ঘূণে ধরা নষ্ট মানসিকতায় বিবেক যখন বন্দি। গল্প পর্ব-৪
লিখেছেন লিখেছেন ইশরাত জাহান রুবাইয়া ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৪:২৮:৫১ বিকাল
মা আর খালামনি মেহমানদের অভ্যর্থনা জানাতে সামনে এগুলেন। সামিহা একছুটে ভেতরের রুমে চলে গেল। ইচ্ছে হচ্ছে মাটিটা ফাঁক হয়ে যাক আর তার ভেতরে সে ঢুকে পড়ুক! ভারী শাড়িটা সামলে রাখতে পারছেনা, তার উপর চিন্তা আর অস্বস্তিতে ঘেমে একসার হয়ে গেছে। নাবিলা আন্টি মুচকি মুচকি হাসছেন ওর কান্ড দেখে! বললেন,
- অত ভেবোনা! মেয়ে অপছন্দ হওয়ার কোন কারণ নেই।
- আন্টি, আমি তো সেটা নিয়ে চিন্তিত নই! আমি সামনে যাব কিভাবে, তা নিয়ে চিন্তিত!
- এত চিন্তার কিছু নেই, ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নাও, দেখবে একটু পরেই সহজ মনে হবে। চোখের নিচে কাজল দাওনি কেন? একটু কাজলের রেখা টেনে দাও। কাজলের পেন্সিলটা এগিয়ে দিলেন।
- না থাক লাগবেনা! কারো সামনে সাঁজতেও তার লজ্জা লাগে।
- কি মেয়েরে বাবা! বলে মুখটা টেনে নিয়ে নিজেই চোখে কাজল লাগিয়ে দিলেন। দরজা দিয়ে সারা উঁকি দিলো। জানালো, পাত্রের দাদী, মা, আর দুইবোন এসেছে। পাত্র আসেনি।
পাশের রুম থেকে ফাইজ সাহেবের মা আর মিসেস রাদিয়ার কথোপকথন শোনা যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা বলছেন, আপা বলছিলাম কি, আমি, আমার শাশুড়ি আর দুই মেয়ে আগে দেখি। আমাদের পছন্দ হলে পরে নাহয় ছেলে দেখবে। আপনার কি মত? মিসেস রাদিয়াও এতে সম্মত হলেন। সামনের রুম থেকে তাশফি এসে পাশে বসলো।
- দেখো, ছোটবোনটা এসেছে, দেখলেই বুঝবা কত বড় মুডি! বড়বোনটাও এসেছে, বেশি সাদা, এত সাদা আবার....দরজা ঠেলে একটা মেয়েকে ভেতরে ঢুকতে দেখে মাঝপথেই থেমে গেল সে। মেয়েটাকে ভেতরে আসতে দেখে সামিহা সালাম দিল। সালামের উত্তর দিয়ে সে পাশে এসে বসলো।
- আমার নাম জারিফা। বিবাহিতা, একটা মেয়ে আছে। ফাইজ সাহেব আমার বড় ভাই। আমরা দুইভাইয়ের পরে দুই বোন। আমার ভাইয়ের বায়োডাটা পড়েছেন তো আপনি, তাইনা?
নিরবে মাথা দোলায় সামিহা।
- আমার ভাইয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক, দেখতেও ভালো। একটাই ঘাটতি, তা হলো উচ্চতা কম, তাই আমার মা লম্বা মেয়ে বিয়ে করাতে চান। বিয়ে হলেও কিন্তু আপনাকে আমাদের সাথে থাকতে হবেনা। বিয়ে করে উনি দেশের বাইরে নিয়ে যাবেন। এতে কি আপনার কোন আপত্তি আছে?
এইসময়ে মিসেস রাদিয়ার সাথে ফাইজ সাহেবের মা, দাদি, ছোট বোন আর বড়বোনের পিচ্চিটা একসাথে ভেতরে ঢুকলো। সামিহা সালাম দিল। বাচ্চাটা ঢুকেই সামিহাকে দেখিয়ে মাকে প্রশ্ন করলো
-আম্মু এতা কে?
-তোমার মামী। পছন্দ হয়?
-হ্যাঁ, আজকেই কিন্তু বাসায় নিয়ে যাবো!
-আজকেই নিয়ে যাবা! আমরাওতো নিতে চাই, জিজ্ঞেস করো মামীকে, আজকেই যাবে কিনা?
সামিহা লজ্জায় অন্য দিকে মুখ ফেরালো। তাই দেখে পিচ্চিটাও হাত দিয়ে মুখ ঢাকলো! সবাই একসাথে হেসে উঠলো।
কুশল বিনিময়ের পর পাত্রের মা সামিহাকে আর তাঁর বড় মেয়েকে একসাথে দাঁড়াতে বললেন। সামিহা তাঁর মেয়ের চাইতেও বেশ লম্বা দেখে খুশি হলেন। সবাই একসাথে বিছানায় বসলো। নানা রকম প্রশ্ন করলেন পাত্রের মা আর দাদি। সামিহা ধৈর্যের সাথে উত্তর দিল। হরেক রকম বাহারি নাস্তা নিয়ে এলেন মা, খালামনি আর মামী। আপ্যায়নের পর্ব শেষ হতে পাত্রের মা বললেন
-আপা, সবকিছুই আমাদের পছন্দ হয়েছে। এবার আমার ছেলেটাকে আসতে বলি, একনজর দেখার জন্য?
-জ্বী বলেন, তবে শুধু ছেলে দেখতে পারবে, অন্য কোন পুরুষ দেখতে পারবেনা।
-ঠিক আছে।
মাগরিবের আজান হচ্ছে। মিসেস রাদিয়া ভিতরের রুমে এসে দেখলেন সামিহা উদাসদৃষ্টিতে জানালা দিয়ে সূর্যাস্ত দেখছে।
-সামিহা!
-জ্বী!
-নামাজের পর ছেলেটা আসবে। ঘেমে নেয়ে কি অবস্থা করেছিস। নামাজ পড়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নে, মা!
-হুম।
অযু করে মাগরিবের নামাজ পড়লো সামিহা। অতঃপর দুই রাকাত সালাতুল হাজত পড়ে দুআ করলো, হে প্রভূ! আমার প্রশান্তি এবং চিন্তায়-অস্থিরতায়, আমার সুখে এবং দুঃখে, আমার সফলতায় এবং ব্যর্থতায়, আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই, আমি শুধু তোমার মুখাপেক্ষী। আমি জানিনা কিসে আমার কল্যাণ আর কিসে অকল্যাণ, কিন্তু তুমিতো জানো! হে মহান মালিক! যা কিছু অকল্যাণ তার থেকে তুমি আমাকে দূরে রাখো। যা কিছু কল্যাণ তা আমার জীবনে এনে দাও। দুনিয়া ও আখিরাতের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বোত্তম বন্ধু ও অভিভাবকরূপে তুমি আমার পাশে থেকো, আর তোমার প্রতিটি সিদ্ধান্তে আমাকে সন্তুষ্ট ও প্রশান্তচিত্ত করে দাও। আমীন। নামাজ শেষে চুপচাপ ভেতরের রুমেই বসে ছিল সে। ফাইজ সাহেবের মা এসে ঢুকলেন। এত চুপচাপ কেন তুমি মা? চলো সামনের রুমে। সামিহার হাত ধরে টেনে নিয়ে তাঁদের সামনে বসালেন। নানারকম গল্প শুরু করলেন পাত্রের দাদী। মহিলারা এক হলে যে কত গল্প করতে পারে! সামিহা চুপচাপ শুনছে।
পাত্রের মা তাঁর ছেলেকে ফোন দিলেন। তার আসতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। আল্লাহর বান্দা বোধহয় সাঁজাসাঁজিতে ব্যস্ত। বিরক্তি লাগছে সামিহার। উফ, কখন সে এই ভারী শাড়ি আর এইসব গয়নাগাটি খুলে একটু বিশ্রাম নেবে! স্ট্যাচুর মত বসে থাকতে বড্ড বিরক্ত লাগে। তার উপর ঐ ছেলে আসলে তার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকতে হবে ভাবতেই টেনশনে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সেই কখন মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখেছে। কেউ ফোন দিল কিনা দেখা দরকার। আস্তে করে উঠে ভেতরের রুমে চলে এলো।
মোবাইল নিয়ে দেখে ১৩ মিসড কল। বাবা, দুইজন বান্ধবী, একজন টীচার ফোন দিয়েছিলেন। একে একে সবাইকে ফোন দিয়ে কথা সেরে নেয় সে। চুলগুলি এলোমেলো হয়ে গেছে, গরমে ঘেমে কাজলও লেপ্টে গেছে। মোবাইলটা রেখে চুল আঁচড়িয়ে, লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছে নতুন করে কাজল দেয়। শাড়ির আঁচল আরেকটু বড় করে নেয়। বেশ কিছু সেফ্টিপিন নিয়ে শাড়ির কয়েক জায়গায় আটকে দেয়, যেন চেহারা আর হাত ছাড়া শরীরের অন্য কোন অংশ দেখা না যায়। তারপর বসে বসে একটা বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকে। কয়েকমিনিট পর ছোট খালুজ্বীর গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। ফাইজ সাহেব আর উনার দাদা এসেছেন। সব মহিলারা অন্য রুমে সরে যায়। জারিফা এসে বলে দাদাও তার নাতবউকে দেখতে চান, দাদার সামনে যাওয়ার ব্যাপারে সামিহার আপত্তি আছে কিনা। মিসেস রাদিয়া এতে অসম্মতি প্রকাশ করে সামিহাকে জিজ্ঞেস করতে বলেন। সামিহা জবাব দেয়, বিয়ে হয়ে গেলে দাদাশশুর মাহরাম বলে গণ্য হবেন। তখন তাঁর সামনে যেতে নিষেধ নেই। কিন্তু ইসলামী বিধান অনুযায়ী এখন শুধু পাত্রই তাকে দেখার অধিকার রাখে। তাই সে পাত্র ছাড়া অন্য কারো সামনে যাবেনা। ঠিক আছে বলে, জারিফা সামিহার হাত ধরে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ায়...
'
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
২১৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন