সময় কখন শেষ হবে তা নেই জানা।
লিখেছেন লিখেছেন ইশরাত জাহান রুবাইয়া ২০ অক্টোবর, ২০১৩, ০৫:৪২:৫১ বিকাল
সেদিন আরবী ক্লাসে আলোচনা চলছিল মৃত্যু নিয়ে। পৃথিবীতে আসার সিরিয়াল আছে, কিন্তু যাওয়ার সিরিয়াল নেই। দাদার পর বাবা, বাবার পর আমরা আসি, কিন্তু যাওয়ার সময় এই সিরিয়াল থাকেনা। যার যখন সময় শেষ হয়ে আসে, তাকে তখনই বিদায় নিতে হয়।
আমরা আলোচনা করছিলাম কাছ থেকে দেখা মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া অল্পবয়সী অথবা হঠাত্ করেই মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া সুস্থসবল মানুষদের মৃত্যুর ঘটনাগুলি নিয়ে। এক ফাঁকে উস্তায একটা ঘটনা বললেন। উনার গ্রামে, উনার বাড়ির কয়েক বাড়ি পরে বেশ বিত্তশালী এক লোক থাকতেন। তাঁর বেশ কয়েকজন ছেলে ছিল। লোকটি মারা যাওয়ার আগে তাঁর ছেলেদেরকে ওয়াসিয়াত করে গেলেন, এলাকার মাসজিদ-মাদ্রাসা সংলগ্ন তাঁর যে জমিটা আছে, উনি মারা যাবার পর ঐ জমিটা যেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে ওয়াকফ করে দেয়া হয়, যেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাঁদের মাদ্রাসাটি আরো সম্প্রসারিত করে আরো বেশী ছাত্রদের ই'লম অন্বেষণের সুযোগ করে দিতে পারেন।
লোকটি মারা যাবার পর তাঁর বড় ছেলে ঐ জমিটি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেন। কিছুদিন পর এলাকায় নির্বাচন হলে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দিতা করেন তিনি। কিন্তু তিনি সত্ ও যোগ্য ব্যক্তি না হওয়ার কারণে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাকে সমর্থন দেননি। নির্বাচনে তিনি হেরে যান। এতে তিনি খুব ক্ষুব্ধ হন এবং ভাবেন, এত বড় একটা জমি দেয়া হল, অথচ হুজুররা তাকে সমর্থন দিলনা, কেমন অকৃতজ্ঞ! এই জমি তাদেরকে দেয়া উচিত হয়নি! অথচ নিজের অযোগ্যতা আর অসততার কথা ভেবে দেখলেননা তিনি। ভেবে দেখলেননা, প্রকৃতপক্ষে তিনি সমর্থন পাওয়ার মত যোগ্য প্রার্থী ছিলেন কিনা।
পরবর্তী জুমআ'র দিনে তিনি ঐ মাসজিদে নামাজ পড়তে গেলেন। নামাজ শেষে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলতে চাইলেন। নামাজ শেষে যারা চলে যাচ্ছিলেন, সবাই উনার কথা শুনতে আবার বসলেন। তিনি ঐ মাসজিদের খতীব এবং অত্র মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা এইযে জমিটা আমার পিতা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে ওয়াকফ করে দিয়েছেন, এতে আমার পিতার কবরের আযাব কতটুকু মাফ হয়েছে, তিনি কতটুকু শান্তিতে আছেন এখন, আমাকে বলুন! খতীব সাহেব বললেন, ভাই, তিনি যা করেছেন এটা সাদকায়ে জারিয়াহ। এটা তিনি নিজের পরকালীন জীবনের কল্যাণের জন্যই করেছেন। কিন্তু আপনি যা জানতে চাইছেন তাতো আলমে বারযাখের বিষয়, আমরা বলবো কি করে! তবুও তিনি গোঁ ধরে রইলেন। বললেন, আপনারা বলতে না পারলে ওয়াকফ করা ঐ জমিটা আমি নিয়ে যাবো। তখন একজন উঠে বললেন, আপনার ভেতরে এই মূহূর্তে অনেক রাগ আর ক্ষোভ আছে, তাইনা? আচ্ছা, আপনি বলুনতো আপনার রাগের রং কি? রাগের ওজন কতটুকু? রাগ দেখতে কেমন? সবকিছুই কি চর্মচক্ষে দেখা সম্ভব? আলমে বারযাখের বিষয় আপনি চর্মচক্ষে দেখবেন কি করে?
তিনি তার সিদ্ধান্তে অনঢ় রইলেন। খতীব সাহেব হেসে বললেন, ভাই, আল্লাহর দ্বীন প্রচারে আল্লাহ কারোর মুখাপেক্ষী নন। আপনি চাইলে জমিটি এখুনি নিয়ে নিতে পারেন। কেউ বাঁধা দেবেনা। আপনাদের জমি নেয়ার কোন প্রয়োজনই আমাদের নেই। লোকটি জমি আবার নিজ মালিকানায় নিয়ে নিলেন। অথচ ওয়াকফকৃত জমি কেউ আবার নিজ মালিকানায় নেয়ার অধিকার রাখেনা। তিনি দুইটা অপরাধ করে বসলেন। ১. আলমে বারযাখের বিষয়ে সন্দেহ। ২. আল্লাহর রাহে ওয়াকফকৃত জমি নিজ মালিকানায় নিয়ে নেয়া।
সেদিন রাতে লোকটার প্রচন্ড জ্বর এলো। সারা শরীর প্রচন্ড ব্যাথায় নীল হয়ে গেল। পরদিন হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। অবস্থা খুব সংকটাপন্ন। ডাক্তার বললেন, উনাকে এই মূহূর্তে ঢাকায় নিয়ে যান। ঢাকায় নিয়ে এসে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হলো। পথিমধ্যে তিনি বার বার মাকে বললেন, মা আমি জানি, আমি বাঁচবোনা, আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো।
ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করার পরদিন তিনি মারা গেলেন। মৃত্যুর পর তার সারা শরীর কেমন যেন কালচে হয়ে গেল। প্রচন্ড দূর্গন্ধে নাক মুখ চাপা দিয়ে লাশের কাছে যেতে হচ্ছিল। ডাক্তার বললেন, তার শরীরের ভেতরের সবকিছুই পঁচে গেছে। লাশ গ্রামে নিয়ে আসা হলো। তার ভাইয়েরা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলেন, ওয়াকফকৃত জমিটি আবার নেয়ার জন্য, তার জন্য দুআ করার জন্য এবং মাসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে লাশটি দাফন করার জন্য। কর্তৃপক্ষ জমিটি ফিরিয়ে নিলেন এবং তার পাশেই তাকে দাফন করা হলো।
ঘটনাটা শোনার পর আমরা অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে ছিলাম। আসলে মানুষ বড়ই অস্থিরপ্রবণ! সে জানেনা তার আয়ু আর কতটুকু, জানেনা কখন থেমে যাবে দেহঘড়ি, অথচ সে হাজারো পরিকল্পনা সাজায়! আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কখনো কখনো কুপ্রবৃত্তির আনুগত্য করতে গিয়ে অসন্তুষ্ট করে ফেলে তার মহিমান্বিত রবকে। কখনো এই অবস্থাতেই নেমে আসে মৃত্যুর ভয়াবহ অমানিশা! মৃত্যু তো কখনো জীবনের সমাপ্তি নয়, মৃত্যু হল অনন্ত জীবনের শুরু।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে বেশি বেশি নেক কাজ করার, পূর্ণ মুমিন হওয়ার এবং তাঁর অনুগত ও বাধ্যগত বান্দা হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৯০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন