? ভাইয়া সামনের রুমে বসা আর তুমি এখানে কেন?
- কি আর হবে, তোর ভাইয়ার ঢং! বসে থাকুক একলা একলা! যাবোনা আমি।
কয়েকদিন পরপরই আপু আর দুলাভাই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে একে অন্যের উপর অভিমান করে বসে থাকে। আর দুজনেরই ইগো এত বেশি যে আগে সরি বলতে দুজনেরই বাঁধে! কি করা যায়? ভাবতে ভাবতে দুষ্টু বুদ্ধি এলো রুমাইসার মাথায়।
বোনের পাশ থেকে আস্তে করে মোবাইলটা নিয়ে নিলো। আর ভাগ্নিটাকে বললো দুলাভাইয়ের মোবাইল নিয়ে আসতে, এবং ও যে আনতে বলেছে এটা না বলতে। ভাগ্নিটা মোবাইল এনে দিলে চুপিসারে বারান্দায় গিয়ে বসলো সে। ভাইয়ার মোবাইলের মেসেজ অপশনে গিয়ে লিখলো, আমার বিহেভের জন্য সরি। আই লাভ ইউ। তারপর সেটা বোনের নাম্বারে সেন্ড করে দিয়ে সেন্ড মেসেজ অপশন থেকে ডিলেট করে দিলো। আবার বোনের মোবাইলে মেসেজ টাইপ করলো আমি সরি। আই লাভ ইউ। তারপর সেটা সেন্ড করলো দুলাভাইয়ের নাম্বারে। তারপর সেটাও সেন্ড অপশন থেকে ডিলেট করে দিয়ে ভাগ্নিকে বললো দুলাভাইয়ের মোবাইলটা আস্তে করে পাশে রেখে আসতে, যেন টের না পায়। আর বোনের মোবাইলটা টেবিলের উপর রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
৫/১০ মিনিট পর আবার এসে নিজের রুমে ঢুকলো। দেখলো বোন তখনো মুখ ভার করে বসে আছে। বোনকে দেখিয়ে বোনের মোবাইলটা হাতে নিয়ে বললো, আপু ভাইয়ার নাম্বার থেকে তোমার নাম্বারে একটা মেসেজ এসেছে দেখছি!
- কই, দেখি! মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেসেজটা দেখলো আপু। মেসেজটা পড়তেই গালে রক্তিম আভা ছড়ালো।
হাসি চাপতে আরেকদিকে মুখ ফেরালো রুমাইসা।
একটু পর সামনের রুম থেকে ভাইয়ার ডাক শোনা গেল। আপুকে ডাকছেন তিনি। সাথে সাথেই উঠে গেলো আপু।
সামনের রুম থেকে দুলাভাই আর আপুর হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। মুচকি হেসে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো রুমাইসা। মিনার থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি আসছে। মুয়াজ্জিন মানুষকে নামাজের দিকে ডাকছে। প্রশান্ত মনে সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নামাজের দিকে গেল রুমাইসা, এভাবেই ভালোবাসার রঙধনু হৃদয় থেকে হৃদয়ে ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে........
বিষয়: বিবিধ
১৮৮৯ বার পঠিত, ৩৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"জীবনধারণের জন্য খুব বেশি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন নেই। হালাল উপায়ে খেয়ে পড়ে মোটামুটি সচ্ছলভাবে সম্মানের সাথে জীবন অতিবাহিত করতে পারলেই যথেষ্ট।"
অথর্ কখনোই সুখের উৎস নয়।
"অথর্ কখনোই সুখের উৎস নয়।"
শুভকামনা।
' আমিতো পাগল হয়ে এ লেখার টানে ,
ছুটে আসি মুগ্ধ হয়ে
রুবাইয়ার ব্লগের পানে ! '
মন্তব্যের মধ্যে কেমন যেন ফাঁকিবাজ ফাঁকিবাজ গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে!: :
মসলা+আদা = মসলাদা
খুব সুন্দর লাগলো গল্পটি অনেক ধন্যবাদ
সুন্দর মন্তব্য...মিষ্টি মিষ্টি...ধন্যবাদ টাইপ করলাম>সুপ্রিয় ভিশুজ্বীকে সিলেক্ট করে>সেন্ড বাটন টিপলাম
দেখুন রিপ্লাই মেসেজ চলে এসেছে!
ঠিক আছে রাহবার আপনি হারিকেনকে ধরেন, আমি আশা জাগানিয়াকে ধরছি!
মন্তব্য করতে লগইন করুন