Rose ঘূণে ধরা নষ্ট মানসিকতায় বিবেক যখন বন্দি। Rose(শেষ পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন ইশরাত জাহান রুবাইয়া ১৬ নভেম্বর, ২০১৩, ০৪:২২:২৬ বিকাল

মেহমান বিদায় নিতেই রাতের খাওয়া সেরে সামিহাকে নিয়ে বসলেন মা আর খালামনি।

- এবার বল, তোর মত কি? আর মন খারাপই বা কেন?

সামিহা কখনো এসব ব্যাপারে মায়ের সাথে ফ্রি ছিলোনা। মনে মনে কথাগুলি গুছিয়ে নিয়ে শুরু করে সে।

- দেখুন, দুজন মানুষ যখন আজীবন পথ চলার নিয়াতে একটা গুরুত্বপূর্ণ বন্ধনে আবদ্ধ হতে যায়, তখন উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা, এসব ব্যাপারে তাদের মাঝে কিছুটা কথাবার্তা হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু তখন পর্যন্ত তারা গাইরে মাহরাম, তাই এক্ষেত্রে তাদের মাঝে কোন একজন মুরুব্বীর উপস্থিতি বাঞ্ছনীয়। আমি মনে করি দাদী নানীরা কেউ উপস্থিত থাকতে পারেন, কেননা নাতি নাতনীরা উনাদের সাথে ফ্রি থাকে বেশি, তাই উনাদের কেউ সামনে থাকলে তারা কথা বলতে সংকোচ বোধ করবে কম।

আমাকে যে পরিস্থিতিতে গিয়ে পড়তে হয়েছে, আমি উনার সাথে কোনকথাই বলতে পারিনি। আসলে এত মানুষের মাঝে কথা বলার মত কোন পরিবেশই পাইনি। এত মানুষ না থেকে শুধু ফাইজ সাহেবের দাদীর থাকাটাই যথেষ্ট ছিল। উনি তো আমার সম্পর্কে অনেককিছুই জেনে নিলেন, আমার কি উনার সম্পর্কে কিছু জানার ছিলোনা? অবশ্যই ছিল। কিন্তু আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ বা পরিবেশ তৈরী করে দেয়া হয়নি কেন?

দ্বিতীয়তঃ উচ্চতা নিয়ে ফাইজ সাহেবের মায়ের খুব মাথাব্যাথা দেখলাম। পারেন তো গজফিতা নিয়ে মেয়ের উচ্চতা মাপতে আসেন! যেন উচ্চতাটাই সবকিছুর মূল, সেটাই মূখ্য! অথবা মানুষ নিজের উচ্চতা কমানো বা বাড়ানোর ক্ষমতা রাখে! ছেলের উচ্চতার ব্যাপারে আমি বলেছিলাম আমার চাইতে কিছুটা লম্বা হলেই হবে। কোন মেয়ে চায়না তার স্বামীর উচ্চতা তার চাইতে কম হোক, এটা দেখতে কেমন বৈসাদৃশ্য দেখায়। বায়োডাটার হিসাবে তিনি আমার চেয়ে একইঞ্চি লম্বা। আমি এতে আপত্তি করিনি। কিন্তু বাস্তবেতো তা নন, ওরা মিথ্যে বললো কেন? তারা যদি মেয়ের উচ্চতা নিয়ে এত কাহিনী করে, এতভাবে উচ্চতা যাচাই করতে চায়, তবে আমিও তো তাদের ছেলের উচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি!

তৃতীয়তঃ আমি চাই আমি যাকে বিয়ে করবো, তাঁকে অন্তত আগ থেকেই ফরয আর ওয়াজিব পালনে যত্নবান থাকতে হবে। দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে আমি ছাড় দিতে রাজি নই। ছেলেদের জন্য একমুষ্ঠি পরিমাণ দাড়ি রাখা ওয়াজিব। উনার দাড়ি এত ছোট কেন? উনার দাড়ি কেটে ছোট করে আধমুষ্ঠি ফ্যাশনেবল দাড়ি রাখাকে আমি মোটেও মানতে পারছিনা। আপনি সাদকে জিজ্ঞেস করেন, সাদ বলেছে উনি বলেছেন উনি যেখানে থাকেন, দাড়ি রাখতে সমস্যা, এজন্য নাকি উনি দাড়ি ছোট রাখেন। আপনি হয়তো বলবেন বিয়ের পরে তুমি উনাকে বুঝিয়ে ঠিক করে নিও, কিন্তু এখানেও আমার আপত্তি। মালিহা আপুকে দেখেননি, দ্বীনহীন পাত্রকে বিয়ে করে দ্বীনের পথে আনতে আট বছর লেগেছে। কত ত্যাগ, কত কষ্ট, কত চোখের পানি ফেলতে হয়েছে তাকে, আমি জানি। যে ফরয আর ওয়াজিব আদায়ে যত্নবান থাকে, তাকে সুন্নাত আদায়ে উত্‍সাহ দিয়ে সামনে এগুনো যায়। আর হেদায়েত তো আল্লাহর হাতে, উনার যে ধরণের মানসিকতার কথা শুনেছি, সবক্ষেত্রেই যদি এমন মানসিকতাই থাকে তবে তো আমার কথায় উনি কতটুকু গুরুত্ব দেবেন আল্লাহই জানেন।

চতুর্থতঃ বিয়ের আগে পাত্র ছাড়া অন্য কোন গাইরে মাহরাম পুরুষ পাত্রীকে দেখতে পারেনা। আর পাত্রও শুধু পাত্রীর চেহারা আর দুহাতের কব্জি ছাড়া অন্য কোন অঙ্গ দেখার অধিকার রাখেনা। সেখানে যারা বিয়ের আগেই অন্য গাইরে মাহরামের সামনে যেতে বলে, পাত্রের সামনে টান দিয়ে মাথার কাপড় ফেলে চুল ছড়িয়ে দেয়, তারা বিয়ের পরে আমার কতটুকু পর্দার নিশ্চয়তা দেবে, আমি সন্দিহান। একসাথে এতগুলো কথা বলে থামলো সামিহা।

- ঠিক আছে সামি। ওরা যদিও আজ বলে গেছে ওদের সবার সব পছন্দ হয়েছে, আর ছেলের মত জেনে কাল জানাবে, তবুও আমি যা করি তোকে জানিয়ে চিন্তা ভাবনা করেই করবো ইনশা আল্লাহ। সাদ আমাকেও বলছিলো ওরও ভালো লাগছেনা, ওরও মনে হয়েছে এই ছেলে দ্বীন পালনে উদাসীন। আচ্ছা, ফাইজের মা কাল ফোন করে কি জানায় আগে দেখি, তারপর এসব বিষয় তুলে ধরবো আমি। এখন ঘুমাতে যা, বড্ড ধকল গেছে আজ।

বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে সামিহা। ঘুম কি আসবে সহজে! মনে বড্ড অশান্তি। ইস্তিগফার পড়তে থাকে সে।

-এই উঠ জলদি! খালামনির ডাকে ঘুম ঘুম ভাঙে তার। বিছানায় উঠে বসে সে। এপাশ ওপাশ করতে করতেই ফজর হয়ে গিয়েছিল। নামাজ পড়ে আবার ঘুম দিয়েছে। ঘুম ঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

- কয়টা বাজে?

- দশটা বাজে! পাজি মেয়ে রাতেও খায়নি, গ্যাসট্রিক বাঁধাবে! জলদি উঠ!

উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নেয় সামিহা। কাছেই মেঝোমামার বাসা, মামী কাল থেকেই খুব করে বলছেন যাওয়ার জন্য, সেখান থেকে ঘুরে আসবে বলে ঠিক করে। সেখান থেকে আসতে আসতে বিকেল হয়ে যায়। এসে চুলায় চায়ের পানি চাপাতেই সামনের রুমে খালামনির মোবাইলটা স্বশব্দে বেজে উঠে। সামিহা বুঝতে পারে কে ফোন দিয়েছে। ফোনালাপ শেষে সামনে যায় সে। খালামনির চেহারার দিকে তাকিয়েই থমকে যায়। একটা চাপা ক্রোধ ছিটকে পড়ছে চেহারা থেকে।

- কি হয়েছে খালামনি? আস্তে করে জিজ্ঞেস করে সে।

- কত্ত বড় সাহস! নিজেদের ছেলেকে ভাবে কি!

- কেন, কি বলেছে?

- বলেছে কি জানিস! বলেছে, আপা আমাদের তো পছন্দ হয়েছিলো, এখন ছেলে বলছে মেয়ের নাকটা একটু মোটা, এজন্য ওর পছন্দ হচ্ছেনা! ছেলের অপছন্দের কারণ শুনে আমি তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়! পরে আবার একটু ইতঃস্তত করে বলে কি, আপা আপনাদের ফ্যামিলিটা আমাদের অনেক পছন্দ হয়েছিলো, তাই বলছিলাম কি, মেয়ের ছোটবোনটা কেমন? ছোটবোনকে ছেলেটার জন্য দেখতাম! কতবড় অসভ্য হলে এ ধরণের চিন্তা করতে পারে! আমি অনেক কষ্টে নিজের মেজাজ সামলে নিয়ে বলেছি, আমরা এমনিতেও আমাদের সামিহাকে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিতামনা। আর ওর ছোটবোনের কথা তুলতেই আপনার লজ্জা করা উচিত ছিল!

সামিহা অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। চুপ করে ভিতরের রুমে এসে বসে।

বাহির থেকে তাশফির আব্বুর রাগত কন্ঠের আওয়াজ পাওয়া যায়, ফাইজের মাকে বলে দিও, তার ছেলে কতটুকু যোগ্য তা যেন নিজে যাচাই করে দেখে। কতবড় অসভ্য হলে সামি মনিকে এভাবে অপমানিত করে আবার ওর ছোটবোনের প্রসঙ্গ তুলে! সামির এতগুণের কথা জেনে শুরুতে সে এত অস্থির হয়ে গিয়েছিলো কেন? তখন বলেনি কেন মেয়েকে নিঁখুত রাজকন্যা হতে হবে? তার ছেলের মত এমন শিক্ষিতমূর্খ ছেলে আসলে সামিহার অযোগ্য। আরো বলে দিও, সে যতদিন দেশে আছে, আমি যদি ওকে আর এই এলাকার আশে পাশে দেখি, ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিব!

সকালে বাসায় চলে এসেছে সামিহা। অনেক সেধেছেন খালামনি কটা দিন থাকার জন্য। কিন্তু ক্লাস খোলা, এই অজুহাতে চলে এসেছে সে। সকালে ক্লাসেও এসেছে না খেয়ে। মিসেস রাদিয়া অনেক সেধেও খাওয়াতে পারেননি। ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। গতকয়েকদিনের ঘটনাগুলি ভুলতে পারছেনা। মানুষ এত নিচু মানসিকতার হয়! এত ঘূণে ধরা বিবেক নিয়ে কেউ কি মানুষের কাতারে পড়তে পারে! যদি মানসিকতাই এত নিচু হয়, কি লাভ হলো ফাইজের এত এত ডিগ্রিধারী হয়ে! ফাইজের সাথে বিয়ে হয়নি বলে মোটেও তার মন খারাপ নয়, সে বরং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছে, ফাইজের সাথে বিয়ে হয়নি বলে। সামিহার মন খারাপ ঘূণে ধরা এই নষ্ট সমাজের কথা ভেবে, যেখানে গুণ, মেধা, সত্‍চরিত্র, ধার্মিকতা, সব গৌণ হয়ে যায় রূপসী রাজকন্যা না হওয়ার কারণে!!!

(সামিহা (ছদ্মনাম) আমার পরিচিত একজন মেয়ে। তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা গল্পে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছি আমি। বর্তমানে এই সময়ে এসেও মেয়ে দেখার নামে কিছু পাত্রপক্ষ মেয়েদেরকে কিভাবে নাজেহাল করে, তার একটি খন্ডচিত্র এটি, (অবশ্য সবার ক্ষেত্রেই যে এমনটি ঘটে, তা নয়), প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন এবং সচেতনতা। মানুষ দাবীদার কিছু জীবের নতুন করে মানুষ হওয়া উচিত। প্রাণ থাকলেই প্রাণী হয়, কিন্তু বিবেক না থাকলে কেউ মানুষ হতে পারেনা। যারা এতদিন কষ্ট করে লেখাটি পড়েছেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ।)

বিষয়: বিবিধ

১৬৮৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File