শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার নির্মম হত্যাকাণ্ডে আমরা শোকাহত [পর্ব-১]

লিখেছেন লিখেছেন ইঞ্জিঃ আবুল হোসেন রহমতুল্লাহ ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৭:০০:৫৬ সন্ধ্যা



"যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা আসলে জীবিত । কিন্তু তোমরা তা (তাদের শহীদি জীবন সম্পর্কে) অনুভব করতে পারছো না।" [সূরা বাক্বারাঃ ১৫৪]

"আর যে ব্যক্তি স্বজ্ঞানে অন্যায়ভাবে মুমিনকে হত্যা করে, তার পুরস্কার (শাস্তি) হচ্ছে জাহান্নাম যেখানে সে চিরকাল থাকবে, তার উপর আল্লাহর গযব ও লানত এবং আল্লাহ তার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।" [সূরা নিসাঃ ৯৩]

আজ ১২ ডিসেম্বর, ২০১৩ সাল, রাত ১০টা ১ মিনিটে শহীদ আবদুল কাদের মোল্লাকে জুডিসিয়াল কিলিং-এর মাধ্যমে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের পাতায় নতুন করে যোগ হল কলঙ্কময় আর একটি কাল রাত। প্রহসনের বিচারের নামে এটা সারা দুনিয়ায় সর্বকালের সবচেয়ে বড় অবিচার এবং এমন ঘৃন অবিচারই তো চরম মানবতাবিরোধী অপরাধ। আর তাই আজ বাংলাদেশ সহ সারা দুনিয়ার সমস্ত মুসলিম ভাইবোনরা গভীরভাবে শোকাহত। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেঊন।

ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা ও চরম মানব অধিকার লংঘন

তথাকথিত মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের নামে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘনতম মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হল এ রাতে। মীরপুরের অবাঙ্গালী বিহারী কুখ্যাত খুনী রাজাকার কাদের কসাই যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিক্ষুব্দ জনতার গনধোলাই আক্রমনে নিহত হয় সেই মৃত কাদের কসাইকে কাল্পনিক পুনর্জন্ম দিয়ে ফরিদপুরের কৃতি সন্তান, ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গকারী মহৎ চরিত্রর অধিকারী, মেধাবী শিক্ষাবিদ ও সাংবদিক, আব্দুল কাদের মোল্লাকে কাল্পনিক কাদের কসাই সাজিয়ে ভুঞা সাক্ষীদের দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে বিদেশী প্রভু ও যালিম শাসকের নির্দেশে প্রহসনের বিচারের রায়ে হত্যা করা হয়। শুধু তাই নয়, নজির বিহিনভাবে জেল কোডও লংঘন করা হয়েছে। রায় পাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় সীমা শেষ হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়।

এতকাল দেখে এসেছি সাধারনত গভীর রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হয় এবং ভোরবেলা পরিবার ও স্বজনদের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়, অথচ আজই তার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে গভীর রাত হওয়ার অনেক আগেই ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয় এবং পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে কড়া পুলিশ, রাব ও বিজিবির নিরাপত্তা পাহাড়ায় ফরিদপুর জেলায় তাঁর গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে গভীর রাতের অন্ধকারে দাফন করতে বাধ্য করে। এমন কি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদেরকেও জানযায় অংশগ্রহন করার সুযোগ দেওয়া হয় নাই। রাতে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা যাতে গ্রামের বাড়ীতে যেতে না পারে এ উদ্দেশ্যে তাঁর বাড়ীতে হামলা চালানো হয়। পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী শহীদ আবদুল কাদের মোল্লাকে হজের ও ওমরার কাপড় দিয়ে কাফন পরানো সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই নির্মমতা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার তাঁর পরিবারকে জানাজায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। এমনকি পরিবারের সদস্যদেরকে তাঁর ‘মুখ’ দেখার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করেছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে তাঁর পরিবারকে জানাজা ও দাফনে অংশগ্রহণ করতে না দেয়া এবং শেষবারের মতো মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত করে তাদের ধর্মীয় ও মানবিক অধিকার খর্ব করেছে। এ ঘটনা নজিরবিহীন এবং আমরা এ যালিম ইসলাম বিদ্বেষী সরকারকে ধিক্কার জানাই।

গভীর রাতে কনকনে শীত উপেক্ষা করে দাফনে অংশ নিতে ছুটে আসা হাজার হাজার স্থানীয় জনতাকে বাধা দিয়েছে পুলিশ। এ সময় তাদের একবারের জন্য শেষ দেখাও দেখতে দেয়া হয়নি। দাফনে অংশ নিতে আসার পথে গ্রেফতার করা হয়েছে শুভাকাক্সী, সমর্থক ও দলীয় নেতাকর্মীদের। বাধা দেয়া হয়েছে সংবাদ সংগ্রহে সদরপুরে যাওয়া সংবাদকর্মীদেরও। মধ্য রাতে কনকনে শীতের মধ্যে তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও গভীর রাতে অন্ধকার ও তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যে বাড়ীটি পুলিশ ঘেরাও করার আগে হাজার হাজার জনতা যারা উপস্থিত ছিল তারা জানাযায় অংশগ্রহন করে।

আল্লাহর পথে শাহাদাতের তীব্র আকাঙ্খায় সব ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে, হাসিমুখে আল্লাহর দরবারে চলে গেলেন আমাদের প্রিয় নেতা, জনগণের প্রিয় আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই। দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করে তিনি এখন তার মালিকের সান্নিধ্যে। মৃত্যু ভয়ে একটুও বিচলিত না হয়ে মুমিনের সর্বোত্তম মর্যাদা ও সর্বোচ্চ সৌভাগ্য শাহাদত প্রাপ্তিরর আশায় হাসি মুখে তিনি ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন। আল্লাহ যেন তাঁর এ আশা পুরন করে তাঁকে ক্ষমা করে দিয়ে শাহাদতের মর্যাদা দান করেন। এতক্ষনে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গিয়ে প্রাণ খুলে হাসছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু তার বিরহে কাঁদছে বাংলাদেশ, কাঁদছে সারা বিশ্বের তৌহিদীবাদী জনতা।

শহীদের মর্যাদা লাভ করে আমাদের প্রান প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই খুবই সৌভাগ্যবান, যে সৌভাগ্য সারা জীবন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেও সবার ভাগ্যে জোটে না। কিন্তু আমরা খুবই দুর্ভাগ্যবান এক জাতি যারা সর্ব নিকৃস্ট এ যালিম শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ (প্রতিরোধ সংগ্রাম) করে মুসলিম হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে পারলাম না। এ জন্য আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় আমাদেরকেও দাড়াতে হবে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালনের কারনে, যেভাবে ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে বিদেশী ব্রিটিশ প্রভু ক্লাইভের নির্দেশে এ দেশের ষড়যন্ত্রকারী ব্রিটিশ তাবেদার শাসক মীর জাফরের ট্রাইবুনালে প্রহসনের বিচারের রায়ে হত্যা করার সময় কোটি কোটি বাঙ্গালী জনতা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলো। আর তাঁর খেসারত এ বাঙ্গালী জাতিকে দিতে হয়েছে দুশত বছরের বিদেশী প্রভু ব্রিটিশদের গোলামী করে।

সেই একই আলামত ও নমুনা আজ ২০১৩ সালেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে এখন বিদেশী প্রভু হলো পৌত্তলিক ব্রাহ্মন্যবাদী ভারত এবং বিদেশী প্রভুর তাবেদারের ভূমিকায় বর্তমান ইসলাম বিদ্বেষী আওয়ামী যালিম শাসক।

আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর সাথে আমার বিশেষ একটি সম্পর্ক ছিল, আর তা হল কুফরী শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্কুল ও মাদ্রাসাগুলিতে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে সর্বস্তরে তৌহিদী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর উদ্দেশ্যে একটি ইসলামী শিক্ষা কার্যক্রম প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর তুলনায় আমার তেমন কোন যোগ্যতা না থাকলেও আল্লাহর মেহেরবানীতে আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর সাথে আমিও ঐ প্রতিষ্ঠানের একজন সদস্য। ঐ প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলি কার্যক্রমের মধ্যে একটি প্রধান কার্যক্রম- ইসলাম ধর্ম পাঠ্য পুস্তক ছাড়াও বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজী, সমাজ পাঠ, বিজ্ঞান সবগুলি পাঠ্য পুস্তকে কুফরী ও শেরেকী বিষয়গুলি উচ্ছেদ করে আল্লাহর একত্ব এবং শ্রেষ্টত্ব তুলে ধরে ধর্মীয় চেতনায় শিক্ষিত আদর্শ চরিত্রবান নাগরিক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ইসলামী ভাবধারায় পাঠ্য পুস্তক তৈরী করা। আর এ উদ্দেশ্য স্কুল, মাদ্রাসা ও কিণ্ডার গার্টেনে প্রথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ স্তর পর্যন্ত বিজ্ঞান পাঠ্য বই রচনার দায়িত্ব আল্লাহর মেহেরবানীতে আমি পালন করি এবং ১৯৯৩ সালে প্রথম বিজ্ঞান সিরিজের পাঠ্য পুস্তক আমি রচনা করার পর শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই তা সম্পাদনা করেন।

কয়েকদিন আগে যখন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর ফাঁসি কার্যকর করার পস্তুতি চলছিল তখন অতীতের সেই স্মৃতি স্মরন করে ৩য় শ্রেনীর বিজ্ঞান বইটার মলাট খুলে প্রথম পাতায় রচনা আমার নামের নিচে সম্পাদনা আব্দুল কাদের মোল্লা নামটা পড়ে আমি খুবই মর্মাহত ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লাম এবং হু হু করে অন্তরাত্মা কেঁদে উঠলো। আজ এ মুহুর্তে আমার সেই প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইকে হারিয়ে আমি অতি শোকাহত ও গভীর মর্মাহত, নিজের মনকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না। কয়েকদিন যাবৎ গভীর উৎকন্ঠায় কোন কাজে মন বসাতে পারছিলাম না এবং এ মুহুর্তে তাঁকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দিয়ে হত্যার খবর শুনে শোকে পাথর, নিজের মনকে শান্তনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি। যতদিন আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন ততদিন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর সাথে নিবির সম্পর্কের এ স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারবো না।

হাদীসে আছে শহীদরা তাদের পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন এবং পরিচিত পছন্দের লোকদের জন্য জান্নাতের সুপারিশ করতে পারবে যাদের অনেকেরই জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গিয়েছে, সুপারিশ করার এমন ক্ষমতা ও সৌভাগ্য রাসুলুল্লাহ (স) ছাড়া আর কোন সাধারন মুসলমানকে দেওয়া হয় নাই। এ থেকেই বুঝা যায় শহীদের মর্যাদা কত বড়। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, যালিম শাসকদের নিষ্ঠুর আচরনের কারনে আমার প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর সাথে শেষ দেখা করতে পারলাম না। তাঁর সাথে শেষ দেখা করতে পারলে অনুরোধ করতে পারতাম, যেভাবে আমার লেখা বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনা করে দিয়েছেন সেভাবে রোয কিয়ামতের দিন কঠিন সময়ে জান্নাতে যাওয়ার পথটাও যেন সম্পাদনা করে দেন, অর্থাৎ আমার জন্য যেন সুপারিশ করেন। আজ এ মুহুর্তে আমার প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইকে হারিয়ে গভীর মর্ম যাতনা ভোগ করলেও একথা ভেবে শান্তনা পাচ্ছি যে, তাঁর আদর্শ ও অনুপ্ররনায় উজ্জীবিত হয়ে আরো দ্বিগুন বেশী উৎসাহ নিয়ে ইসলামী ভাবধারায় আদর্শ শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারি আল্লাহ যেন সেই যোগ্যতা দান করেন। বিজ্ঞান বইর লেখক হিসাবে আমার নামের পাশে সম্পাদক হিসাবে যেভাবে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর নামটা আছে সেভাবে জান্নাতেও যেন সশরীরে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর পাশে থাকতে পারি। আল্লাহর কাছে এখন এ দোয়াই করি।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার সংক্ষিপ্ত জীবনী

আমার প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৪ আগষ্ট ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার আমিরাবাদ গ্রামে। ঐ একই দিন বাংলার অবহেলিত মুসলিম জনতা ব্রিটিশ গোলামী থেকে মুক্তি লাভ করে এবং তাই সেই মুক্তি ও স্বাধীনতার আনন্দের সাথে আমিরাবাদ গ্রামের মোল্লা বাড়ীতে যোগ হয় নবজাতক জন্ম গ্রহনের আনন্দ। আমি নিজেও বর্তমান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রামের বাড়ী টুঙ্গীপাড়ার পাশের একটি গ্রামের মোল্লা বাড়ীর সন্তান, এ দিক দিয়েও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর সাথে আমার একটা মিল আছে।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই শুধুমাত্র একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, একজন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদও ছিলেন যা উপরে সামান্য উল্লেখ করেছি, শুধু তাই নয় সাংবাদিকতা পেশায়ও তিনি ছিলেন সফল। এক কথায় তিনি ছিলেন একের ভিতর অনেক গুনের অধিকারী এবং ছাত্রজীবনে তিনি অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এমন কোন শাখা নাই যেখানে পদচারনা করেন নাই এত বড় বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি।

তিনি যথাক্রমে ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৯৬৪ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইন্সিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণীতে মাধ্যমিক পরিক্ষায় কৃতকার্য হন। এরপর তিনি একই জেলার রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে ১৯৬৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষায় উত্তীর্ন হন। ১৯৬৮ সালে তিনি একই কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। কিন্তু প্রবল আর্থিক সংকটের কারনে এরপর তাকে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করতে হয়। পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া হয়নি তখন আর। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। মুক্তিযুদ্ধের কারনে ১৯৭১ সালে তার মাস্টার্স পরীক্ষা দিতে পারেন নাই। যুদ্ধের সময় নিজ গ্রামের বাড়িতে থেকে বাইশরশি শিবসুন্দরী একাডেমিতে শিক্ষকতা করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শুরু করেন। আর্থিক সংকটের কারনে পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি প্রাইভেট টিউশনি এবং খণ্ডকালিন চাকরীও করেছেন। গোপালগঞ্জ তখন জেলা হয় নাই, ফরিদপুর জেলার অধীনে একটি মহাকুমা ছিল এবং তৎকালিন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিশেষ সুপারিশে ১৯৭৪ সালে তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনে সংস্কৃতি কর্মকর্তা হিসাবে চাকরি নেন। এ চাকরী করা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়শুনাও চালিয়ে যান।

১৯৭৫ সালে তিনি সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষা প্রশাসন থেকে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রী অর্জন করেন এবং অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে ১৯৭৭ সালে তিনি শিক্ষা প্রশাসন থেকে এম,এড (মাস্টার্স অব এডুকেশন) ডিগ্রী অর্জন করেন। এখানেও তিনি প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হন।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই এমন একজন অসাধারন শিক্ষা অনুরাগী ছিলেন যিনি ছাত্র জীবন থেকেই শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকার বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। পরে তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং পরে ঐ একই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৮ সালে তিনি রিসার্স স্কলার হিসাবে ইসলামী শিক্ষা কার্যক্রম প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন যে প্রতিষ্ঠানের সাথে আমি এ অধম জড়িত যা উপরে উল্লেখ করেছি। তিনি ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতিবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও আর্থিক সহায়তায় দেশে মুসলমান ছেলে-মেয়েদের আধুনিক শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ নামে আন্তর্জাতিক মানের একটি ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন,যা বর্তমানে মানারাত ইউনিভার্সিটি হিসেবে পরিচিত এবং ঐ প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে তিনি প্রায় এক বছর কাজ করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্বও দক্ষতার সাথে পালন করেন।

আমার প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই কত বড় উচু মানের শিক্ষা অনুরাগী ছিলেন তা বর্ননা করে শেষ করা যাবে না, উপরের সামান্য যেটুকু বর্ননা করলাম তা থেকেই বুঝা যায় তাঁর অসাধারন প্রতিভা। তিনি সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংস্থার সাথেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর নিজ থানা সদরপুর মাদরাসা ও এতিমখানা, ফরিদপুর জেলার হাজিডাঙ্গি খাদেমুল ইসলাম মাদরাসা ও এতিমখানা, সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী একাডেমী অন্যতম।

১৯৮১ সালে তিনি বিখ্যাত দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসাবে যুক্ত হন। তখন থেকেই তিনি সাংবাদিকতার সাথে জড়িত হয়ে পড়েন এবং ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে তিনি পরপর দুই বার ঢাকা ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট (ডি ইউ জে) এর সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। সাংবাদিকতা পেশায় থাকা অবস্থায় তিনি দেশ বিদেশের সমসাময়িক বিষয়ের উপর অনেক কলাম ও প্রবন্ধ লিখেছেন। ইসলামের বিভিন্ন দিকের উপর তাঁর লেখা সুচিন্তিত কলাম ও প্রবন্ধ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও বস্তুবাদ, কম্যূনিজমের উপরে তার বৈজ্ঞানিক সমালোচনা শিক্ষিত মহলের কাছে সমাদৃত হয়েছে। সাংবাদিকতা পেশায়ও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর সাথে আমার কিছুটা মিল আছে। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও আমি ছাত্র জীবনে একটি পত্রিকার সম্পাদক থাকা অবস্থায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম এবং ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করার পর ইঞ্জিনীয়ারদের পেশাজীবি সংগঠনে পর পর তিনবার সারা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রচার ও পত্রিকা সম্পাদক নির্বাচিত হই। তবুও আমি বলবো আমার প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইর তুলনায় সামান্যতমও যোগ্যতা অর্জন করতে পারি নাই, এত অসাধরন গুনের অধিকারী ছিলেন তিনি।

ছাত্রজীবন শেষে ১৯৭৭ সালের মে মাসে তিনি বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে যোগ দেন এবং ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে রুকন হিসাবে শপথ নেন। তারপর থেকে তিনি বিভিন্ন পদে উন্নীত হয়ে সর্বশেষ সহকারী সাধারন সম্পাদক হিসাবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। ২০০১ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহর অশেষ রহমতে হার্ট অপারশনে নতুন জীবন ফিরে পান। বাকী জীবন মানসিক চাপমুক্ত থাকতে এবং পরিশ্রমের কাজ করা থেকে বিরত থেকে বিশ্রাম ও নিয়মিত ঐষধ সেবন করতে ডাক্তারের পরামর্শ থাকা সত্ত্বেও তিনি নিষ্ঠার সাথে ইসলামী আন্দোলনের কঠিন দায়িত্ব ও পরিশ্রমের কাজ করে গিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের কাজে যথার্থ বিশ্রাম ও নিয়ম পালন তিনি করতে তো পারতেনই না, অধিকন্তু অনেক মানসিক চাপও সহ্য করেছেন। হার্ট অপারশনের পর তিনি একবার আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন,“ডাক্তার আমাকে বিশ্রাম নিতে বললেও আমি বিশ্রাম নিতে পারতাম না। আমি বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছি এমন সময় দেখা গেল ইসলামী আন্দোলনের একজন সাধারন কর্মী আমার বাসায় এসে হাজির আমার সাথে দেখা করার জন্য। আমার স্ত্রী পর্দার আড়াল থেকে যখন বলে ‘উনি এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন’, তখন তিনি আমার স্ত্রীকে বলেন, ‘ওনার কানের কাছে গিয়ে আস্তে বলেন- অনেক দূর থেকে অমুক ভাই এসেছে’। এরপর আমি সারা না দিয়ে কি পারি?” এ কথা শুনে আমিও নিজের মনের আবেগ আর ধরে রাখতে পারি নাই, নিরবে শুধু কেদেছি।

আমার সবচেয়ে বেশী কষ্ট লেগেছে বিশেষ করে মিথ্যা যুদ্ধ অপরাধ মামলায় তাকে গ্রেফতারের পর যখন জেলের ভিতর অনেক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে এবং যেভাবে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে একজন হার্টের ও ডায়াবেটিক রোগীকে আলো বাতাস বিহীন প্রিজন ভ্যানে করে জেল থেকে আদালত ও আদালত থেকে জেলে টানা হ্যাঁচরা করা হয়েছে তা দেখে।

[চলবে >>> ২য় পর্ব দেখুন]

বিষয়: বিবিধ

২৬৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File