রমাদান মাসঃ কারো সৌভাগ্য, কারো দুর্ভাগ্য [পর্ব:২]
লিখেছেন লিখেছেন ইঞ্জিঃ আবুল হোসেন রহমতুল্লাহ ১১ জুলাই, ২০১৩, ০৬:৪৮:০০ সন্ধ্যা
[ধারাবাহিকতার জন্য পূর্বের পর্ব-১ পড়ার অনুরোধ করছি]
Link:http://www.bdtomorrow.net/blog/blogdetail/detail/2973/rahmatullah/21387#.Udy0bzul4ms
রমাদান মাসে রোযার উদ্দেশ্যঃ
যদি জিজ্ঞাসা করা হয়-রমাদান মাসে কি উদ্দেশ্য আমরা রোযা রাখি? কেউ বলবেন ফরজ ইবাদত তাই রোযা রাখি, কেউ বলবেন রোযা রাখলে অনেক সওয়াব পাওয়া যাবে, এমনি আরো অনেক উত্তর পাওয়া যাবে। মনে করুন কোন ছাত্রকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়- স্কুলে এত পড়া লেখা যে কর এর উদ্দেশ্য কি? আর উত্তরে যদি সে বলে পরীক্ষায় পাশের জন্য বা জিপিএ পাওয়ার জন্য কিংবা S.S.C পাশ করে ভাল কোন কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য, উত্তর সঠিক মনে হলেও স্কুলে পড়া লেখা করার মূল উদ্দেশ্য কি তাই? যদি পড়া লেখা করা হয় পরীক্ষায় পাশের জন্য, তাহলে পরীক্ষায় পাশের উদ্দেশ্য কি? চট করে উত্তরে বলা যাবে, কেন কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য। তাহলে কলেজে ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্য কি? এভাবে একটার পর একটা উত্তর পাওয়া গেলেও স্কুলে পড়া লেখার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু তা নয়, মূল উদ্দেশ্য হল জ্ঞান অর্জন করে সুশিক্ষিত হওয়া এবং সুশিক্ষিত হওয়ার কারনেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
তেমনি রমাদান মাসে রোযা ফরজ ইবাদত এবং অনেক সওয়াব আছে তাই আমরা রোযা রাখি কথাটা সত্য, আর যে কোন ইবাদত তা ফরজ হোক আর সুন্নত নফল যাই হোক করলেই সওয়াব আছে এ কথাও সত্য। কিন্তু রমাদান মাসে রোযা ফরজ করা হল কেন এবং কোন উদ্দেশ্যে? তা আমরা অনেকেই জানি না। যে কোন কিছুর উদ্দেশ্য জানা থাকলে তার গুরুত্ব অন্তরে গভীরভাবে উপলব্দি করা যায় এবং একাগ্র চিত্তে সঠিকভাবে পালন করতেও সহায়ক হয়। আমরা আমাদের দৈনন্দিক সব কাজগুলি কোন না কোন উদ্দেশ্যে খুব উৎসাহ নিয়ে করি, এমন কোন কাজ নাই যা উদ্দেশ্য ছাড়া করি, অর্থাৎ উদ্দেশ্য ছাড়া কোন কাজই করি না, এত সতর্ক আমরা! অথচ আমাদের চরম দুর্ভাগ্য, আমরা আল্লাহর ফরজ নির্দেশ এবং ইসলামের বিভিন্ন ইবাদতের কোন উদ্দেশ্য জানি না, ফলে গভীরভাবে উপলব্দি করতে পারি না, আর গভীরভাবে উপলব্দি করতে না পারার কারনে কোন রকমে দায়সারা ভাবে পালন করি। ফলে ফল যা হওয়ার তাই হয়, আর কি ফল অর্জন করলাম তাও বুঝতে অক্ষম।
আসুন যিনি আমাদের জন্য রোযা ফরজ করেছেন সেই আল্লাহর কাছ থেকে জেনে নেই রোযা কি উদ্দেশ্য, অর্থাৎ কুরআন শরীফ থেকে জেনে নেই আল্লাহ কি বলেন?
“হে ঈমানদাগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী (নবীদের অনুসারীদের) ওপর ফরয করা হয়েছিল ৷ এ উদ্দেশ্যে যে, আশা করা যায় তোমাদের মধ্যে তাকওয়া (অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে পাপ কাজ থেকে বেচেঁ থাকার গুণাবলী) সৃষ্টি হবে” (সূরা বাক্বারাঃ ১৮৩)
রমাদান মাসের অনেক ফজিলত আমরা শুনি এবং অনেক সওয়াবের কাজও করি, কিন্তু “রমাদান” শব্দের অর্থ আমরা অনেকেই জানি না। এমন কি এ মাসে আমরা রোযা রাখি, কিন্তু এ রোযা শব্দের মূল উৎস আরবী “সিয়াম” শব্দের অর্থও আমরা জানি না। আর এ মাসে রোযা ফরজ হওয়ার উদ্দেশ্যও জানি না। ফলে আমরা রমাদান মাসের গুরুত্ব উপলব্দি না করে উদ্দেশ্যহীন ভাবে উপবাস করি এবং উদ্দেশ্যহীন ভাবে অনেক সওয়াবের কাজ করি, অবশেষে রমাদান মাস শেষ হলে পূন্যের খাতায় ফলাফল শূন্য যেমনটি ১ম পর্বে একটি হাদীস উল্লেখ করেছিলামঃ আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্নীত, রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও খারাপ কাজ করা ত্যাগ করতে পারল না সে আহার ও পান করা ত্যাগ করলো কিনা (অর্থাৎ রোযা রাখলো কিনা) আল্লাহর তার কোন প্রয়োজন নাই। (বুখারী) অর্থাৎ সারা রমাদান মাসে কষ্ট করে রোযা রেখে, এত ফজিলতের বয়ান শুনে ও অনেক সওয়াবের কাজ করেও তার সব আমল ব্যর্থ এবং সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে সে মহাদুর্ভাগ্যবান।
আরবী “রমাদান” শব্দটি মূল “রমদ্” শব্দ থেকে এসেছে, এর আভিধানিক অর্থ দগ্ধ করা, দহন করা, জালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করা। অর্থাৎ মনের কুপ্রবৃত্তি, কুচিন্তা, পাপ কাজের প্রতি ইচ্ছা ও আগ্রহ সবকিছু জালিয়ে পুড়িয়ে মনকে কলুষমুক্ত যেন মু‘মিনের জীবন পাপমুক্ত হয়ে পবিত্র হয়ে যায়, যেভাবে আগুনে পুড়িয়ে সোনা খাঁটি ও খাদমুক্ত করা হয়, যেভাবে আগুনের তাপে দুষিত পানি ফুটিয়ে জীবানু মুক্ত করা হয়।
“রোযা” ফারসী শব্দ, বাংলায় “উপবাস”, ইংরেজীতে “Fasting”। কিন্তু কুরআন শরীফে আরবী “সিয়াম” শব্দের সঠিক অর্থ এগুলোর কোনটাই না। “সিয়াম” শব্দটি মূল “সওম” শব্দ থেকে এসেছে, এর আভিধানিক অর্থ “বিরত থাকা”। অর্থাৎ দিনের বেলা খাদ্য, পানীয় ও স্বামী স্ত্রীর মিলিত হওয়া থেকে বিরত থাকা, যদিও অন্য সময় এগুলি হালাল (বৈধ) এবং সারা রমাদান মাসে সকল প্রকার পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা। যেখানে দিনের বেলা হালাল (বৈধ) কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হল, সেখানে হারাম ও পাপ কাজ থেকে বিরত না থাকতে পারলে তার ঐ সিয়াম পালন কি করে পূর্ণ হল বলে আমরা দাবী করতে পারি?
১ম পর্বে কুরআন শরীফের একটি আয়াত উল্লেখ করেছিলাম, “হে ঈমানদাগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী (নবীদের অনুসারীদের) উপর ফরয করা হয়েছিল ৷ এ উদ্দেশ্যে যে, আশা করা যায় তোমাদের মধ্যে তাকওয়া (অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার গুণাবলী) সৃষ্টি হবে” (সূরা বাক্বারাঃ ১৮৩)
ঐ আয়াতের পরে আর একটি আয়াতে আল্লাহ বলেন, “রমযান মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানব জাতির জন্য হিদায়াত (সত্য সঠিক পথ দেখানো) এবং সত্য ন্যায় পথ ও অন্যায় পথের মাঝে পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়ার উদ্দেশ্যে ৷ সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাসটি পাবে, তারা যেন এ মাসে রোযা পালন করে এবং যে ব্যক্তি রোগগ্রস্ত হয় বা সফরে থাকে, সে যেন অন্য দিনগুলোয় রোযার সংখ্যা পূর্ণ করে ৷ আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, কঠোর নীতি চাঁপিয়ে দিতে চান না ৷ তাই আল্লাহ তোমাদের যে হিদায়াত দান করেছেন সে জন্য তোমরা যেন আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।” (সূরা বাক্বারাঃ ১৮৫)
রোযা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত ও হাদীসে রাসুলুল্লাহর (স) বানী এবং মূল আরবী শব্দ “রমাদান” ও “সিয়াম” (ফারসি রোযা) শব্দের অর্থ যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, সবগুলি একত্র করলে আমরা পরিস্কার ভাবে রোযার উদ্দেশ্য জানতে পারি।
রমাদান মাসে রোযার উদ্দেশ্যঃ
১) তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার গুণাবলী অর্জন করা এবং তাকওয়ার গুণাবলী অর্জন করার পর আল্লাহর নিষেধ করা যাবতীয় হারাম কাজ (নিষিদ্ধ কাজ) থেকে বিরত থাকা। মনের কুপ্রবৃত্তি, কুচিন্তা, পাপ কাজের প্রতি ইচ্ছা ও আগ্রহ সবকিছু জালিয়ে পুড়িয়ে মনকে কলুষমুক্ত ও পাপমুক্ত করে মনকে এমনভাবে পবিত্র করা যেভাবে আগুনে পুড়িয়ে খাঁদ মিশানো সোনাকে খাঁটি ও খাদমুক্ত করা হয় এবং যেভাবে আগুনের তাপে দুষিত পানি ফুটিয়ে জীবানু মুক্ত করা হয়।
২) কুরআন থেকে হেদায়েত অর্থাৎ সত্য ও ন্যায়ের পথের সন্ধান লাভ করা এবং সত্য ন্যায় পথের সাথে অন্যায় পথের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে বুঝে নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা।
৩) হেদায়েত লাভ করার ফলে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্ত প্রচার করা।
রমাদান মাসে আমরা যারা দিনের বেলা না খেয়ে রোযা রাখি, তারা সবাই কি উপরের ঐ ৩ টি উদ্দেশ্য নিয়ে রোযা রাখি? রমাদান মাস শেষে ঐ ৩ টি উদ্দেশ্য আমাদের আদৌ পূরণ হয় কি? এ রমাদান মাসে নিজেকে একটিবারও যাঁচাই বা আত্মসমালোচনা ও নিজের আত্মত্যাগের মূল্যায়ন নিজে কখনো করে দেখার চেষ্টা করি কি? যদি উত্তর হয় “না”, তাহলে কি করে আমরা রমাদানের বরকত, রহমত, ফজিলত ও সৌভাগ্য লাভের আশা করতে পারি?
এ বিষয়ে একটি হাদীস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্নীত, রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, “যে ব্যক্তি রমদান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে (আত্মসমালোচনা ও আত্মত্যাগ সহ) রোযা পালন করবে তার পূর্বের ও পরের সব পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)
এ হাদীসটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে বেশ কয়েকটি সহীহ হাদীসে খুবই গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। অথচ আমাদের দেশে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীসটির “ইহতিসাব” শব্দটি বাংলায় “সওয়াবের আশায়” অর্থ করা হয়েছে, ফলে বাংলায় হাদীসটির গুরুত্ব একদম হালকা হয়ে গিয়েছে। ইসলামের ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল সব কাজই তো সওয়াবের আশায় করা হয়। এমন কোন পূণ্যের কাজ আছে যা সওয়াবের আশা ছাড়াই কেহ করে? এমন কি না জেনে বিদাত ও শিরকের কাজও যারা করে তারাও সওয়াবের আশায় করে, যেমন পীরের কবরে মানত ও সেজদা। অতএব রমাদান মাসে সওয়াবের আশায় রোযা রাখাটাই স্বাভাবিক, আর তাই এ হাদীসে আলাদাভাবে “সওয়াবের আশায়” বলার কোনই প্রয়োজন হয় না। রমাদান মাসে গুরুত্ব সহকারে নিজেকে যাঁচাই বা আত্মসমালোচনা করা এবং নিজের আত্মত্যাগের মূল্যায়ন করার জন্যই এ হাদীসে "ইহতেসাব" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
চলবে ইনশাআল্লাহ >>>>> [পরবর্তি পর্ব-৩]
বিষয়: বিবিধ
২৬৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন