রমাদান মাসঃ কারো সৌভাগ্য, কারো দুর্ভাগ্য [পর্ব:১]

লিখেছেন লিখেছেন ইঞ্জিঃ আবুল হোসেন রহমতুল্লাহ ১০ জুলাই, ২০১৩, ০৭:০৭:৪৩ সকাল



বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাল।ম নবীদের নেতা বিশ্বনবী (স), তাঁর পরিবারবর্গ ও তার সাহাবীদের প্রতি।

পবীত্র রমাদান মাস উপলক্ষে সবাইকে রমাদান মোবারক ও শুভেচ্ছা। সবচেয়ে বরকতময়, সৌভাগ্যময় ও বিশেষ রহমতের মাস এ রমাদান মাস। এমন সৌভাগ্যময় মাসে সবার জীবনে মহা সৌভাগ্য নিয়ে আসুক এ কামনা আমরা সবাই করি। তবে সে সৌভাগ্য আমাদের জীবনে আদৌ আসবে কি? আর সে সৌভাগ্য আসলেও তা ধরে রাখতে পারবো কি? এ রমাদান মাস কারো জন্য মহাসৌভাগ্য বয়ে আনলেও অনেকের জন্য মহাদুর্ভাগ্যও বয়ে আনে। অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এ আবার কেমন কথা? রমাদান মাস হল বরকত ও সৌভাগ্যের মাস, মহাদুর্ভাগ্য বয়ে আনবে কেন?

অনেকেই হয়তো ভাবছেন সৌভাগ্যময় রমাদান মাসে রোযার ফজিলত বর্ননা না করে কার ভাগ্য খারাপ আর কে দুর্ভাগ্যবান এসব নেতিবাচক (Negative) চিন্তাধারা নিয়ে আলোচনা কেন? উত্তরে বলতে চাই রোযার ফজিলতের তো কোন শেষ নাই, অফুরান্ত ফজিলত আছে এ বরকতময় ও সৌভাগ্যময় রমাদান মাসে, তা বর্ননা করে আর শেষ করা যাবে না। কিন্তু সেই ফজিলত লাভ করার যোগ্যতা ও গুনাবলী তৈরী না হলে হাজার হাজার ফজিলত ডানে বামে সামনে দিয়ে চলে যাবে, একটাও ফজিলত আমরা ধরতে পারবো না। এটা কি কম দুর্ভাগ্য নয়?

বাস্তব জীবনে যে কোন মূল্যবান জিনিস পেতে হলে যোগ্যতা ও গুনাবলী থাকা দরকার এবং তা পেতে হলে সতর্কতা অবলম্বন ও কিছু বাঁধা অতিক্রম করতে হয়, এ বুঝ আমাদের সবারই আছে। যেমন- হিমালয় পর্বতের সব চেয়ে উচুঁ এভারেস্ট চূড়ায় উঠতে পারা খুবই গৌরবের ব্যাপার, নতুন কেহ যদি সেখানে উঠতে চায় তখন তাকে এভারেস্ট চূড়ায় দাড়িয়ে কি কি সৌন্দর্য্য দেখা যায় কিংবা এভারেস্ট বিজয় করতে পারলে বিশ্ববাসী কেমন সম্মান দেখাবে তা বর্ননা করার পূর্বে প্রথমেই বলা হয় সেখানে উঠতে গেলে কি কি বাঁধা অতিক্রম করতে হয়, অক্সিজেনের অভাব থাকায় সাথে অক্সিজেন সিলিণ্ডার নিতে হবে কিনা, পর্বত চূড়ায় উঠার পথে আর কি কি সতর্কতা নিতে হয় সব তাকে বলা হয়। যদি এভাবে তাকে সতর্ক করা না হয়, তা হলে অসাবধনতায় যে কোন মুহূর্তে পা ফসকে গিয়ে হাজার ফুট নিচে পরে গিয়ে জীবন নাশ হতে পারে। এমন কি যে কোন সফরে ঘর থেকে বের হলেও প্রিয়জনরা প্রথমেই সতর্ক করে দেয় সাবধানে পথ চলার জন্য, তারপর বর্ননা করে সফরে গিয়ে কি কি লাভ হবে তা। সামান্য একটা ঘর তেরী করার পূর্বেও প্রথমেই চিন্তা করা হয় ঝড় বাতাসে ঐ ঘরটা টিকবে কিনা, বৃষ্টি হলে ভিতরে পানি ঢুকবে কিনা ইত্যাদি। এভাবে বাস্তব জীবনে সবক্ষেত্রেই যখন সতর্কতার জন্য প্রথমেই নেতিবাচক (Negative) দিক চিন্তা করা হয় ঐ জিনিসের মূল্য ও গুরুত্ব উপলব্দি করার জন্য, তখন সৌভাগ্যময় রমাদান মাসে রোযার এত বড় অফুরান্ত ফজিলতের মূল্য ও গুরুত্ব উপলব্দি করার জন্য এবং সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য প্রথমেই নেতিবাচক (Negative) দিক তুলে ধরা কি উচিৎ নয়?

কুরআন শরীফে বিভিন্ন সূরায় এবং বিশেষ করে ত্রিশতম পারার ছোট ছোট সূরাগুলিতে লক্ষ করলেই দেখা যাবে প্রথমেই কবর আযাব, কেয়ামতের ভয়াবহতা, আখেরাতের কঠিন অবস্থা এবং জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির বর্ননা করার পরই জান্নাতের নেয়ামত ও ফজিলত বর্ননা করা হয়েছে। জান্নাতের এত বড় নেয়ামত ও ফজিলতের গুরুত্ব বুঝাবার জন্যই প্রথমে এমন সতর্ক ও সাবধান বানী, যেন মানুষ জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির ভয়ে যাবতীয় পাপ কাজ থেকে বিরত থেকে জান্নাতের নেয়ামত ও ফজিলত লাভের চেষ্টা করতে থাকে। যেমন কুরআন শরীফে একটি আয়াতঃ “নিজের নিকটতম আত্নীয়-পরিজনদের ভয় দেখাও” (সূরা আল শুয়ারাঃ ২১৪)।

নির্ভরযোগ্য সিরাত ও হাদীসে উল্লেখ আছে, এ আয়াত নাযিল হবার পরই রাসুলুল্লাহ (স) অতি ভোরে সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কুরাইশ বংশের সবাইকে ডাক দিলেন। এ ঘটনা অনেক দীর্ঘ, তাই বেশ কিছু অংশ বাদ দিয়ে সংক্ষেপে উল্লেখ করলাম। “হে আমার অমুক, হে অমুক বংশের লোকেরা” এভাবে আলাদা আলাদা করে তিনি নাম ধরে সম্বোধন করে সবাইকে ডাকলেন এবং বললেনঃ "হে লোকেরা! যদি আমি বলি, এ পাহাড়ের পেছনে একটি বিশাল সেনাবাহিনী তোমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য ওৎ পেতে আছে৷ তাহলে কি তোমরা আমার কথা সত্য বলে মেনে নেবে?" সবাই বললো , হ্যাঁ আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তুমি কখনো মিথ্যা বলনি। তিনি বললেন, "বেশ , তাহলে আমি আল্লাহর কঠিন আযাব আসার আগে তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি ৷ তাঁর পাকড়াও থেকে নিজেদের বাঁচাবার চিন্তা করো”।

কত সুন্দর উদাহরণ সহ প্রথমেই তিনি নেতিবাচক (Negative) দিকটা তুলে ধরেছেন গুরুত্ব উপলব্দি করার জন্য।

রোযা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত “হে ঈমানদাগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী (নবীদের অনুসারীদের) ওপর ফরয করা হয়েছিল ৷ এ উদ্দেশ্যে যে, আশা করা যায় তোমাদের মধ্যে তাকওয়া (অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে পাপ কাজ থেকে বেচেঁ থাকার গুণাবলী) সৃষ্টি হবে” (সূরা বাক্বারাঃ ১৮৩)

একটি হাদীসে কা’আব ইবনে উজরা (রা) থেকে বর্ণীত, রাসুলুল্লাহ (স) সাহাবায়ে কেরামদেরকে (রাঃ) বললেনঃ মিম্বর নিয়ে আস, আমরা মিম্বর নিয়ে আসলাম। তিনি প্রথম সিড়িতে চড়ে বললেন ‘আমীন’। দ্বিতীয় সিড়িতে চড়েও বললেন ‘আমীন’। তারপর তৃতীয় সিড়িতে চড়েও বললেন ‘আমীন’। যখন মিম্বর থেকে নিচে অবতরণ করলেন, তখন আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আজ আমরা আপনাকে এমন কথা বলতে শুনলাম যা পূর্বে কখনো শুনিনি। তিনি বললেনঃ জিবরীল (আঃ) আমার কাছে এসে বললেনঃ ঐ ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে রমাদান মাস পেয়েও ক্ষমা লাভ করে পাপ মুক্ত হতে পারেনি। আমি বললাম আমীন (অর্থাৎ তাই হোক)”। আমি বললাম ‘আমীন’। দ্বিতীয় সিড়িতে চড়ার পর জিবরীল (আঃ) বললেনঃ ঐ ব্যক্তি ধ্বংস হোক যার সামনে আপনার নাম উল্লেখ করা হল, কিন্তু সে দরূদ পাঠ করল না। আমি বললাম ‘আমীন’। তারপর তৃতীয় সিড়িতে চড়ার পর জিবরীল (আঃ) বললেনঃ ঐ ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে তার মাতা-পিতাকে বা তাদের কোন একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েও তাদের খেদমত করে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে নাই। আমি বললাম ‘আমীন’। (মুস্তাদরাক হাকেমঃ ৮/১৫৩, সহীহুত তারগীবঃ ৯৮৫)

ভাল করে লক্ষ্য করুন, উপরের ঐ হাদীসটিতে যে ব্যক্তির ব্যাপারে জিবরীল (আঃ) বললেনঃ ঐ ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে রমাদান মাস পেয়েও ক্ষমা লাভ করে পাপ মুক্ত হতে পারেনি, আর রাসুলুল্লাহ (স) পূর্ণ সমর্থন দিয়ে বললেন আমীন অর্থাৎ তাই হোক, এমন লোকটি কত বড় দুর্ভাগ্যবান তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? যখন কোন ব্যক্তির উপর আল্লাহর লানত (অভিশাপ) সাব্যস্ত হয় তখন তার ব্যাপারে এভাবে “ধ্বংস হোক” কথাটি ব্যবহার করা হয়। যেমন- ইবলিশ শয়তানের ব্যাপারে, সুরা লাহাবে আবু লাহাবের ব্যপারে এবং কুরআন শরীফের আরও অনেক আয়াতে। কুরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াতে “ধ্বংস হোক” কথাটা কাফির মুশরিকদের জন্য বলা হলেও এ হাদীসটিতে “ধ্বংস হোক” কথাটা কাফির মুশরিকদের ব্যাপারে বলা হয় নাই। কারণ কাফির মুশরিকদের জন্য তো রমাদান মাসের রোজা ফরজ করা হয় নাই, রোজা ফরজ করা হয়েছে মুসলমানদের জন্য। যে আয়াতটি নাযিল করে রোজা ফরজ করা হল সে আয়াতটি শুরু করা হয় “হে ঈমানদাগণ!” এভাবে মুসলমানদেরকে সম্মোধন করে।

অন্য একটি হাদীসে রাসুলুল্লাহ (স) একইভাবে বলেছেন, “ঐ ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক যার কাছে রমজান মাস এসে চলে গেল অথচ তার পাপগুলো ক্ষমা করা হয়নি। (তিরমিজি)”

আর একটি হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্নীত, রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও খারাপ কাজ করা ত্যাগ করতে পারল না সে আহার ও পান করা ত্যাগ করলো কিনা (অর্থাৎ রোযা রাখলো কিনা) আল্লাহর তার কোন প্রয়োজন নাই।” (বুখারী)

কুরআনের উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস পর্যালোচনা করলেই বুঝা যাবে, রমাদান মাস কার জন্য কিভাবে মহাদুর্ভাগ্য বয়ে আনতে পারে।

যে ৩ টি হাদীস উল্লেখ করলাম তা যদি ভাল করে বুঝার চেষ্টা করি, তা হলে কি দাড়ায়? সবচেয়ে বরকতময়, সৌভাগ্যময় ও বিশেষ রহমতের এ মাসে আল্লাহ ঈমানদার মুসলমানকে অফূরান্ত বরকত ও রহমত বিলাতে চান, মাগফেরাত অর্থাৎ বিশেষ ক্ষমা বর্ষন করে সমস্ত পাপ মুক্ত করতে চান, মহা কষ্ট ও কঠিন শাস্তির জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে মহা সুখের ও চিরকাল আরামের জান্নাতে প্রবেশ করাতে চান। আল্লাহ তো সব দিতে চান, কিন্তু কেহ যদি নিতে না চায় তাহলে তা কি তার দুর্ভাগ্য নয়? নিজের কর্মদোষে এমন সৌভাগ্যময় রমাদান মাসে কেহ যদি মহা দুর্ভাগ্যবান হয়, তবে সে দোষ কার?

মুসলমান হওয়া সত্তেও এমন কোন্ ইসলাম বিরোধী পাপের কাজ আমরা করে চলছি যা রমাদান মাসেও আমরা সংশোধন করার চেষ্টা করছি না, যে কারনে আল্লাহর রহমত, বরকত ও সৌভাগ্য লাভের পরিবর্তে “সে ধ্বংস হোক” এমন লানতে (অভিশাপে) মহা দুর্ভাগ্যবান হতে হচ্ছে? এই কারনগুলি অবশ্যই আমাদের জানা প্রয়োজন।

সুতরাং কি কি কারনে সবচেয়ে বরকতময়, সৌভাগ্যময় ও বিশেষ রহমতের রমাদান মাসে সৌভাগ্য লাভের পরিবর্তে “সে ধ্বংস হোক” এমন লানতে (অভিশাপে) মহা দুর্ভাগ্যবান হতে হয় তা আমাদের আগে জানা দরকার। এ নেতিবাচক (Negative) কারন গুলি প্রথমে জেনে নিলে আমরা সাবধান ও সতর্ক হয়ে নিজেদেরকে সংশোধন করে নিতে পারবো এবং তার পর যে কাজ গুলি করলে আল্লাহ সন্তুষ্টু হবেন সে কাজ গুলি করলে ইনশাআল্লাহ রহমত, বরকত ও সৌভাগ্য লাভের আশা করতে পারি। এ কাজগুলি করতে গেলে প্রথমেই জানা দরকার কি উদ্দেশ্যে রমাদান মাসে রোযা ফরজ হল।

চলবে ইনশাআল্লাহ >>>>> [পরবর্তি পর্ব-২]

বিষয়: বিবিধ

১৯০৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File