ঘূণে ধরা নষ্ট মানসিকতায় বিবেক যখন বন্দি। গল্প পর্ব-২
লিখেছেন লিখেছেন ইশরাত জাহান রুবাইয়া ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৯:১৮:৪৫ রাত
...বইটা বন্ধ করে কাগজটা টেনে নিল সামিহা। কিসের গুরুত্বপূর্ণ কাগজ, ভালোমতই বুঝতে পারছে। জনৈক ফাহাদ সাহেবের বায়োডাটা। আদ্যোপান্ত পড়লো সে। ভালোই মনে হলো, সব ঠিক আছে, শুধু পাত্রের উচ্চতা কিছুটা কম, ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। সামিহা নিজেই ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। স্বামী হিসেবে লম্বা কাউকে পছন্দ তার। তবুও এদিকটা ছাড় দেবে সে, যদি বাস্তবিকই ছেলে তার থেকে কিছুটা হলেও লম্বা হয়। অনেকে বায়োডাটায় উচ্চতা লেখার ক্ষেত্রে মূল উচ্চতা থেকে ১ ইঞ্চি বাড়িয়ে লেখে, এমন দেখেছে সে। কাগজটা সরিয়ে বইটা টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করলো। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও পড়ায় মন দিতে পারলোনা। এখন কি আর পড়ায় মন বসার মত অবস্থা আছে! রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনের দিকে গেল সে, এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে বারান্দায় বসে বিকেলটা কাটাবে বলে।
রুম থেকে বেরোতেই মায়ের সামনে পড়লো। মিসেস রাদিয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হঠাত্ করে রাজ্যের যত লজ্জা এসে ভর করলো তার উপর! মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারলোনা। একছুটে কিচেনে ঢুকে গেল সে। চা খেতে খেতে বারান্দায় বসে ভাবছিল ব্যাপারটা। এমনসময় ছোট বোন লামিয়া এসে মোবাইল দিয়ে গেল, নানু ফোন দিয়েছেন। নানুমনি হলেন সামিহার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। কলটা কেটে দিয়ে ব্যাক করলো সে।
- আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন নানু?
- ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। তোমার কি খবর?
- আলহামদুলিল্লাহ শারীরিকভাবে ভালো।
- ক্যানরে আপু, মানসিকভাবে ভালোনা নাকি!
- নাহ!
- কেন, কি হয়েছে?
- এইযে আপনারা দুদিন পর পর আমার বিয়ে নিয়ে খালি কিসব করেন!
- আহা!
"প্রেমের পবিত্র শিখা চিরদিন জ্বলে,
স্বর্গ থেকে আসে প্রেম, স্বর্গতে যায় চলে।
বিধাতার শুভ ইচ্ছা করিতে পূরণ,
মানব জীবনে আসে বিবাহের বন্ধন।"
- হু, আপনার তো খালি সবকিছুতেই কবিতা! আপনার বলা ছন্দগুলি দিয়ে একটা বই বের করবো ভাবছি!
- হাহাহা..ভালো কবিতাই তো বলি, খারাপ কিছুতো না!
- হু, আপনার বন্ধু কি করে?
- আমার বন্ধু! উনি আসর পরে নামাজের বিছানায় বসে আছেন মাগরিবের আজানের অপেক্ষায়। বন্ধুর এখন আর পাত্তা নাইরে ভাই! এককালে সারাদিন কত পিছে পিছে ঘুরেছে! সেই প্রেম কি আর এখন আছে! এখন তো অকারণেই খালি খিটখিট করে, বুড়ো বয়সে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধায়!
- হিহিহি..আচ্ছা আমি ভালোমত বকে দেব!
- নাতনীর বকা খেতে আপত্তি নেই উনার! যাহোক বলো এবার, তোমার বন্ধুর কি খবর?
- আমার বন্ধু?! আমার বন্ধু আসলো কোত্থেকে?!
- আরে যার বায়োডাটা পড়েছো, তিনি আরকি! আল্লাহ চাইলে তিনি তো তোমার বন্ধু হতেও পারেন, তাইনা!
- হু বুঝছি! হইলে পরে বন্ধু বইলেন! এখননা!
- আচ্ছা ঠিক আছে, এখন বলো তোমার কোন আপত্তি আছে কিনা? ছেলের মায়ের ইচ্ছে হলো তাঁর ছেলের উচ্চতা কম বলে তিনি লম্বা মেয়ে বিয়ে করাবেন।
- তাই বলে যদি উনার ছেলের চাইতেও লম্বা কাউকে বিয়ে করানোর ইচ্ছে করেন, ব্যাপারটা তো ভালো দেখায়না। প্রতিটি মেয়েই চায়, তার স্বামী তার চাইতে অন্তত কিছুটা হলেও লম্বা হোক।
- হ্যাঁ, তাতো ঠিকই। সে ব্যাপারটাও আমরা দেখবো। বায়োডাটার হিসেবে সে তোমার থেকে কিছুটা লম্বা আছে, কিন্তু যদি দেখি বায়োডাটায় উচ্চতার ক্ষেত্রে সে মিথ্যা কথা লিখেছে, বাস্তবিক তোমার থেকেও উচ্চতা কম, তবে তো তাতে আমাদের আপত্তি থাকবে।
কাল তোমার খালুজ্বীর সাথে তার বন্ধু পাত্রের এলাকার মাসজিদের ইমাম সাহেবের কথা হচ্ছিল। ইমাম সাহেব যে পাত্রপক্ষের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, এটা তাশফির আব্বু জানতোনা। কথায় কথায় ছেলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ইমাম সাহেব বললেন, "ছেলেটার ফ্যামিলি ভালো। ছেলেটাও খারাপ নয়, কিন্তু সমস্যাটা হলো ছেলেটার চাহিদা অনেক। একদিন তার সাথে এসব ব্যাপারে কথা হচ্ছিল। সে বললো, সে এমন মেয়ে চায়, যে কিনা সবদিক থেকে নিখুঁত, সবদিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ, যোগ্যতাসম্পন্ন এবং অনেক গুণের অধিকারীণী। আমি শুধু বলেছিলাম, তুমি ভেবে দেখো তুমি যেমন মেয়ে চাচ্ছো, তুমি নিজে এমন কারো যোগ্য কিনা। কিছু না কিছু তো ছাড় দিতে হয়। তোমার বর্ণিত এমন সবদিক দিয়ে যোগ্য আর সর্বগুণসম্পন্ন কাউকে পাওয়া যায় রূপকথার রাজ্যে।" কয়েকদিন ধরে শুনছি তারা কোন মেয়ের ব্যাপারে আলোচনা করছে। আমাকেও জানিয়েছে, কিন্তু সেটা যে আপনার ভাগ্নি, তা আমি জানতামনা। যে সিদ্ধান্ত নেবেন, ভেবে চিন্তে নেবেন। এত চাহিদা যাদের থাকে, পরবর্তীতে কোন একটাতে ঘাটতি বা অসম্পূর্ণতা দেখলে সংসারে অশান্তি তৈরী হতে পারে। তাই আপনারা ধীরে সুস্থে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিন।
ইমাম সাহেব অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একজন ভালো মানুষ। তিনি ছেলের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলেছেন এমনটা ভাবার প্রশ্নই আসেনা। আর উনার কথায় যুক্তিও আছে। এখন তাশফির আব্বুর কথা হলো, ছেলেপক্ষ যেহেতু খুব আগ্রহী, ছেলেও তাঁর সাথে কথা বলার সময় এতসব চাহিদার উল্লেখ করেনি, তাই এ কারণ দেখিয়ে তো পিছিয়ে আসা যায়না, বরং ছেলের মানসিকতা কেমন, তা যাচাই করে দেখতে হবে। আর তা করতে হলে তোমাদের একে অপরকে দেখা এবং কথা বলাটা আবশ্যক। যদি তোমার আপত্তি না থাকে, তবে দেখাদেখির পর্বটা হয়ে যাক, আর তাতেই কিন্তু ছেলের মনোভাব ক্লিয়ার বুঝা যাবে। কারণ সে এখন পর্য্ন্ত তোমার সম্পর্কে যা যা শুনেছে, সবকিছুর তার চাওয়ার ভিতরেই। তাই তাকে যাচাই করে তার মানসিকতা বুঝতে হলে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে। আমরা যে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করবো, আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা করে, পর্যাপ্ত ভেবে চিন্তে, তোমার সম্মতি নিয়েই করব ইনশা আল্লাহ। এখন তোমার আপত্তি না থাকলে কাল রাদিয়া তোমাকে নিয়ে তাশফিদের বাসায় যাবে।
- এত উচ্চশিক্ষা করে লাভ কি হলো, যদি মানসিকতাই এমন থাকে! সত্যিই যদি তার এমন উত্তম (!!!!) মানসিকতা হয়ে থাকে, তবে আল্লাহ তার জীবনসঙ্গীনী হওয়া থেকে আমাকে হেফাজাত করুন। খালুজ্বীর যুক্তি ঠিক আছে। তাই আমি আপত্তি করলামনা।
- তাহলে আমি রাদিয়াকে ফোন দিয়ে বলছি, কেমন?
- হুম।
- আল্লাহ হাফিজ। আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুমুস সালাম। ফী আমানিল্লাহ।
ফোনটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সামিহা। মনে মনে দুআ করলো, হে প্রভূ যা কিছু কল্যাণকর, তাই আমার জন্য নির্ধারণ করে দাও, আর তোমার ইচ্ছের উপর আমাকে সন্তুষ্ট এবং প্রশান্তচিত্ত করে দাও। নিঃসন্দেহে তুমি সর্বোত্তম দাতা।
মাগরিবের আজান দিচ্ছে। উঠে অযু করতে গেল সে।
'
চলবে
বিষয়: বিবিধ
২৭১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন