শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার নির্মম হত্যাকাণ্ডে আমরা শোকাহত [পর্ব-২]

লিখেছেন লিখেছেন ইঞ্জিঃ আবুল হোসেন রহমতুল্লাহ ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৯:১৬:৫৫ রাত



[১ম পর্বের পর]

ইসলামী আন্দোলনে একজন ত্যাগী নেতার অসাধারন চরিত্র এবং উত্তম আচরন

ইসলামী আন্দোলনে যোগদানের পূর্বে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার রয়েছে সংগ্রামী রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যায়নকালেই তিনি কম্যূনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং কম্যূনিষ্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং বর্তমানের অন্যান্য বামপন্থী কম্যুনিস্ট নেতারা যারা এককালে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন তারাও মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আজকের এই শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইকে ভালভাবেই চিনতেন। আওয়ামী লীগের এম পি জনাব গোলাম মাওলা রনির লেখায় ও বক্তব্যে এর সত্যতা পাওয়া যায়।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই কথার মাধুর্য্য দিয়ে মানুষকে এমনভাবে আকৃষ্ট ও আপন করে নিতেন যে পরম শত্রুও তাঁর বন্ধু হয়ে যেত। “ভাল এবং মন্দ সমান হতে পারে না, মন্দকে ভাল দ্বারা দূর কর যা সবচেয়ে উত্তম, তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গিয়েছে” (সূরা হা-মীম আস সাজদাহঃ ৩৪) কুরআন শরীফের এ আয়াত তিনি যথার্থভাবে অনুসরন করে চলতেন।

ইসলামের দাওয়াতের কাজে তিনি ব্যক্তিগতভাবেও বিভিন্ন জনের কাছে ছুটে যেতেন। একবার জামায়াতে ইসলামীর চরম বিরোধী স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ী গেলেন, তিনি ঘরের দরজা না খুলে ভিতর থেকে “আপনাদের জামাতের কাউকে আমি পছন্দ করি না” এভাবে কটু কথা বলে তাঁকে ঘরের দরজা থেকেই বিদায় করে দিতে চাইলেন। কিন্তু শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই বাইরে থেকেই বললেন, “আমি যতই খারাপ হই, আপনি তো মুসলমান, বলেন তো কোন মুসলমানের ঘরের ড্রইং রুমে কার হক বেশী? মেহমানের না কি ঘরের মালিকের?” ভিতর থেকে উত্তর এল, “মেহমানের”। তখন তিনি বললেন, “তাহলে এখন আমি তো আপনার ঘরের মেহমান, দরজাটা খুলেন, কয়েক মিনিট বসে চলে যাব”। তখন তিনি দরজা খুলে রাগত স্বরে বললেন, "আসেন"। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর ড্রইং রুমে বসে পরে তিনি বললেন, “আপনার সাথে তো মাত্র কয়েক মিনিটে কথা বলা শেষ হবে না, ভাবীকে চা বানাতে বলেন, চা খেতে খেতে কথা বলি”। এভাবে কথার মাধুর্য্য দিয়ে জামায়াত ইসলামীর চরম বিরোধী আওয়ামী লীগের উগ্র মেজাজের একজন নেতাকে বশ করে ফেললেন। কিছুদিন পর আওয়ামী লীগের ঐ উগ্র নেতার সাথে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর রাস্তায় দেখা হল, হাতে টিফিন ক্যারিয়ারে কারো জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করলেন “কোথায় যাচ্ছেন?” তখন ঐ নেতা বললেন, “আমাদের মুজাহিদ ভাইর জন্য ইফতারী নিয়ে যাচ্ছি, উনি এহতেকাফে বসেছেন।” তখন আর আগের মত ‘আপনাদের জামাত’ বাক্য না বলে ‘আমাদের মুজাহিদ ভাই’ বাক্য উচ্চারন করলেন, অর্থাৎ শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর বশীকরন মন্ত্রে মন গলে গিয়ে তিনি ততদিনে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে জামায়াতে ইসলামী দলে যোগ দিয়েছেন।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই সব সময় অতি নরম স্বরে হাস্য উজ্জ্বল মেজাজে কথা বলতেন, কখনো তাঁর মুখে উচ্চ স্বরে কথা বলতে শোনা যায় নাই। তাঁর কথার মধ্যে খুব রস থাকতো এবং এ কারনে তিনি যে কোন অনুষ্ঠানে বক্তব্য শুরু করলে শ্রোতারা পিন পতন নিরবতা পালন করে অধীর আগ্রহে মনযোগ সহকারে তাঁর বক্তব্য শুনতো এবং কখন যে ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যেত কেউ টের পেত না। একবার সৌদি আরব এসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমাবেশে বক্তব্য রাখছিলেন। সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশীরা সারদিন কঠিন পরিশ্রমের কাজে ব্যস্ত থাকে এবং অনেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত দোকানে কাজ করে। তাই সবাই যাতে উপস্থিত থকতে পারে এ জন্য ঐ ধরনের অনুষ্ঠান রাত ১১ টার পর করা হয়। ঐ অনুষ্ঠানে তাঁর শ্রুতিমধুর বক্তব্য শুনতে শুনতে কখন যে রাত প্রায় পার হয়ে গেল কেউ বুঝতে পারলো না, আর কিছু সময় পরে ফজরের আযান দেবে এমন অবস্থা। ঐ অনুষ্ঠানে মাঝখানে বিরতি দিয়ে হালকা নাস্তা পরিবশন করার কথা ছিল, কিন্তু শ্রোতারা এমন অধির আগ্রহে তাঁর বক্তব্য শুনে যাচ্ছিল যে সবাই নাস্তার কথা ভুলেই গেল এবং অনুষ্ঠানের আয়োজকরাও তাঁর বক্তব্যের মাঝখানে বিরতি দিয়ে এমন এক সুমধুর পরিবেশ ভঙ্গ করতে চাইলেন না। অবশেষে ফজরের আগে সেই নাস্তা ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং সবাই তা হাতে করে নিয়ে বিদায় হয়।

সাধারন কর্মীদের এক সমাবেশে তিনি হাসি রস মিশিয়ে বলতে লাগলেন, “জামাত ইসলামী দলে আসার আগে যখন আমি কমুনিস্ট আদর্শের দল করতাম তখন মসজিদে যেতাম নামায পড়তে আসা মুসল্লিদের মাঝে কমুনিস্ট আদর্শের দাওয়াত দেওয়ার জন্য এবং কুরআন শরীফ পড়া শুরু করলাম কমুনিস্ট আদর্শের পক্ষে কোন আয়াত কিংবা দলিল পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজে বের করতে। কারন সাধারন ধর্মপ্রান মুসলমানরা অন্য সব ডানপন্থী দলকে পছন্দ করলেও কমুনিস্ট আদর্শ কখনো পছন্দ করতো না। কুরআন শরীফ পড়তে পড়তে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আমি ইসলামী আদর্শের কাছে পরাজিত হলাম, ফলে আজ আমি ইসলামী আন্দোলনে আপনাদের সাথে শরীক হতে পেরেছি”। এ দিকটায়ও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর সাথে আমার কিছুটা মিল আছে, আমিও ছাত্রজীবনে বামপন্থী সাংস্কৃতিক চিন্তা চেতনা লালন করে ঐ সব সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে পত্রিকা প্রকাশ করতাম। পরে কুরআন শরীফের সূরা বালাদে বামপন্থীদের চরিত্র ও জাহান্নামে তাদের ভয়াবহ যে শাস্তির কথা বর্ননা করা হয়েছে তা পড়ে আমি তওবা করে মন থেকে বামপন্থী চিন্তা চেতনা সব মুছে ফেললাম।

মিথা অপরাধে ফাঁসির রায় ঘোষনার পর আসন্ন মৃত্যুদণ্ডের প্রতিক্ষায় দিন কাটলেও কখনো তিনি বিচলিত ও মনক্ষুন্ন হন নাই, বরং হাসি মুখে মেনে নিয়ে বলেছেন, “নবুয়তের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু শাহাদতের দরজা কেয়ামত পর্যন্ত খোলা আছে”। আসন্ন মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়েও তিনি কারাগারের ভিতরও হাসি রসে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। কাসিমপুর জেলে বন্ধী অবস্থায় আওয়ামী লীগের এম পি গোলাম মাওলা রনির একটি লেখায় তা ফুটে উঠে,“বন্দি জীবনের নিরন্তর সময় যেন আর কাটতে চাইত না। ফলে আমরা সময়টুকুকে যথাসম্ভব আনন্দমুখর করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতাম। যার যত জ্ঞান বা প্রতিভা ছিল—সবই উজাড় করে দিতাম সহযাত্রীদের আনন্দ দেবার জন্য। একদিন বিকেলে বসেছিলাম সুরমা সেলের বারান্দায়। পাশাপাশি চেয়ার নিয়ে আমরা সবাই—গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, মাহমুদুর রহমান, মীর কাসিম আলী আর এটিএম আজাহার। হঠাত্ নীরব হয়ে গেলাম অজানা কারণে। অর্থাত্ বলার মতো কোনো কথা ছিল না কারও মুখে। হঠাৎ মামুনই বলে উঠল—এই সময় মোল্লা ভাই থাকলে আমাদের সবাইকে গান শোনাতেন। জামায়াতের লোক আবার গান গায় নাকি—মনে মনে টিটকারি কেটে জিজ্ঞাসা করলাম…………… তারা আগ্রহ দেখালে আমি একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলাম—‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে’। সবাই শুনলেন এবং প্রশংসা করলেন। তবে একথা বললেন যে, আমার চেয়েও কাদের মোল্লা সুন্দর করে গান করেন। তার গান পরিবেশনের সময় তিনি উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে এমনভাবে চোখের ভাব বিনিময় করেন যে শ্রোতাগণ তার সঙ্গে গুনগুনিয়ে কণ্ঠ মেলাতে বাধ্য হন। ফলে পুরো অনুষ্ঠান হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। অন্যদিকে আমি গান করি চোখ বুঝে। যখন আমার সঙ্গী-সাথীগণ আমাকে চোখ খোলা রেখে আরও একটি গান গাইতে অনুরোধ করলেন তখন আমি ভারি লজ্জা পেয়ে গেলাম এবং আর এগুতে পারলাম না। ফলে তারা আবার পুনরায় কাদের মোল্লার প্রশংসা করতে থাকলেন।”

কারাগারের ভিতরেও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই উত্তম আচরন ও কথার মাধুর্য্য দিয়ে শত্রু পক্ষ যারা তাঁকে হত্যা করতে প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল সেই যালিম সরকারের একজন প্রভাবশালী এমপিকেও তিনি কত আপন করে নিতে পারেন তার প্রমান আওয়ামী লীগের এম পি গোলাম মাওলা রনির একটি লেখায়, “কাশিমপুর জেল থেকে মুক্তির দিন সকালেই ঘটল ঘটনাটি। মুক্তি লাভের আশা আর জেল গেটে পুনরায় গ্রেফতার হবার আশঙ্কার দোলাচলে দুলতে দুলতে আমি আমার মালপত্র গুছাচ্ছিলাম। এমন সময় লুঙ্গি পরা এক ব্যক্তি আমার রুমে ঢুকে সালাম দিল এবং বলল—কাদের মোল্লা সাহেব আপনাকে একটি চিঠি দিয়েছেন। মুহূর্তের মধ্যে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, চিঠিটি কি গ্রহণ করব না ফেরত পাঠাব। এরই মধ্যে আগন্তুক টেবিলের ওপর চিঠিটি রেখে তড়িত্গতিতে চলে গেলেন।……………তিনি লিখেছেন—প্রিয় রনি, যদি কখনও সময় পাও এবং তোমার ইচ্ছা হয় তবে আমার ফাঁসির পর একবার হলেও বলো বা লিখো—কাদের মোল্লা আর কসাই কাদের এক ব্যক্তি নয়। আমার আত্মা কিয়ামত পর্যন্ত কাঁদবে আর কসাই কাদের কিয়ামত পর্যন্ত অট্টহাসি দেবে”।

শত্রু পক্ষকেও এমন আপন করে নেয়ার উদাহরন আওয়ামী লীগের এম পি গোলাম মাওলা রনির কাছে পাঠানো ঐ ছোট চিরকুট যেখানে আপন ছোট ভাইর মত তুমি সম্বোধন করে লিখলেন। ফাঁসি থেকে বাঁচার জন্য ঐ চিরকুট যে লিখেন নাই তার প্রমান “আমার ফাঁসির পর একবার হলেও বলো বা লিখো” এ কথাটিতে। ফাঁসি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্য হলে “আমার ফাঁসির আগে একবার হলেও বলো বা লিখো” এভাবে তিনি লিখতে পারতেন।

কি ছিল তাঁর অপরাধ?

যদি এই শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই মীরপুরের অবাঙ্গালী বিহারী কুখ্যাত খুনী রাজাকার কাদের কসাই হয়ে থাকে তাহলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি কিভাবে প্রকাশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে এম এড ডিগ্রী নিলেন? অথচ ঐ কাদের কসাইর তেমন কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। আর কিভাবে এমন একজন কুখ্যাত খুনী রাজাকারকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনে সংস্কৃতি কর্মকর্তা হিসাবে চাকরির জন্য সুপারিশ করতে পারলেন? আর ঐ সময় তৈরী করা যুদ্ধ অপরাধী তালিকায় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর নাম তো ছিলই না, এমনকি পাকিস্তানী যুদ্ধ অপরাধীদের সহযোগী দালাল আইনে দালালদের তালিকায়ও তাঁর নাম ছিল না এবং তাঁর নিজ জেলা ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার কোন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে একটা মামলাও করা হয় নাই। তাঁর গ্রামের প্রবীণ বৃদ্ধরা যারা ১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধ দেখেছে এবং এখনো বেচেঁ আছেন তাদের সবার বক্তব্য, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা তার নিজ গ্রামেই ছিলেন এবং ঐ সময় নিজ গ্রামের বাড়িতে থেকে বাইশরশি শিবসুন্দরী একাডেমিতে শিক্ষকতা করেছেন। যালিম শাসকের অনুগত ট্রাইবুনালের বিচারকরা তাঁর গ্রামের বাড়ীর ঐসব প্রবীণ বৃদ্ধদের সাক্ষ্য নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করলো না? এতকাল পরে ২০১০ সালে হঠাৎ নতুন করে যুদ্ধ অপরাধী তালিকায় তাঁর নাম এল কিভাবে? স্কুল জীবনে সাধারন গনিত ও উচ্চতর গনিতে ১০০ এর মধ্যে ১০০ নম্বর পেয়েও এ কঠিন হিসাব আমি কিছুতেই মিলাতে পারছি না।

এ লেখাটা যখন লিখছি তখন অন লাইন পত্রিকা BD Today তে বন্ধ করে দেওয়া দিগন্ত টিভির প্রিয় সাংবাদিক কামরুজ্জামান বাবলুর একটি লেখা পড়লামঃ “আজ ১৩ই ডিসেম্বর ২০১৩। রাত ১০টা। আজ থেকে মাস দেড়েক আগের ঘটনা। তারিখটা ঠিক মনে নেই। একদিন সন্ধ্যার পরে কোথাও এক জায়গায় বসে কয়েকজন চা খাচ্ছিলাম আর আড্ডা দিচ্ছিলাম। কথা হচ্ছিল দেশের সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে। ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী ব্যারিস্টার মুন্সি আহসান কবীর। আলোচনাক্রমে আসে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের প্রসঙ্গটি ।

ব্যারিস্টার আহসান কবীর এ সময় বলেন, কিছুদিন আগে তিনি জেলগেটে দেখা করতে গিয়েছিলেন আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে। ওই সময় মোল্লার হাতে ছিল একটি ছোট্ট কোরআন শরীফ। কাদের মোল্লা কোরআন শরীফটি দেখিয়ে বললেন, মুন্সি আমার হাতে এটা কী? ব্যারিস্টার আহসান কবীর বললেন, এটা তো কোরআন শরীফ।

ওই কোরআন শরীফটি হাতে উচু করে কাদের মোল্লা তখন বললেন, মুন্সি হয়তো আমার ফাঁসি হয়ে যাবে। কিন্তু আজ এই কোরআন শরীফ হাতে নিয়ে আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, ১৯৭১ সালে মিরপুরে কসাই কাদের কর্তৃক যেইসব হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো তার একটি অপরাধের সাথেও আমার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। কাদের মোল্লা বলেন, আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি আমি ১৯৭৩ সালের আগে কোনদিন মিরপুরেই যাইনি।

সেইদিনের আব্দুল কাদের মোল্লার সেই কোরআন নিয়ে শপথের কোন আইনী মূল্য ছিল না। কারণ একদিকে চলছে প্রহসনের বিচার। আর অন্যদিকে চলছে ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত লোকদের সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝানোর মহোৎসব। নিজেদেরকে প্রগতিশীল বলে পরিচয়দানকারী কিছু চরিত্রহীন, লম্পট গণমাধ্যমকর্মী মরিয়া হয়ে এমন অপপ্রচারে নামেন যাতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন ও এই আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের থেকে দেশের সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়”।


বিচারের নামে এভাবে মিথ্যার প্রতিযোগীতায় ইবলিশ শয়তানকেও যেভাবে হারিয়ে ফেলা হল ভেবে খুবই অবাক হয়ে যাই এবং ভাবছি আসলে কি এটা আন্তর্জাতিক যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইবুনাল না কি আন্তর্জাতিক মহা মিথ্যাচার ট্রাইবুনাল?

আমার প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর এতগুলি অসাধারন গুনাবলি এবং আকর্ষনীয় চরিত্র মাধুর্য্য থাকা সত্বেও অন্যায়ভাবে মিথ্যা অভিযোগে প্রহসনের বিচারে যেভাবে হত্যা করা হল এ আর নতুন কিছু নয়। বহু নবী রাসুলকে ঐ একই কায়দায় যালিম শাসকের নির্দেশে বিচারের ট্রাইবুনালে মিথ্যা অপরাধে মৃত্যুদণ্ড রায় দিয়ে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়েছে। এমন কি আজকের শাহবাগের তথাকথিত গন জাগরন (গন উন্মাদন) মঞ্চের প্রগতিশীল বলে পরিচয়দানকারী কিছু ইসলাম বিরোধী ও রাসুলুল্লাহ (স) কে অবমাননকারী চরিত্রহীন, মদখোর, লম্পট চরিত্রের গণমাধ্যমকর্মী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবীর মতই সেই যুগেও ঘৃনিত পতিতা ও চরিত্রহীন লোকদের দাবীর মুখে সবচেয়ে মহৎ চরিত্রবান নবী রাসুলদেরকে বিচার করে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। একটা কুখ্যাত খুনী ডাকাতের মুক্তির বিনিময়ে পাপাচারী বনী ঈসরাইল জাতির দাবী মেনে নিয়ে রোমান শাসকের বিচারের ট্রাইবুনালে ঈসা (আ) কে মৃত্যুদণ্ড রায় দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে রায় তারা কার্যকর করতে পারে নাই, তার আগেই আল্লাহ ঈসা (আ) কে আকাশে তুলে নেন কেয়ামতের পূর্বে দজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আবার পাঠাবার উদ্দেশ্যে। আমাদের প্রিয় বিশ্বনেতা ও সর্বশেষ নবী ও রাসুল মুহম্মদ (স) কেও “দারুল নদওয়া” নামক বিচারের ট্রাইবুনালে মৃত্যুদণ্ড রায় দেওয়া হয়েছিল যারা আজকের শাহবাগের তথাকথিত গন জাগরন (গন উন্মাদন) মঞ্চের মতই পারস্য থেকে নর্তকী, গায়িকা ও কবিয়াল এনে সাংস্কৃতিক আসর বসিয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করে মদীনায় হিজরতের ব্যবস্থা করে দেন।

রাসুলুল্লাহ (স) এর পরেও ঐ একইভাবে যালিম শাসকরা ঈমানদার মুসলমানদেরকে হত্যা করে। খোলাফায়ে রাশেদীনের তিন খলিফা ওমর (রা), উসমান (রা), আলী (রা) কে ছুরিকঘাতে এবং রাসুলুল্লাহ (স)-এর প্রিয় নাতি হাসান (রা) কে বিষ প্রয়োগ করে গুপ্ত হত্যার পর রাসুলুল্লাহ (স)-এর আর এক প্রিয় নাতি হোসেইন (রা) কে যালিম শাসকের নির্দেশে হত্যা করা হয়। আর এই সব হত্যার নেপথ্যে মূল পরিকল্পনাকারী ও গোপন নির্দেশদাতা ছিল বহিরাগত ঈহুদী ষড়যন্ত্রকারীরা।

পরবর্তি যুগে আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমাম আবু হানিফা (র) কেও যালিম শাসকের নির্দেশে বিচারের ট্রাইবুনালে গ্রেফতার করে রিমাণ্ডে নিয়ে গিয়ে তাঁর মার সামনে চরম নির্যাতন করা হয় এবং পরে হত্যা করা হয়। ঐ একই কায়দায় বিদেশী ব্রিটিশ প্রভু ক্লাইভের সহযোগীতায় বিশ্বাস ঘাতক সেনাপতি মীর জাফর নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে পরাজিত ও বন্ধী করে এবং বিদেশী ব্রিটিশ প্রভুর নির্দেশে বিচারের ট্রাইবুনাল করে তাঁকে নৃসংসভাবে হত্যা করে। সব চেয়ে দুঃখের বিষয় রাসুলুল্লাহ (স) এর পরে এভাবে যেসব যালিম শাসকরা বিচারের ট্রাইবুনালে উত্তম চরিত্রের ঈমানদারদেরকে হত্যা করেছে তারা কেহই ভিন্ন ধর্মী কাফির মুশরিক ছিল না, বরং মুসলিম পরিচয়ের দাবীদার ছিল। আজও তেমনি যারা বিচারের ট্রাইবুনালে মিথ্যা অপরাধে উত্তম চরিত্রের নিরাপরাধ ঈমানদার মুসলমাদদেরকে হত্যা করার উন্মত্ত প্রতিহিংসায় মেতে উঠেছে তারাও বিদেশী প্রভু ভারতের নির্দেশে ও সহযোগীতায়ই তা করে চলছে এবং নামে তারা মুসলিম। রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ওমরা, হজ্জ ও পীরের মাজার জেয়ারত করে জনগনের সামনে তারা নিজেদেরকে মুসলিম হিসাবে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করে।

ইসলাম বিরোধী যালিম শাসকরা যতভাবেই মিথ্যা অপবাদ ও দোষ দিয়ে নিরাপরাধ ঈমানদার ধার্মিক নর নারীদের অপরাধী বানাক না কেন ওদের চোখে তাদের মূল অপরাধ কি তা আল্লাহ কুরআন শরীফে এভাবে বলেছেনঃ

“ওই ঈমানদারদের সাথে তাদের শত্রুতার এ ছাড়া আর কোন কারণ ছিল না যে (তাদের অপরাধ) তারা সেই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল যিনি মহাপরাক্রমশালী এবং নিজের সত্তায় নিজেই প্রশংসিত, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্বের অধিকারী ৷ আর সে আল্লাহ সবকিছু দেখছেন। যারা মু’মিন পুরুষ ও নারীদের ওপর জুলুম নিপীড়ন চালিয়েছে, তারপর তা থেকে তওবা করেনি, নিশ্চিতভাবেই তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব এবং আগুনে আরো তীব্রতর জ্বালা যন্ত্রনা”। (সূরা বুরুজঃ ৮-১০)

“আর যে ব্যক্তি স্বজ্ঞানে অন্যায়ভাবে মুমিনকে হত্যা করে, তার পুরস্কার (শাস্তি) হচ্ছে জাহান্নাম যেখানে সে চিরকাল থাকবে, তার উপর আল্লাহর গযব ও লানত (অভিশাপ) এবং আল্লাহ তার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন”। [সূরা নিসাঃ ৯৩]

রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ যালেমকে সুদীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না।” এরপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন,“তোমার প্রভূর পাকড়াও এ রকম হয়ে থাকে, যখন তিনি যুলুমরত জনপদসমূহকে পাকড়াও করেন তখন তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক এবং অপ্রতিরোধ্য (কারো ঠেকাবার সাধ্য নাই)।” (সূরা হুদঃ ১০২) [বুখারী, মুসলিম]

যারা এভাবে মিথ্যা অপরাধ সাজিয়ে প্রহসনের বিচারে এতগুলো গুনের অধিকারী উত্তম চরিত্রের ঈমানদার আমার প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইকে হত্যা করেছে তাদের উপর কুরআনের ঐ আয়াতে বর্নীত আল্লাহর গযব ও লানত (অভিশাপ) নির্ধারিত. তা আর কারো রোধ করার ক্ষমতা নেই। আল্লাহ যাকে অভিশপ্ত করেন সে যতই নামায রোযা হজ্জ ওমরা করুক না কেন তার সারা জীবনের সমস্ত ইবাদত বরবাদ হয়ে যায় যেভাবে ইবলিশ দীর্ঘকাল সবচেয়ে বেশী ইবাদত করে ফেরেশতাদের সর্দার হয়েও আল্লাহর একটি নির্দেশ অমান্য করার কারণে চির অভিশপ্ত শয়তানে পরিনত হয়েছে এবং আল্লাহ যাদেরকে ইতিমধ্যে অভিশপ্ত করেছেন তাদের থেকে আশ্রয় ও তাদের দলভুক্ত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য প্রতি রাকাত ফরজ, সুন্নত ও নফল নামাযে সূরা ফাতিহায় পড়া হয় “গাইরিল মাগদুবে আলাইহিম ওয়ালাদ্দয়াল্লীন” (অর্থ- তাদের পথে নিও না যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট)। আল্লাহর অভিশাপে অতীতে নমরুদ, ফেরআউন, আবু লাহাব এবং পরবর্তি যুগে মুসলমান নামধারী যালিমদের পরিনতি দুনিয়ায় কত কঠিন ও ভয়ঙ্কর হয়েছিল তা আমরা ইতিহাস থেকেই জানতে পারি, আর মৃত্যুর পর কবরের আযাব ও আখেরাতে চিরকাল জাহান্নামের শাস্তি তো আরও ভয়ঙ্কর।

আজ যারা বিদেশী প্রভু এবং স্বদেশী যালিম শাসককে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে তাদেরই নির্দেশে বিচারের নামে অবিচার করেছে তাদেরকে কিয়ামতের দিনে অবশ্যই মহা বিচারক আল্লাহর আদালতে কাঠগরায় দাড়াতে হবে এবং সেখানে রিমাণ্ডে নিয়ে কোটি কোটি গুন বেশী কঠিন নির্যাতন করা হবে। কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেন "আল্লাহ কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্টতম বিচারক নন?" (সূরা ত্বীনঃ ৮) "আমি (আল্লাহ) কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব” (সূরা আম্বিয়াঃ ৪৭)।

"অতএব, তারা (যালিমরা) এখন সামান্য হেসে নিক এবং তারা তাদের কৃতকর্মের কারণে অনেক বেশি কাঁদবে।" [সূরা তাওবাহঃ ৮২]

“মনমরা হয়ো না,দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো।" [সূরা আলইমরানঃ ১৩৯]

নবী রাসুলদের ইতিহাস থেকেই বুঝতে পারি মিষ্টি খাওয়া যেমন সুন্নত, তেমনি আল্লাহ বিদ্রোহী, ইসলাম বিরোধী, তাগুতি যালিম শাসকের বিচারের রায়ে যুদ্ধ অপরাধী হতে পারাও একটি বড় সুন্নত। তাই আজ জামায়াতে ইসলমীর নেতারা যুদ্ধ অপরাধীর অপবাদ মাথায় নিয়ে নবী রাসুলদের সবচেয়ে বড় কঠিন সুন্নতই পালন করছেন। কারন নবী রাসুলদের বেলায়ও এমনটি ঘটেছিল। মুসা (আঃ) কে রাষ্ট্রদ্রোহী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অপরাধে দোষী করা হয়েছিল, ইউসূফ (আঃ) কে নারী ধর্ষনকারী অপরাধে দোষী করা হয়েছিল, শেষ নবী রাসুলুল্লাহ (স) কে সমাজে অশান্তি সৃষ্টিকারী অপরাধে দোষী করা হয়েছিল। এমন আরো অনেক উদাহরন খুঁজে পাওয়া যাবে কুরআন শরীফে। ইসলাম বিরোধী, তাগুতি যালিম শাসকেরা যতই অপরাধী বানাক না কেন, যতই নিন্দা ও ঘৃনা পকাশ করুক না কেন, আর যতই তা প্রচার করে বেরাক না কেন, তাই বলে কি নবী রাসুলদের মান সম্মান চলে গিয়েছিল? চুড়ান্ত সম্মান তো একমাত্র আল্লাহর কছেই, তিনি যাকে সম্মানিত করেন সেই প্রকৃতপক্ষে সম্মানিত, আর যাকে লাঞ্চিত করনে সেই প্রকৃতপক্ষে লাঞ্চিত। কিয়ামতের দিনই বুঝা যাবে কে অপরাধী এবং লাঞ্চিত, আর কে পুরস্কৃত এবং সম্মানিত। তাই তো কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেন, “বল, হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন এবং আপনি যাকে চান সম্মান দান করেন। আর যাকে চান অপমানিত করেন। আপনার হাতেই কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান”।(সূরা আলইমরানঃ ২৬) আমরা ঐদিনের অপেক্ষায় রইলাম।

[চলবে >>> ৩য় পর্ব দেখুন]

বিষয়: বিবিধ

৩১৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File