শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার নির্মম হত্যাকাণ্ডে আমরা শোকাহত [পর্ব-৩]

লিখেছেন লিখেছেন ইঞ্জিঃ আবুল হোসেন রহমতুল্লাহ ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১২:১৪:৪২ রাত



[২য় পর্বের পর]

পরিবারের সাথে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার শেষ সাক্ষাত এবং সবার প্রতি নসিহত

১২ ডিসেম্বর, ২০১৩ বৃহস্পতিবার যে রাতে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইকে ফাঁসি দেওয়া হয় সেই রাতে তাঁর সহধর্মীনি স্ত্রী, দুই ছেলে, চার মেয়ে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা দ্বিতীয়বার শেষ দেখা দেখতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের যান। তখন তিনি ছিলেন খুব স্বাভাবিক, কোন মৃত্য ভয় বা দুশ্চিন্তা তাঁর মুখমণ্ডলে প্রকাশ পায় নাই। সত্যিকার অপরাধী মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তেও প্রাণ বাচানোর জন্য অনেক আকুতি করে প্রাণ ভিক্ষা চায়। কিন্তু শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণ ভিক্ষা না চেয়ে সেই সুযোগ ফিরিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, “দুনিয়ার কোন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। জীবনের মালিক আল্লাহ। কিভাবে আমার মৃত্যু হবে তা আল্লাহই নির্ধারণ করবেন। কোন ব্যক্তির সিদ্ধান্তে আমার মৃত্যু কার্যকর হবে না। আল্লাহর ফয়সালা অনুযায়ীই আমার মৃত্যুর সময় ও তা কার্যকর হবে। সুতরাং আমি আল্লাহর ফয়সালা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেবো”

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে পরিবারের সাথে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা কথাবার্তা বলেছেন স্বাভাবিকভাবেই। সেথানে উপস্থিত বাচ্চাদেরকে আদর করেছেন বলেও জানান পবিবারের সদস্যরা। নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে তিনি তার পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, “শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধেই আমাকে হত্যা করা হচ্ছে। শাহাদাতের মৃত্যু সকলের নসিবে হয় না। আল্লাহতায়ালা যাকে শহীদী মৃত্যু দেন সে সৌভাগ্যবান। আমি শহীদী মৃত্যুর অধিকারী হলে তা হবে আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। আমার প্রতিটি রক্তকণিকা ইসলামী আন্দোলনকে বেগবান করবে এবং জালেমের ধ্বংস ডেকে আনবে। আমি নিজের জন্য চিন্তিত নই। আমি দেশের ভবিষ্যৎ ও ইসলামী আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত। আমার জানা মতে আমি কোন অন্যায় করিনি। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলনের জন্য আমি আমার জীবন উৎসর্গ করেছি। আমি অন্যায়ের কাছে কখনও মাথা নত করিনি, করবো না।”

ছেলে হাসান জামিলসহ পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমি তোমাদের অভিভাবক ছিলাম। এ সরকার যদি আমাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে তাহলে সেটা হবে আমার শাহাদাতের মৃত্যু। আমার শাহাদাতের পর মহান রাব্বুল আলামীন তোমাদের অভিভাবক হবেন। তিনিই উত্তম অভিভাবক।" ছেলের উদ্দেশে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা আরো বলেন, "তোমাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। ইসলামী আন্দোলনকে বিজয়ী করার মাধ্যমে আমার হত্যার প্রতিশোধ নিও।” পরিবারের সদস্যদের তিনি আরও বলেন, “তোমরা ধৈর্যের পরিচয় দেবে। একমাত্র ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমেই আল্লাহতায়ালার ঘোষিত পুরস্কার পাওয়া সম্ভব। দুনিয়া নয়, আখেরাতের মুক্তিই আমার কাম্য। আমি দেশবাসীর কাছে আমার শাহাদত কবুলিয়াতের জন্য দোয়া চাই। দেশবাসীর কাছে আমার সালাম পৌঁছে দিও।”

সহধর্মীনি স্ত্রী বেগম সানোয়ারা জাহানের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেন, “সাংগঠনিক কাজে বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকায় তোমার হক সঠিকভাবে আদায় করতে পারিনি, তোমাকে সময় দিতে পারিনি, আমাকে ক্ষমা করে দিও।” উত্তরে তার সহধর্মীনি স্ত্রী বলেন- “দীর্ঘদিন কারাবন্দী থাকায় আপনার সেবা করতে পারিনি। বিদায় বেলায়ও পাশে থাকতে পারছি না। জীবন চলার পথে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কোন অন্যায় হয়ে থাকলে মাফ করে দেবেন।” এ সময় খানিকটা আবেগ ঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলেও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ছিলেন দৃঢ়, অবিচল। বিদায় বেলায় স্ত্রীর সঙ্গে শেষ কথা বলেন তিনি, “ধৈর্য ধরো, আল্লাহর ওপর ভরসা রেখো।” সর্বশেষ ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নেন।

পরিবার বর্গের সাথে শেষ বিদায়ী এ কথোপকথনে আমার কান্না এসে যায়, আজকের শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার জায়গায় যদি আমি হতাম তখন ঐ মুহূর্তে আমার পরিবার বর্গের মানসিক অবস্থা কেমন হত তা ভেবে নিজের আবেগকে আর নিয়ন্ত্রন করতে পারলাম না।

হত্যার পর দাফন কাফনেও যালিম শাসকের চরম নিষ্ঠুরতা

এতকাল দেখে এসেছি সাধারনত গভীর রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হয় এবং ভোরবেলা পরিবার ও স্বজনদের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়, অথচ এ প্রথম তার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে গভীর রাত হওয়ার অনেক আগেই ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয় এবং পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে কড়া পুলিশ, রাব ও বিজিবির নিরাপত্তা পাহাড়ায় ফরিদপুর জেলায় তাঁর গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে গভীর রাতের অন্ধকারে দাফন করতে বাধ্য করে। এমন কি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদেরকেও জানযায় অংশগ্রহন করার সুযোগ দেওয়া হয় নাই। রাতে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা যাতে গ্রামের বাড়ীতে যেতে না পারে এ উদ্দেশ্যে তাঁর বাড়ীতে হামলা চালানো হয়। পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী শহীদ আবদুল কাদের মোল্লাকে হজের ও ওমরার কাপড় দিয়ে কাফন পরানো সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই নির্মমতা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার তাঁর পরিবারকে জানাজায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। এমনকি পরিবারের সদস্যদেরকে তাঁর ‘মুখ’ দেখার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করেছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে তাঁর পরিবারকে জানাজা ও দাফনে অংশগ্রহণ করতে না দেয়া এবং শেষবারের মতো মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত করে তাদের ধর্মীয় ও মানবিক অধিকার খর্ব করেছে।

গভীর রাতে কনকনে শীত উপেক্ষা করে দাফনে অংশ নিতে ছুটে আসা হাজার হাজার স্থানীয় জনতাকে বাধা দিয়েছে পুলিশ। এ সময় তাদের একবারের জন্য শেষ দেখাও দেখতে দেয়া হয়নি। দাফনে অংশ নিতে আসার পথে গ্রেফতার করা হয়েছে শুভাকাক্সী, সমর্থক ও দলীয় নেতাকর্মীদের। মধ্য রাতে কনকনে শীতের মধ্যে হাজার হাজার লোককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। যে রাতে ফাঁসি দেয়া হয় ঐ রাতে ফরিদপুর জেলার জামায়াত ইসলামী দলের নেতাদেরকে থানায় আটকিয়ে রাখা হয় যেন তাঁর জানাযায় উপস্থিত হতে না পারে। বাধা দেয়া হয়েছে সংবাদ সংগ্রহে সদরপুরে যাওয়া সংবাদকর্মীদেরও এবং কোন সংবাদ মিডিয়ার কেউ ছবি ও ভিডিও তুলতে পারে নাই। এত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও গভীর রাতে অন্ধকার ও তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যে বাড়ীটি পুলিশ ঘেরাও করার আগে হাজার হাজার জনতা যারা উপস্থিত ছিল তারা জানাযায় অংশগ্রহন করে। যালিম শাসকের এমন পাষান হৃদয় যে জানাযা নামাযে আলো পর্যন্ত জ্বালাতে দেয় নাই, অন্ধকারে জানাযা নামায পড়তে বাধ্য করা হয়। পরে এলাকার জনগন প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বললো, "এ যালিম সরকার আবদুল কাদের মোল্লাকে হত্যা করার পর এখন জীবিত আবদুল কাদের মোলার চাইতে মৃত আব্দুল কাদের মোলাকে আরো বেশী ভয় পাচ্ছে।"

এমন বর্বর নিষ্ঠুরতা ইতিহাসে নজিরবিহীন যা হোসেন (রা) কে হত্যাকারী সীমার ও ইয়াজিদ বাহিনীকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং আমরা এ যালিম ইসলাম বিদ্বেষী সরকারকে ধিক্কার জানাই।



মুখমন্ডলে শাহাদতের চিহ্ন

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের দাফন এমন কড়া নিরাপত্তার মাঝে তড়িঘড়ি করে দেওয়া হয় যে কোন সংবাদ কর্মীকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয় নাই, এমন কি ভিডিও এবং ছবিও কাউকে তুলতে দেওয়া হয় নাই। তবুও দুএকজন লুকিয়ে হাতের মোবাইল ফোন দিয়ে দুএক মিনিটের ভিডিও এবং দুএকটা ছবি তুলেছে। সেই ভিডিও এবং ছবিতে তাঁর মুখমন্ডলে রক্ত লেগে থাকার দাগ দেখতে পেলাম এবং হাস্যোজ্জল মুখে ঘুমিয়ে আছে এমনটাই তাঁর চেহারায় ফুটে উঠেছে।

ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর অনেক লাশ দেখেছি, ফাঁসিতে শাসরুদ্ধ করে যখন মারা হয় তখন অনেক আযাব ভোগ করে, শরীরে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়ে মাংসপেশীতে ও চামরায় যে রক্ত জমা থাকে তা আর বের হতে পারে না, ফলে সেই রক্ত দুষিত হয়ে মাংসপেশী ও চামরায় মিশে গিয়ে সারা শরীর ও মুখমণ্ডল কাল হয়ে যায় এবং যতক্ষন ফাঁসির দড়ি ঝুলানো থাকে ততক্ষন হাত পা ছুড়তে ছুড়তে প্রবল মৃত্য যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকে যা মুখমণ্ডলে বিভৎস চেহারায় ফুটে উঠে এবং অনেকের জিহ্বা বাইরে বের হয়ে থাকে। এ কারনেই ফাঁসির আসামীকে যম টুপি পড়িয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে দেওয়া হয় এবং হাত পা বেঁধে দেওয়া হয় যাতে আসামীর বিভৎস চেহারা দেখে সহ্য করতে না পেরে ওখানে উপস্থিত কেউ জ্ঞান হারিয়ে না ফেলে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষনায় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানীত ফাঁসির তুলনায় গলা কেটে হত্যায় মৃত্যু যন্ত্রনা অনেক কম হয়, কারন শরীর থেকে সমস্ত রক্ত বের হয়ে গিয়ে হৃৎপিণ্ড,মস্তিষ্ক এবং দেহের কোষগুলি অতি দ্রুত নিস্তেজ হয়ে যায়। এ কারনে দুশত চব্বিশ বছর আগে ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে যোশেফ ইগন্যান্স গুইলোটিন (Joseph-Ignace Guillotin) নামে এক বিজ্ঞানী গবেষনা করে আবিস্কার করেন গলা কেটে মৃত্যুদণ্ডে মৃত্যু যন্ত্রনা কম হয়, আর তাই তিনি গলা কেটে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য একটি যন্ত্র তৈরী করেন যার নাম দেওয়া হয় “গুইলোটিন” এবং তার পর থেকে ফ্রান্সে ফাঁসির বদলে ঐ গুইলোটিন যন্ত্র দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় যা ১৯৮১ সালে মৃত্যদণ্ড আইন বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে। অথচ ইসলাম চৌদ্দশত বছর আগেই সবচেয়ে কম যন্ত্রনাদায়ক গলা কেটে মৃত্যুদণ্ডের আইন চালু করে যেটাকে তথাকথিত প্রগতিবাদীরা বর্বর আইন বলে থাকে, যদি তাই হয় তাহলে ফ্রান্সের বিজ্ঞানী যোশেফ ইগন্যান্স গুইলোটিন এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষনায় ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড আরও চরম ও ভয়াবহ বর্বর আইন নয় কি? ইনশাআল্লাহ এ বিষয়ে পরে বৈজ্ঞানিক গবেষনার তথ্য সহ বিস্তারিত আলোচনা করবো।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইকে যখন ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাঁর চোখে মুখে কোনপ্রকার ভীতির আভাস লক্ষ্য করা যায় নাই। সাধারন ফাঁসির আসামীদেরকে যখন ফাঁসির মঞ্চে টেনে নেওয়া হয় তখন মৃত্যূ ভয়ে পিছু টান দেয় এবং তাই তাকে জোর করে টেনে হিচড়ে নেওয়া হয়। সবাই আশ্চর্য্য হয়ে যায় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই এভাবে পিছু টান দেয় নাই, স্বেচ্ছায় হেটে গিয়েছেন। তিনি যম টুপি পড়তে চান নাই, তবুও তাঁকে জোর করে যম টুপি পরানো হয় এবং হাত পা বাঁধা হয়। ফাঁসির দড়ি পড়িয়ে ১০টা ১ মিনিটে পায়ের নীচের পাটতন সরিয়ে ফেলে বিশ মিনিট তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। এরপর তাঁকে নামিয়ে সিভিল সার্জন কর্তৃক পরীক্ষার জন্য তাঁর মাথার যম টুপি ও হাত পার বাঁধন খোলার পর তার চেহারা উজ্জল দেখে ঐসময় উপস্থিত সবাই আশ্চর্য্য হয়ে যায়। ফাঁসির মৃত্যুদণ্ড যতই আযাবের হোক আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাঁর প্রিয় বান্দাকে আযাবের বদলে শান্তি দায়ক করতে পারেন যেভাবে ইবরাহীম (আ) কে নমরুদ কর্তক আগুনে নিক্ষেপের সময় আল্লাহর হুকুমে আগুন আযাবের বদলে শান্তিদায়ক হয়ে যায় (সূরা আম্বিয়া, আয়াত নং – ৬৯,৭০)।

ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানোর পর বিভৎস চেহারার বদলে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর হাস্যোজ্জল মুখমন্ডলে রক্ত লেগে থাকার দাগের কারনটা জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারী জেনারেল ডাঃ শফিকুর রহমান ভাই সুন্দরভাবে ব্যাখা করেছেনঃ “শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের মুখমন্ডলে রক্ত লেগে থাকার কোন কারণ ছিল না। তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত হবার পরই তো তাকে ফাঁসি কাষ্ট থেকে নামানো হয়েছে। তারপর গোসল করানো হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা হয়তো অন্য রকম ছিল। আল্লাহ হয়তো চাইছিলেন তাঁর পথে শহীদ এই বান্দার চেহারায় শাহাদাতের একটু চিহ্ন লেগে থাক। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের লাশ দাফনের ভিডিওটি যতবার দেখি ততবার আমার মনে পড়ে ওহুদ যুদ্ধের ঘটনার কথা। ওহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী ৭০ জন সাহাবীর লাশ সামনে রেখে রাসুল (সাঃ) ঘোষণা করেছিলেন তাদেরকে রক্তাক্ত অবস্থায় দাফন করা হোক (বুখারী, বর্ণনাকারী- হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাঃ)। আল্লাহর পথে যারা শহীদ হন তাদেরকে কেয়ামতের দিন রক্তমাখা চেহারা নিয়ে উত্তোলন করা হবে। শহীদের চেহারায় লেগে থাকা রক্ত তখন সবাইকে জানান দেবে যে এই ব্যক্তি তার প্রভূর ভালোবাসায় সিক্ত হবার বাসনায় দুনিয়ায় নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইকে দাফনের ভিডিওটি দেখি আর ভাবি মোল্লা ভাইয়ের জান্নাতের সার্টিফিকেট দুনিয়াবাসীর সামনে তুলে ধরার জন্যই বোধ হয় আল্লাহ তায়ালা মোল্লা ভাইয়ের লাশের সাথে একটু রক্তমাখা চিহ্ন রেখে দিয়েছেন।”

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর পরিবার বর্গকে শান্তনা

আমার প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর পরিবার বর্গকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি, কেননা বিনা অপরাধে তাঁকে এভাবে হত্যা করায় আমি নিজেও গভীর শোকাহত ও মর্মাহত। তবুও তাঁর পরিবারবর্গকে একটা কথা বলতে চাই- যে কোন সময় যে কোন উপায়ে যে কোন লোকের মৃত্য হতে পারে। আজ থেকে বার বছর পূর্বে হার্টের রোগে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর মৃত্যু হতে পারত এবং হার্টের অপারশনে তিনি এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন তা ডাক্তাররাও কল্পনা করেন নাই। তখন যদি তিনি মারা যেতেন তাহলে আজ শহীদ হওয়ার এ সৌভাগ্য লাভ করতে পারতেন না। তখন মারা গেলে তিনি সত্যিকারভাবেই মারা যেতেন, আর এখন বাহ্যিক দৃষ্টিতে সবার চোখে তাঁকে মৃত দেখা গেলেও তিনি আসলে মারা যান নাই, বরং শহীদের মর্যাদা পেয়ে নব জীবন লাভ করে সত্যিকারভাবে জীবিত অবস্থায় আছেন যা আমরা অনুভব করতে পারছি না। আল্লাহ কুরআন শরীফে বলেন, “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা আসলে জীবিত । কিন্তু তোমরা তা (তাদের শহীদি জীবন সম্পর্কে) অনুভব করতে পারছো না।" [সূরা বাক্বারাঃ ১৫৪]

আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর আরো একটি বাড়তি সৌভাগ্য- যালিম শাসক তাঁকে দুদিন আগে বুধবার রাত ১২টা ১ মিনিটে তাঁকে হত্যা করার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরও ঐ দিন তাঁকে হত্যা করা সম্ভব হয় নাই। আল্লাহর চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে দুদিন পিছিয়ে জুমার রাতে তিনি শাহাদত লাভ করেন। “আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা) থেকে বর্নীত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ কোন মুসলমান যদি জুমার দিন বা জুমার রাতে মারা যায়, আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে কবরের ফেতনা থেকে রক্ষা করবেন”। [জামে তিরমিযী এবং মুসনাদ আহমদ, মিশকাত হাদিস নম্বর ১২৮৩,পৃষ্ঠা ২৬৪]

জেল কোড অনুযায়ী রাত ১২ টা ১ মিনিটে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হলে ক্যালেণ্ডারে তখন জুমা বার হবে এবং জুমা বারের সৌভাগ্য যেন তিনি লাভ করতে না পারেন এ কারনে হয়তো জেলখানার কোন আলেমের কাছে জুমাবারের মৃত্যুর সৌভাগ্যের বয়ান শুনে তড়িঘড়ি করে দু ঘন্টা আগে রাত ১০ টা ১ মিনিটে তাঁকে হত্যা করা হল কিনা আল্লাহই তা ভাল জানেন। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে ঐ বেকুফরা এটা জানে না যে ইংরেজী দিবস গভীর রাত ১২ টার পর শুরু হলেও ইসলামী হিজরী ক্যালেণ্ডার অনুসারে জুমার রাত শুরু হয় বৃহস্পতিবার দিবসের আসরের নামাযের ওয়াক্ত শেষ হলেই, মাগরিব থেকে। আর তাই হত্যার সময় যতই আগিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হোক না কেন ততক্ষনে জুমার রাত শুরু হয়ে গিয়েছে এবং আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে এভাবেই তিনি শাহাদতের মর্যাদার সাতে অতিরিক্ত (নফল) এ বাড়তি সুযোগটাও পেয়েও গেলেন।

তাই তো কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে সে নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে তাদের সাথী করা হবে যাদেরকে আল্লাহ নেয়ামত দান করে পুরস্কৃত করেছেন এবং তাদের সঙ্গী হওয়া কতই না উত্তম।" [সূরা নিসাঃ ৬৯]

আমাদের প্রান প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই এমনই একজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি শিক্ষা জীবনে যেমন প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হয়েছিলেন, আজ এই অন্তিম মুহূর্তে পৃথিবী থেকে শেষ বিদায় বেলায়ও প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হয়ে গেলেন শাহাদতের অমূল্য সম্পদ লাভ করে। তাঁর এ মহা সৌভাগ্যে আমার খুবই ইর্ষা হচ্ছে। আমিও তো ছাত্র জীবনে স্কুলে ফার্স্ট বয় ছিলাম এবং পরীক্ষায় প্রথম হতাম, কিন্তু সারা জীবন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেও তাঁর মত শাহাদতের অমূল্য সম্পদ লাভ করার সৌভাগ্য সবার ভাগ্যে জোটে না। তিনি মহা সৌভাগ্যবান এবং লাভবান হলেও আমরা খুবই দুর্ভাগ্যবান যে তাঁর মত বহুল প্রতিভার অধিকারী একজন সৎ চরিত্রবান ঈমানদার নেতাকে হারিয়ে মহা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেলাম। আসলে আল্লাহ যা ফয়সালা করে রেখেছেন তা তো আর রদ করার ক্ষমতা কারো নাই, অতএব সন্তুষ্ট চিত্তেই আমাদের তা মেনে নিতে হবে।

আল্লাহ যেন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর সমস্ত গোনাহ ও ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে শাহাদত কবুল করেন এবং পবীত্র কুরআনের ভাষায় জান্নাতে নবী রাসুল, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীলদের সাথী বানিয়ে উত্তম মর্যাদা দান করেন। আর তাঁর পরিবার বর্গকে শোক নিয়ন্ত্রন করার এবং ধৈর্য্য ধরার তৌফিক দান করেন। আমীন।

[সমাপ্ত]

বিষয়: বিবিধ

২৩৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File