ভালোবাসার রঙধনু.........(২য় পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন ইশরাত জাহান রুবাইয়া ১৩ জানুয়ারি, ২০১৪, ০১:০৩:৪২ রাত
স্বামী স্ত্রী তো একে অপরের আয়নার মত, পোশাকের মত, কিন্তু বাস্তবে যেন অনেকেই প্রতিপক্ষরূপে সংসার করছে! এমন কি তুচ্ছ কারণে মনোমালিন্যতা অনেক সময় ডিভোর্স পর্যন্ত গড়ায়! এই তো সেদিন মামাতো বোন রিমি খুব রাগারাগি করে বাবার বাড়ি চলে এলো। কি হয়েছে জানতে চাইতেই বললো সে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসলেই তার স্বামীর মুখ কালো হয়ে যায়। একদিন পার হতে না হতেই ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। কেন, তাঁর ছোট বোনটাতো বাবার বাড়িতেই বেশি থাকে, তাহলে বউকে বাবার বাড়িতে দুটো দিন বেড়াতে দিতে তাঁর এত আপত্তি কেন?
সব শুনে রুমাইসা বললো,
- আচ্ছা, ভাইয়া তো অফিসের কাজের কারণে কখনো ১ সাপ্তাহ বাইরে থাকেন। তখন তুমি বেড়াতে আসলে কি তিনি এখন রাগারাগি করেন?
- না, তখন তো করেনা!
- তাহলে এরকমটা কেন হয়, তুমি একটু ভেবে দেখলেই বুঝে যেতে।
- কেন হয়?
- আমার মনে হয় কারণটা হলো, ভাইয়া তোমাকে খুব ভালোবাসেন। কিন্তু বলতে প্রেস্টিজে বাঁধে আরকি! সারাদিন অফিস শেষে বাসায় এসে তোমাকে না দেখলে খারাপ লাগে উনার। এ কারণেই তিনি চাননা, তিনি বাসায় থাকা অবস্থায় তুমি তাঁর থেকে দূরে কোথাও থাকো। অবশ্য উনি এটা বুঝিয়ে বললেই কিন্তু এত জটিলতা তৈরী হতোনা, বরং ভালোবাসা আরো বৃদ্ধি পেতো। সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইগো কে দূরে রাখা উচিত। সম্পর্কের বন্ধনগুলির ক্ষেত্রে ভালোবাসা প্রকাশে ভালোবাসা আরো বাড়ে। তিনি যখন বুঝাতে পারছেননা, তুমি তো বুদ্ধিমতি। তুমিই বুঝি নাওনা!
হেসে ফেললো রিমি।
- তা যা বলেছিস! কিন্তু তাই বলে কি বাবার বাড়ি বেড়াবোনা?
- তা তো অবশ্যই বেড়াবে। কিন্তু মাসে যে কয়টা দিন তিনি কাজে বাইরে থাকেন, ঐ কয়টা দিন তো তুমি নিশ্চিন্তে বেড়াতে পারো।
- ঠিক বলেছিস! এভাবে তো ভাবিনি আগে!
- ভাবা তো উচিত তাইনা?
- হুম.. ধন্যবাদ তোকে। কালই চলে যাব আমি।
ঘটনা কি ১/২টা? আরো কত আছে! কিংবা দোষ কি শুধু এক পক্ষেরই! না! কিন্তু অনেকেই শুধু মেয়েটিকেই বদলে যেতে অথবা মানিয়ে নিতে বলেন! সংসার কি কখনো একার প্রচেষ্টায় সুখী হয়? একপক্ষই কেন শুধু নিরবিচ্ছিন্ন ত্যাগ করে যাবেন? অনেকসময় একপক্ষের এই নিরবিচ্ছিন্ন ত্যাগকে অপরপক্ষ অনুভব করতে বা মূল্যায়ন করতেও চায়না! তখন সম্পর্কটা জটিলই থাকে। সংসার যেহেতু দুজনার, তাই দুজনকেই এর পরিচর্যায় সচেষ্ট থাকতে হবে।
স্বামী যেমন চান, তাঁর স্ত্রী কথা-বার্তা চালচলনে তাঁর কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় রূপে উপস্থাপন করুক, তাঁর ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভালোলাগা, মন্দলাগার দিকে খেয়াল রাখুক, তেমনি স্ত্রীও চান স্বামীকে তদ্রুপ দেখতে, তাঁর কাছ থেকেও অনুরূপ যত্ন পেতে। অনেকেই বলেন “সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে”।
কিন্তু তার পরের লাইনটা যে “গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে”, এটাই ভুলে যান। স্ত্রীকে খাদিজা রাঃ, আয়েশা রাঃ এর মত স্ত্রী হতে উপদেশ দেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাঃ এর জীবন থেকে সর্বোত্তম স্বামীর আদর্শকে গ্রহণ করতে, তা মেনে চলতে, নিজেই ভুলে যান!
সেদিন রাস্তায় দেখলো এত মানুষের সামনে এক স্বামী অকথ্য ভাষায় স্ত্রীকে গালিগালাজ করছে। স্ত্রী বেচারী করুণ মুখে নিশ্চুপ হয়ে আছে। চোখে অশ্রু টলমল করছে তাঁর। কোন সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন স্বামী কি এমনটা করতে পারে? স্ত্রীর উপর এহেন বীরত্ব দেখায় কাপুরুষ! সত্যিকার পুরুষ নয়! একটা মেয়েকে তাঁর বাবা মা পরিচিত স্বজন, আজন্ম বেড়ে উঠা বাসস্থান, বন্ধুমহল সবকিছু ছেড়ে স্বামীর কাছে চলে আসতে হয়। অথচ সেই স্বামীই যদি ভালোবাসাময় আশ্রয় না হয়, তাহলে সে সংসার করবে কি করে! পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে স্ত্রী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। স্বামীও নির্যাতনের স্বীকার হন ক্ষেত্র বিশেষে, তবে ভিন্নভাবে।
এমনটা কেন হয়? এত আগ্রহ নিয়ে দুজন মানুষ স্থায়ী বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর দুদিনের মাথায় কেন বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে? এই প্রশ্নগুলি রুমাইসাকে প্রায়ই ভাবায়। সে বুঝতে পেরেছে শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ না থাকার কারণেই সম্পর্কগুলি দিন দিন ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। শরীয়াতের যথাযথ জ্ঞান ও তার প্রয়োগ না থাকার কারণেই একে অন্যের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে উদাসীন। আর এসবের সূত্র ধরেই পরকীয়ার প্রসার বাড়ছে, তুচ্ছ মনোমালিন্যতা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াচ্ছে।
রুমাইসার মনে হয় বিবাহিত জীবনে প্রবেশের আগে ছেলে মেয়েদের স্বামী স্ত্রীর একে অপরের অধিকার সংক্রান্ত বিধানাবলি, উত্তম স্বামী স্ত্রীর বৈশিষ্ট্যগুলি পড়ে নেয়া উচিত, সুখী দম্পতিদের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা উচিত, যাতে পরবর্তীতে এসব দিয়ে নিজেদের জীবনকে রাঙাতে পারে। স্বামী স্ত্রীর মাঝে মান অভিমান হতেই পারে। আর মাঝে মাঝে এরূপ হওয়া মন্দও নয়! কেননা এতে অভিমান দূর হওয়ার পরে মনের দিক থেকে তারা আরো কাছাকাছি হয়। কিন্তু সেই মান অভিমানের ও একটা সীমা থাকা উচিত। মনোমালিন্যতার বিষয়গুলি শুরুতেই নেগেটিভভাবে না নিয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে এর পজিটিভ নেগেটিভ দুই দিকই ভেবে দেখা উচিত।
সম্পর্কের বন্ধনগুলি রঙীন সুতার মত। সুতা যেমন রিলে সুন্দর করে জড়ানো থাকে, সম্পর্কের বন্ধনগুলিও শারীয়াতের রিলে যত্ন করে জড়িয়ে রাখা উচিত। কারণ ইসলামী শারীয়াতই স্বামী স্ত্রীর অধিকার, দায়িত্ববোধ, ভালোবাসা, কর্তব্য সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর শিক্ষা দিয়েছে। সম্পর্কের এইসব অসংলগ্নতা আহত করে রুমাইসাকে। তাই ইদানীং নতুন এক মিশনে নেমেছে সে। পরিচিত অঙ্গনে কোন স্বামী স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্যতা দেখলে ভালোবাসার রঙধনু ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে সে।
গতকাল ছোট চাচীমার মন খারাপ দেখেছে। সদা হাসোজ্জ্যল মানুষটা কেমন যেন অন্যমনস্ক ছিলেন। ছোট চাচীমার সাথে তার সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মত। একবার যাওয়া দরকার। চাচীমার মনখারাপের কারণটা জেনে চেষ্টা করবে তা দূর করতে।
বিকেল হতেই বাইরে বের হলো রুমাইসা। ছোট চাচুর বাসায় যাবে বলে। বাইরে বেশ শীত পড়েছে আজ। স্কার্ফের উপরে শাল চড়িয়েছে, তবুও শীত মানছেনা। চাচুর বাসায় পৌঁছে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিলেন চাচীমা। শীতে হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকলো সে। ওর ভঙ্গি দেখে হাসি চাপতে পারলেননা তিনি।
- কি রে, বাইরে বুঝি খুব শীত?
- হ্যাঁ! হাসছো কেন?
- তোকে দেখে। যেদিন তোকে আপাদমস্তক শীতের কাপড় পড়তে দেখি, সেদিন যে শৈত্যপ্রবাহ চলে, এটা আমি বুঝে যাই!
হাসে রুমাইসাও। শীতের কাপড় সহজে পড়েনা সে। তাই যেদিন পড়ে, সেদিন সবাই আন্দাজ করে শৈত্যপ্রবাহ চলছে।
চাচীমার সাথে গল্প করতে করতে খেয়াল করে তাঁর মনটা আজও অন্যমনস্ক। এই সেই কথা বলতে বলতে কথাটা জিজ্ঞেস করে ফেলে।
- চাচীমা, আমি কালও দেখেছি, কি এক বিষন্নতা যেন ঘিরে রেখেছে তোমাকে। সত্যি করে বলতো কি হয়েছে? চাচুর সাথে কিছু হয়েছে কি?
- না রে!
- কিছু একটা তো অবশ্যই হয়েছে! নইলে তোমাকে এমন লাগছে কেন?
-আসলে সারাদিন বাসায় একা একা থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছি। তোর চাচু সেই সকালে যান। আসতে আসতে বিকেল। এসে খানিকটা নাস্তা করেই আবার কাজ নিয়ে বসেন। দু দন্ড কথা বলার সুযোগও হয়না। আস্তে আস্তে নিঃসঙ্গতা আমাকে বদলে দিচ্ছে। এই আর কি। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন চাচিমা।
- চাচু কোথায় এখন?
- বাসায়। তাঁর স্টাডি রুমে। তুই বোস। আমি কিচেনে যাচ্ছি। চা দেয়ার সময় হয়ে এলো।
- না, তুমিই বসো। আমি চা বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছি চাচুর কাছে। তাঁর সাথে আমার কিছু বোঝাপড়া আছে।
চাচীমাকে জোড় করে বসিয়ে রেখে চা বানাতে গেল রুমাইসা।
পাগলী মেয়ে! স্মিত হেসে স্নেহের দৃষ্টিতে ওর গমন পথে চেয়ে আনমনে বললেন তিনি।
চলবে......।
বিষয়: বিবিধ
১৮৩১ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চলতে থাকুক
ভালো লেগেছে জেনে আমারো ভালো লাগলো।
যাক আপনার মন্তব্য পড়ে মনে হচ্ছে আমার পর্যবেক্ষন কিছুটা হলেও ঠিক পথে এগুচ্ছে।
সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ সুপ্রিয় আপুজ্বী।
এইবারো কি না পড়েই মন্তব্য করেছেন? :
অসাধারন মিশনের জন্য আপুটাকে ধন্যবাদ। যে অন্যের জীবনকে সাজায়, আল্লাহ্ তার জীবনকে সাজিয়ে দেন। আপুটার জন্য দু’আ রইল
'যে অন্যের জীবনকে সাজায়, আল্লাহ্ তার জীবনকে সাজিয়ে দেন" আপু আপনার এই কথাটা খুব খুউব ভালো লাগলো।
আল্লাহ আপনার দুআ কবুল করুন। আপনার জন্যও অনেক অনেক দুআ রইলো সুপ্রিয় আপুজ্বী।
অসাধারণ লিখেছেন
খুব ভাল লাগল
JazakAllah for your nice educative story.
মন্তব্য করতে লগইন করুন