আজ ১৭ রমাদান ঐতিহাসিক বদর দিবস এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা [রমাদান পর্ব:১৭]
লিখেছেন লিখেছেন ইঞ্জিঃ আবুল হোসেন রহমতুল্লাহ ২৭ জুলাই, ২০১৩, ০৪:৫০:৪৪ রাত
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও সালাম নবীদের নেতা বিশ্বনবী (স), তাঁর পরিবারবর্গ ও তার সাহাবীদের প্রতি।
পবীত্র রমাদান মাস উপলক্ষে "রমাদান মাসঃ কারো সৌভাগ্য, কারো দুর্ভাগ্য" শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে আসছি। আজ তারই ধারাবাহিকতায় ১৭ই রমাদান ১৭ তম পর্বে ঐতিহাসিক বদর দিবস উপলক্ষে আমার মত একজন অধমের এ সামান্য আয়োজন।
"রমাদান মাসঃ কারো সৌভাগ্য, কারো দুর্ভাগ্য" পূর্বের পর্বগুলি পড়ার অনুরোধ করছি]
Link: http://www.bdtomorrow.net/blog/blogdetail/detail/2973/rahmatullah/21533#.UfL8BNIwdhg
আজ ১৭ রমাদান ঐতিহাসিক বদর দিবস। রাসুলুল্লাহ (স) বায়াতের মাধ্যমে মদীনার জনগনের সমর্থন এবং সাহাবাদেরকে সাথে নিয়ে হিজরত করে মদীনায় একটি কল্যানমুখী ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার পর ২য় বর্ষে ১৭ রমাদান বদর নামক স্থানে মক্কার কাফের মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্তি যুদ্ধের নাম বদরের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ কোন সাম্রাজ্য বিস্তার কিংবা পর রাজ্য দখলের যুদ্ধ ছিল না, এ যুদ্ধ ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে নির্যাতিত মানবতার মুক্তি ও স্বাধীনতার যুদ্ধ যেখানে কোন ক্ষমতাবান রাজা কোন নিরিহ প্রজাকে শোষন ও যুলুম করবে না, কোন শক্তিশালী সম্প্রদায় বা গোষ্ঠি অন্য কোন দুর্বল সম্প্রদায় বা গোষ্ঠি উপর প্রভুত্ব করবে না, কোন বৃহৎ শক্তি অপর কোন ক্ষুদ্র শক্তির উপর আধিপত্য বিস্তার করবে না।
আজকাল মুসলমান নামধারী বুদ্ধিজীবি ও রাজনৈতিক নেতাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা শুনলে মনে হয় ইসলাম হল সাম্প্রদায়িক মধ্যযুগীয় বর্বর শোষনের হাতিয়ার, তাই ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক সমাজ কায়েম করাই হল মুক্তি যুদ্ধের চেতনা। আর আমাদের দেশের সাধারন মুসলমানরাও তাদের এসব চেতনা বাক্যে চেতনা হারিয়ে বেহুশ হয়ে তাদের পিছে নেশাগ্রস্থের মত ছুটে বেড়াচ্ছে। মরুভূমিতে তৃঞ্চার্ত যাযাবর যেমন পানির সন্ধানে মরিচিকাকে পানি মনে করে সেদিকে ছুটে চলে আর কখনো পানি পায় না, তেমনি আমরাও এসব ফাঁকা চেতনার পিছে ছুটতে ছুটতে দিশেহারা হয়ে আজ পর্যন্ত কোন মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বাধ পেলাম না।
যখন আমি মূর্খ ছিলাম তখন আমিও ঐ দলেরই একজন ছিলাম। কুরআন হাদীসের জ্ঞান না থাকা মানেই মূর্খ, যতই সে অন্য বিষয়ে সর্বোচ্চ ডক্টরেট ডিগ্রীধারী হোক না কেন, এমনকি নামের সাথে ডাক্তার বা ইঞ্জিনীয়ার কিংবা বিদ্যাসাগর ও অন্য পদবী থাক না কেন। যেমন আবু জেহেলের আসল নাম ছিল ‘আবুল হাকাম’ অর্থ ‘জ্ঞানের বাবা’ অর্থাৎ ‘মহাজ্ঞানী’ এবং ঐ যুগে আরবের সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবি ও পণ্ডিত ছিল। কিন্তু তার এ জ্ঞানের অহঙ্কারে যখন সে মহানবী যিনি ছিলেন অক্ষর জ্ঞানহীন তাঁর (স) নবুয়াত ও আল্লাহর ওহী কুরআনকে অস্বীকার করলো তখন হয়ে গেল ‘আবু জেহেল’ অর্থাৎ ‘মহামূর্খ’। এ কারনেই আমি বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ইঞ্জিনীয়ার হলেও ক্লাশ ওয়ান পাশ করা একজন যার কুরআন হাদীসের জ্ঞান আমার চেয়ে অনেক বেশী তিনি আমার চেয়েও উচ্চ শিক্ষিত ও অনেক বড় জ্ঞানী।
যখন আমি বুঝলাম আসলেই আমি মূর্খ, তখন নিজের মূর্খতা দূর করে সুশিক্ষিত হওয়ার উদ্দেশে কুরআন শরীফ অর্থসহ বুঝে পড়ার চেষ্টা করলাম এবং এক পর্যায়ে কুরআন শরীফের একটি আয়াতে জানলাম, “আমি তোমার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি যাতে সব কিছুই পরিষ্কারভাবে খুলে বর্ণনা করা হয়ছে এবং (আল্লাহর আনুগত্যকারী) মুসলমানদের জন্যে হেদায়েত (Guide Line,পথনির্দেশ), রহমত এবং সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।” (সূরা নহলঃ ৮৯)। আরবী ‘কুল্লা শাইয়ি’ অর্থ ‘সব কিছুই’, তার মানে কুরআন শরীফে এমন কোন বিষয় নাই যা আল্লাহ বাদ রেখেছেন। তখন ভাবলাম সব বিষয়ই যখন কুরআন শরীফে আল্লাহ খুলে বর্ণনা করছেন, তখন নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথাও আছে এ কুরআন শরীফে, এটাও বাদ থাকার কথা নয়। এরপর আল্লাহর অশেষ দয়ায় কুরআন শরীফের ভিতর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য দুটোই খুঁজে পেলাম।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি?
কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেন, “হে মানব জাতি! দাসত্ব করো তোমাদের রবের (পালনকর্তার), যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন।, যেন তোমরা মুক্তি লাভের আশা করতে পারো।” (সুরা বাক্বারাঃ ২১) এ আয়াতে মূল আরবী শব্দ “তাত্তাকুন” শব্দ দ্বারা সমস্ত অকল্যাণ, পাপ কাজ, শয়তানের কুমন্ত্রনা এবং আখেরাতে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বেচেঁ থাকা (উর্দু ও ফারসীতে পরহেযগারী লাভ) অর্থাৎ এক কথায় মুক্তি লাভ বুঝানো হয়েছে। এ আয়াতে শুধু মুসলিম নয়, সমস্ত মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে।
আমরা কুরআন পড়ি কিন্তু “ইবাদত” শব্দের অর্থ না বুঝার কারনে আল্লাহ ছাড়া আরো অনেকেরই দাসত্ব করি। আবার যারা অর্থ পড়ি তারা অনেকেই ইবাদত শব্দের অর্থ উপসনা পড়ি, কিন্তু এ উপসনা শব্দের অর্থও জানি না। আরবী ইবাদত শব্দটি মূল ‘আব্দ’ শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ বাংলায় ‘দাস’, উর্দুতে ‘গোলাম’, ফারসীতে ‘বান্দা’, যেমন আমরা আমাদের নাম রাখি আবদুল্লাহ যার অর্থ আল্লাহর দাস এবং ‘ইবাদত’ শব্দের সহজ ও সঠিক অর্থ বাংলায় ‘দাসত্ব’ করা, উর্দুতে গোলামী করা, ফারসীতে বন্দেগী করা। ইবাদত শব্দের এ সহজ অর্থটি যদি আমরা বুঝি তাহলে একটু চিন্তা করিঃ অন্য অনেকের দাসত্ব বা গোলামী করা কি স্বাধীনতা? না কি অন্য সবার দাসত্ব বা গোলামী ছিন্ন করে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও মহাপ্রভু আল্লাহর দাসত্ব বা গোলামী করার মধ্যে স্বাধীনতা? যারা সবাই আল্লাহর সৃষ্টি তাদের দাসত্ব বা গোলামী করা মানেই পরাধীনতা নয় কি?
নবী ইউসূফ (আ) যখন নারী ধর্ষনের মিথ্যা মামলায় কারাগারে বন্দী (বর্তমান যুগেও ঐ একই কায়দায় বিভিন্ন দেশে সম্মানীত আলেম ওলামা ও ইসলামী দলের নেতাদেরকে বিভিন্ন নামের ট্রাইবুনালে গনহত্যা ও নারী ধর্ষনের মিথ্যা মামলায় কারাগারে বন্দী করে রাখা হচ্ছে), তখন একদিন দুজন কারাবন্দী কয়েদীর স্বপ্নের ব্যখ্যা দিতে গিয়ে তিনি মুক্তি ও স্বাধীনতার এই মূল মন্ত্র কত সুন্দর ও চমৎকার উদাহরণ দিয়ে বুঝালেন যা আল্লাহ কুরআন শরীফে এভাবে উল্লেখ করেছেন, “হে কারাগারের সঙ্গীরা! ভেবে দেখো পৃথক পৃথক অনেক প্রভু ভাল, না সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী পরাক্রমশালী এক আল্লাহ? তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের দাসত্ব কর, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে, আল্লাহ এগুলোর পক্ষে কোন দলিল প্রমাণ নাযিল করে পাঠাননি। আল্লাহ ছাড়া কারও হুকুম করার (সর্বপ্রকার আইন ও বিধানের) ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কারও দাসত্ব করো না। এটাই (মুক্তির জন্য) প্রতিষ্ঠিত ও সুদৃঢ় নীতি। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।” (সুরা ইউসুফঃ ৩৯-৪০)
এ আয়াত থেকেই আমরা মুক্তি ও স্বাধীনতার চেতনা লাভ করতে পারি। কুরআনের এ আয়াতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ৩ টিঃ
১) ব্যক্তি জীবন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর কুরআনের হুকুম (দেশের সংবিধান, আইন কানুন, বিচার, অর্থনীতি সব কিছু) প্রতিষ্ঠিত করা।
২) একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করা এবং একমাত্র আল্লাহকে প্রভূ মানা।
৩) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও দাসত্ব না করা ও অন্য কাউকে প্রভূ না মানা।
এ ৩ টি মূল চেতনার মধ্যেই আছে বিশ্ব মানবতার মুক্তি। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধ ছিল বদর যুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা লাভ করতে হলে বদর যুদ্ধ সম্পর্কে জানা দরকার। পরবর্তি পর্বে বদর যুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে আরো আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
চলবে >>>>> [পরবর্তি পর্ব-১৮]
বিষয়: বিবিধ
১৭০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন