মহানবীর (স) মিরাজঃ মানবজাতির জন্য ১৪ দফা নির্দেশ এবং নামায কায়েমের বিধান [পর্ব-২]
লিখেছেন লিখেছেন ইঞ্জিঃ আবুল হোসেন রহমতুল্লাহ ২১ জুন, ২০১৩, ০৯:৫৩:২২ রাত
[ধারাবাহিকতার জন্য পূর্বের পর্ব পড়ুন।]
পর্ব-১ Link: http://www.bdtomorrow.net/blog/blogpost/newpostdraft/2973/rahmatullah/19777
সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনেতা মহানবী (স) নবুয়ত লাভের পর মূর্তি, দেব দেবী, সমাজের ক্ষমতাবান নেতা, আল্লাহ বিদ্রোহী অত্যাচারী শাসক, স্বৈরচারী রাজা বাদশাহ ইত্যাদি সকল প্রকার ইলাহ ত্যাগ করে এবং সবার দাসত্ব অস্বীকার করে নিজের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত (দাসত্ব) করার মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি কায়েমের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করে যাচ্ছিলেন। (ইবাদত-এর বাংলা অর্থ দাসত্ব, দাওয়াত অর্থ লোকদেরকে ডাকা বা আহ্বান করা এবং তাবলীগ অর্থ প্রচার করা)। মহানবীর (স) এ দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষমতাধর নেতা ও শাসক শ্রেণী, স্বার্থপর অসৎ ধনী এবং লোভী কপট ধর্মীয় নেতারা একজোট হয়ে রাসুলুল্লাহ (স) এবং ইসলামের অনুসারীদের প্রতি মিথ্যা দুর্নাম ও অপবাদ, উপহাস ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ, গালাগালি তিরস্কার. হুমকি ধমকি, হামলা মামলা, বর্বর অত্যাচার নির্যাতন, চরম যুলুম ও অমানুষিক শারিরীক নির্যাতন, অন্যায়ভাবে হত্যা, শিহাবে আবু তালেব নামক জেলখানায় অবরোধ ও বন্ধী, নাগরিকত্ব হরন ইত্যাদী সর্বপ্রকার অপকৌশল ও সব ধরনের বিরোধিতার অস্ত্র প্রয়োগ করে চিরতরে ইসলাম নির্মূলের চেষ্টা করতে থাকে। এত সব অভিযান চালানোর পরও রাসুলুল্লাহর (স) দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ বন্ধ করা যায় নাই, বরং ইসলাম বিরোধীদের সর্বপ্রকার বিরোধিতা ও অপকৌশল মোকাবেলা করে বিশ্বনেতা মহানবী (স) তাঁর সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন এবং ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে লাগলো।
এমনি ভাবে নবুয়তের দশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর ঈমানের বলে বলিয়ান এই সব সাহসী, ধৈর্য্যশীল, আত্মত্যাগী ও সৎ লোকদের একটি দল নিয়ে মদীনায় হিজরত করে একটি আদর্শ রাষ্ট্র কায়েম করা অপরিহার্য্য হয়ে উঠে। এ রাষ্ট্র তো প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার মত কেবল মাত্র নিজের বা কোন পরিবারের কিংবা কোন দলের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা ভোগের উদ্দেশ্যে নয় এবং প্রজা শোষন কিংবা বিরোধী গোষ্ঠী ও ভিন জাতীকে শোষন করার জন্য নয়। আবার এমনও নয় যে এ রাষ্ট্র হবে শুধুমাত্র মুসলমানের স্বার্থ ও কল্যাণের জন্য; এ রাষ্ট্র হবে সমস্ত দল, সম্প্রদায়, ধর্ম ও জাতির সমন্বয়ে পৃথিবীর সব শ্রেণী ও সাদা কালো সব বর্ণের মানুষের স্বার্থ রক্ষা এবং সারা পৃথিবীর মানব কল্যাণের জন্য। এমন একটি আদর্শ মানব কল্যাণ রাষ্ট্রের ৪ দফা মূল নীতি আল্লাহ কুরআন শরীফে সূরা হজ্জের ৪১ আয়াতে উল্লেখ করেছেনঃ
(১) নামায কায়েম করা। অর্থাৎ নামাযের ওয়াক্তে দোকান ও ব্যবসা প্রততিষ্ঠান সব কিছু বন্ধ রাখা এবং নামাযের নিয়মে সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আরবী ‘জামাত’ শব্দের অর্থ ঐক্যবদ্ধ দল এবং ‘ইমাম’ শব্দের অর্থ যিনি অগ্রগামী অর্থাৎ নেতা। তাই নামাযের জামাতে যিনি ইমাম তার নেতৃত্বে নামায শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে নামাযে পঠিত কুরআনের আয়াতগুলি বাস্তবে পালন করা এবং কুরআন ও রাসুলুল্লাহর সুন্নত অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঐ ইমামের নেতৃত্বে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
(২) সুদ মুক্ত যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি।
(৩) সৎ কাজের আদেশ দেওয়া। অর্থাৎ কুরআনে বর্ণীত আল্লাহর আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা। [ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী রাষ্ট্র চালানোর কথা বললেই মুসলমান নামধারী অনেকেরই গা জ্বালা করে, অথচ আরবী “শরীয়ত” শব্দের বাংলা অর্থ “আইন” এবং আরব দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আইন অনুষদ (Law Faculty) কে শরীয়া ফ্যাকালটি বলা হয় এবং সেখানে পাঠ্য তালিকায় (syllebus) কুরআনের আইনগুলি পড়া বাধ্যতামূলক, ফলে যারা ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে আইন বিষয়ে পাশ করে বের হয় তারা প্রত্যেকেই এক একজন মুফতি ও কুরআন হাদীসের বড় আলেম এবং তারাই আদালতে বিচারক হন। তাদের সাথে তুলনা করলে আমাদের দেশে ধর্মহীন ত্রুটিযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার কারণেই আমরা ঈমানদার, আল্লাহ ভীরু সৎ চরিত্রবান ও যোগ্য প্রশাসক, বিচারক ও পুলিশ কর্মকর্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।]
(৪) অসৎ কাজ নিষেধ করা। অর্থাৎ মদ জুয়া, ঘুষ দুর্নীতি, বিবাহ ছাড়া নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নারীদের বেপর্দা ও অশালীন পোষাকে চলাফেরা, অশ্লীল নাচ গান, পর্ণ পত্রিকা ও সিনেমা ইত্যাদি যত প্রকার শরীয়ত বিরোধী কাজ আছে সব আইন করে বন্ধ করা এবং আইন অমান্যকারীকে কুরআনের আইন অনুযায়ী বিচার ও শাস্তির বিধান চালু করা।
যেহেতু আল্লাহ কুরআনে শরীফে আয়াত নাযিল করে উপরোক্ত ৪ টি মূল নীতির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়েছেন, তাই রাষ্ট্রের সংবিধানে উপরোক্ত ৪ টি মূল নীতি সংযোজন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা ফরজ। যারা রাজনৈতিক বক্তৃতায় মদীনা সনদের কথা বলে কুরআনের আইন মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশ এড়িয়ে যান কিংবা বিরোধিতা করেন তাদের কাছে প্রশ্ন-মদীনা সনদ যদি ধর্ম নিরপেক্ষ হয়ে থাকে তাহলে মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঐ আয়াতটি আল্লাহ কেন এবং কি উদ্দেশ্যে নাযিল করলেন? আর আমাদের মহানবী (স) আল্লাহর নির্দেশে ঐ ৪ দফা মূল নীতির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র চালালেনই বা কেন? ধর্ম নিরপেক্ষ আইনে তিনি বিচার ও শাস্তির বিধান না করে কুরআনে বর্নীত শরীয়া অর্থাৎ আল্লাহর তৈরী আইনে বিচার ও শাস্তির বিধান চালু করলেন কেন?
সমস্ত দল, সম্প্রদায়, ধর্ম ও জাতির সমন্বয়ে পৃথিবীর সব শ্রেণী ও সাদা কালো সব বর্ণের মানুষের স্বার্থ রক্ষা এবং সারা পৃথিবীর মানব কল্যাণের জন্য বিশ্বনেতা রাসুলুল্লাহর (স) নেতৃত্বে যে রাষ্ট্রটি হবে তা হতে হবে সারা দুনিয়ায় মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সব যুগের ও সর্ব কালের জন্য উদাহরন সৃষ্টিকারী একটি আদর্শ রাষ্ট্র। এমন একটি উদাহরন সৃষ্টিকারী আদর্শ রাষ্ট্র তো আর হুট করে করা সম্ভব না এবং এটা এত সহজ ব্যাপার নয়। এজন্য দরকার পূর্ব প্রস্তুতি ও সঠিক প্রশিক্ষন। যাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি এ রাষ্ট্রটি পরিচালনা করবেন এবং যাদেরকে এ রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেবেন তাঁদেরকে তো সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে এবং সমস্ত প্রকার লোভ লালসা থেকে মুক্ত হয়ে মহা আত্মত্যাগী হতে হবে। অমুক চেতনা এবং তমুকের আদর্শ ঘন ঘন মুখে আউড়িয়ে আর মুষ্ঠিবদ্ধ হাত সামনে বিস্তার করে শপথ বাক্য পাঠ করলেই তো আর এ ধরণের উত্তম সৎ চরিত্র বৈশিষ্টের অধিকারী হওয়া যায় না, আমরা বাস্তবেই তা দেখতে পাচ্ছি। আল্লাহ ইচ্ছা করলে রাসুলুল্লাহর (স) নিজ স্বদেশভূমি মক্কা শরীফেই এ আদর্শ রাষ্ট্র কায়েম করার ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন, কিন্তু তা না করে ভিটা বাড়ী, সহায় সম্পদ, আত্মীয় স্বজনদের মায়া সব কিছু ত্যাগ করে তীব্র গরমে পাহাড় মরুভূমি পাড়ি দিয়ে এত কষ্ট করে মক্কা থেকে কয়েক শত মাইল দূরে ভিন দেশে গিয়ে রাষ্ট্র কায়েম করার নির্দেশ দিলেন কেন? আমরা কি তা ভেবে দেখেছি? না কি তা কখনো জানার চেষ্টা করেছি? অনেকগুলো কারনের মধ্যে প্রধান ২ টি কারণ হলঃ
(১) ইসলামে জাতীয়তা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ড কিংবা নির্দিষ্ট কোন ভাষাভিত্তিক নয়, কোন ভূখণ্ডের শাসক কিংবা জনগন ঐ ভুখণ্ডের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক নয়, সারা বিশ্বের ও সমস্ত ভুখণ্ডের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং জনগন আল্লাহর খলিফা (বাংলা অর্থ প্রতিনিধি) যারা তাদের পছন্দমত আল্লাহ ভীরু যোগ্য যে কোন ভাষার ও যে কোন ভূখণ্ডের লোককে নির্বাচিত করে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। নিজের জন্ম ভূমি ছাড়া অন্য কোন ভুখণ্ডে কেহ রাষ্ট্র শাসন পরিচালনা করতে পারবে না এমন সঙ্কীর্ন নিয়ম নীতি আল্লাহর বিধানে নাই, আবার এক ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠি অন্য ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠির উপর কর্তৃত্ব করবে অথবা তাদের মাঝে দন্ধ কলহের কারণে পৃথক হয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করবে এমন নীতিও নাই আল্লাহর বিধানে। আর তাই মানব সৃষ্ট খণ্ড খণ্ড জাতীয়তাবাদ বর্জন করে বিশ্বজনীন জাতীয়তাবাদের এ নীতিকে বাস্তবে রূপ দিয়ে সর্বকালের জন্য একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরী করার জন্য নিজ স্বদেশভূমি মক্কা শরীফ ত্যাগ করে দূর দেশে অন্য ভূখণ্ড মদীনা শরীফে গিয়ে রাষ্ট্র কায়েমের প্রয়োজন দেখা দেয়। [জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অন্য একটি লেখায় বিস্তারিত উল্লেখ করেছি]
(২) যারা মক্কার ইসলাম বিরোধী শাসক ও সমাজ পতিদের ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ ও উপহাস উপেক্ষা করে এবং বর্বরতম যুলুম নির্যাতন সহ্য করে ইসলাম কায়েমের পথে অবিচল থেকেছেন; যারা ইসলাম বিরোধীদের নানারকম প্রলোভন ও সুযোগ সুবিধার লোভ অগ্রাহ্য করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই বেঁছে নিয়েছেন; যারা আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়ে নিজ ভিটা বাড়ী, ধন সম্পদ, আত্মীয় স্বজনদের মায়া সব কিছু ত্যাগ করে শূন্য হাতে কয়েক শত মাইল দূরে অজানা একটি ভিনদেশ মদীনায় যেতে পারে যেখান থেকে নিজ স্বদেশ ভূমি মক্কায় ফিরে আর কোন সম্ভাবনা নেই এমন কঠিন পরীক্ষা যারা দিতে পারে তারাই তো সত্যিকারের সৎ ও মহা আত্মত্যাগী। তাদের দ্বারা কখনো দূর্নীতি করা সম্ভব নয় এবং ক্ষমতাকে চিরস্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করার জন্য অবৈধ পদ্বতি ও পন্থা তালাশ করাও সম্ভব নয়। এ ধরনের সত্যিকারের সৎ ও মহা আত্মত্যাগী লোক তৈরী করার পর ভবিষ্যৎ আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র পরিচালনা করতে যেসব নীতিমালা দরকার তা পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে আগে থেকে বাস্তবে পালন করার অভ্যাস ও যোগ্যতাও গড়ে তোলার প্রয়োজনও দেখা দিয়েছে মদীনায় হিজরতের পূর্বে।
এমনি এক প্রেক্ষাপটে মদীনায় হিজরতের তিন বছর পূর্বে নবুয়তের দশম বর্ষে মহানবীর (স) মিরাজের অলৌকিক ঘটনা ঘটলো এবং মহান আল্লাহ মিরাজের মাধ্যমে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েমের বিধান এবং মানবজাতির জন্য ১৪ টি মূলনীতি প্রকাশ করে পালনীয় নির্দেশ দেন যেগুলোর ভিত্তিতে রাসূল (সা.) যেন একটি আদর্শ সুখী সম্মৃদ্ধীশালী শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্ব প্রস্তুতি হিসবে একটি সার্থক সমাজ বিপ্লবের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। মিরাজের রাতে বিশ্বনেতা মহানবীকে (স) বিশেষ ব্যবস্থায় আল্লাহ তাঁর কাছে নিয়ে যান এবং পৃথিবী থেকে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত ভ্রমন, আল্লাহর পরম সান্নিধ্য অর্জন করে তাঁর সাথে কথা বলা, জান্নাত ও জাহান্নাম সহ বিভিন্ন নিদর্শন দর্শন ইত্যাদিকে ইসলামের পরিভাষায় মিরাজ বলা হয়। মহানবী (স) ‘বোরাক’ নামক যানবাহনে মক্কার মসজিদুল হারাম বাইতুল্লাহ (কাবা শরীফ) থেকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা ভ্রমণ এবং সেখান থেকে ‘রফরফ’ নামক যানবাহনে উর্ধ্বলোকে মহাশূন্য ভ্রমন করেছন।
চলবে ইনশাআল্লাহ >>>>> পর্ব-৩
[পরবর্তি পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন][ধারাবাহিকতার জন্য পূর্বের পর্ব পড়ুন।]
পর্ব-১ Link: http://www.bdtomorrow.net/blog/blogpost/newpostdraft/2973/rahmatullah/19777
সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনেতা মহানবী (স) নবুয়ত লাভের পর মূর্তি, দেব দেবী, সমাজের ক্ষমতাবান নেতা, আল্লাহ বিদ্রোহী অত্যাচারী শাসক, স্বৈরচারী রাজা বাদশাহ ইত্যাদি সকল প্রকার ইলাহ ত্যাগ করে এবং সবার দাসত্ব অস্বীকার করে নিজের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত (দাসত্ব) করার মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি কায়েমের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করে যাচ্ছিলেন। (ইবাদত-এর বাংলা অর্থ দাসত্ব, দাওয়াত অর্থ লোকদেরকে ডাকা বা আহ্বান করা এবং তাবলীগ অর্থ প্রচার করা)। মহানবীর (স) এ দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষমতাধর নেতা ও শাসক শ্রেণী, স্বার্থপর অসৎ ধনী এবং লোভী কপট ধর্মীয় নেতারা একজোট হয়ে রাসুলুল্লাহ (স) এবং ইসলামের অনুসারীদের প্রতি মিথ্যা দুর্নাম ও অপবাদ, উপহাস ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ, গালাগালি তিরস্কার. হুমকি ধমকি, হামলা মামলা, বর্বর অত্যাচার নির্যাতন, চরম যুলুম ও অমানুষিক শারিরীক নির্যাতন, অন্যায়ভাবে হত্যা, শিহাবে আবু তালেব নামক জেলখানায় অবরোধ ও বন্ধী, নাগরিকত্ব হরন ইত্যাদী সর্বপ্রকার অপকৌশল ও সব ধরনের বিরোধিতার অস্ত্র প্রয়োগ করে চিরতরে ইসলাম নির্মূলের চেষ্টা করতে থাকে। এত সব অভিযান চালানোর পরও রাসুলুল্লাহর (স) দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ বন্ধ করা যায় নাই, বরং ইসলাম বিরোধীদের সর্বপ্রকার বিরোধিতা ও অপকৌশল মোকাবেলা করে বিশ্বনেতা মহানবী (স) তাঁর সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন এবং ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে লাগলো।
এমনি ভাবে নবুয়তের দশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর ঈমানের বলে বলিয়ান এই সব সাহসী, ধৈর্য্যশীল, আত্মত্যাগী ও সৎ লোকদের একটি দল নিয়ে মদীনায় হিজরত করে একটি আদর্শ রাষ্ট্র কায়েম করা অপরিহার্য্য হয়ে উঠে। এ রাষ্ট্র তো প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার মত কেবল মাত্র নিজের বা কোন পরিবারের কিংবা কোন দলের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা ভোগের উদ্দেশ্যে নয় এবং প্রজা শোষন কিংবা বিরোধী গোষ্ঠী ও ভিন জাতীকে শোষন করার জন্য নয়। আবার এমনও নয় যে এ রাষ্ট্র হবে শুধুমাত্র মুসলমানের স্বার্থ ও কল্যাণের জন্য; এ রাষ্ট্র হবে সমস্ত দল, সম্প্রদায়, ধর্ম ও জাতির সমন্বয়ে পৃথিবীর সব শ্রেণী ও সাদা কালো সব বর্ণের মানুষের স্বার্থ রক্ষা এবং সারা পৃথিবীর মানব কল্যাণের জন্য। এমন একটি আদর্শ মানব কল্যাণ রাষ্ট্রের ৪ দফা মূল নীতি আল্লাহ কুরআন শরীফে সূরা হজ্জের ৪১ আয়াতে উল্লেখ করেছেনঃ
(১) নামায কায়েম করা। অর্থাৎ নামাযের ওয়াক্তে দোকান ও ব্যবসা প্রততিষ্ঠান সব কিছু বন্ধ রাখা এবং নামাযের নিয়মে সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আরবী ‘জামাত’ শব্দের অর্থ ঐক্যবদ্ধ দল এবং ‘ইমাম’ শব্দের অর্থ যিনি অগ্রগামী অর্থাৎ নেতা। তাই নামাযের জামাতে যিনি ইমাম তার নেতৃত্বে নামায শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে নামাযে পঠিত কুরআনের আয়াতগুলি বাস্তবে পালন করা এবং কুরআন ও রাসুলুল্লাহর সুন্নত অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঐ ইমামের নেতৃত্বে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
(২) সুদ মুক্ত যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি।
(৩) সৎ কাজের আদেশ দেওয়া। অর্থাৎ কুরআনে বর্ণীত আল্লাহর আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা। [ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী রাষ্ট্র চালানোর কথা বললেই মুসলমান নামধারী অনেকেরই গা জ্বালা করে, অথচ আরবী “শরীয়ত” শব্দের বাংলা অর্থ “আইন” এবং আরব দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আইন অনুষদ (Law Faculty) কে শরীয়া ফ্যাকালটি বলা হয় এবং সেখানে পাঠ্য তালিকায় (syllebus) কুরআনের আইনগুলি পড়া বাধ্যতামূলক, ফলে যারা ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে আইন বিষয়ে পাশ করে বের হয় তারা প্রত্যেকেই এক একজন মুফতি ও কুরআন হাদীসের বড় আলেম এবং তারাই আদালতে বিচারক হন। তাদের সাথে তুলনা করলে আমাদের দেশে ধর্মহীন ত্রুটিযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার কারণেই আমরা ঈমানদার, আল্লাহ ভীরু সৎ চরিত্রবান ও যোগ্য প্রশাসক, বিচারক ও পুলিশ কর্মকর্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।]
(৪) অসৎ কাজ নিষেধ করা। অর্থাৎ মদ জুয়া, ঘুষ দুর্নীতি, বিবাহ ছাড়া নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নারীদের বেপর্দা ও অশালীন পোষাকে চলাফেরা, অশ্লীল নাচ গান, পর্ণ পত্রিকা ও সিনেমা ইত্যাদি যত প্রকার শরীয়ত বিরোধী কাজ আছে সব আইন করে বন্ধ করা এবং আইন অমান্যকারীকে কুরআনের আইন অনুযায়ী বিচার ও শাস্তির বিধান চালু করা।
যেহেতু আল্লাহ কুরআনে শরীফে আয়াত নাযিল করে উপরোক্ত ৪ টি মূল নীতির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়েছেন, তাই রাষ্ট্রের সংবিধানে উপরোক্ত ৪ টি মূল নীতি সংযোজন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা ফরজ। যারা রাজনৈতিক বক্তৃতায় মদীনা সনদের কথা বলে কুরআনের আইন মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশ এড়িয়ে যান কিংবা বিরোধিতা করেন তাদের কাছে প্রশ্ন-মদীনা সনদ যদি ধর্ম নিরপেক্ষ হয়ে থাকে তাহলে মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঐ আয়াতটি আল্লাহ কেন এবং কি উদ্দেশ্যে নাযিল করলেন? আর আমাদের মহানবী (স) আল্লাহর নির্দেশে ঐ ৪ দফা মূল নীতির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র চালালেনই বা কেন? ধর্ম নিরপেক্ষ আইনে তিনি বিচার ও শাস্তির বিধান না করে কুরআনে বর্নীত শরীয়া অর্থাৎ আল্লাহর তৈরী আইনে বিচার ও শাস্তির বিধান চালু করলেন কেন?
সমস্ত দল, সম্প্রদায়, ধর্ম ও জাতির সমন্বয়ে পৃথিবীর সব শ্রেণী ও সাদা কালো সব বর্ণের মানুষের স্বার্থ রক্ষা এবং সারা পৃথিবীর মানব কল্যাণের জন্য বিশ্বনেতা রাসুলুল্লাহর (স) নেতৃত্বে যে রাষ্ট্রটি হবে তা হতে হবে সারা দুনিয়ায় মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সব যুগের ও সর্ব কালের জন্য উদাহরন সৃষ্টিকারী একটি আদর্শ রাষ্ট্র। এমন একটি উদাহরন সৃষ্টিকারী আদর্শ রাষ্ট্র তো আর হুট করে করা সম্ভব না এবং এটা এত সহজ ব্যাপার নয়। এজন্য দরকার পূর্ব প্রস্তুতি ও সঠিক প্রশিক্ষন। যাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি এ রাষ্ট্রটি পরিচালনা করবেন এবং যাদেরকে এ রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেবেন তাঁদেরকে তো সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে এবং সমস্ত প্রকার লোভ লালসা থেকে মুক্ত হয়ে মহা আত্মত্যাগী হতে হবে। অমুক চেতনা এবং তমুকের আদর্শ ঘন ঘন মুখে আউড়িয়ে আর মুষ্ঠিবদ্ধ হাত সামনে বিস্তার করে শপথ বাক্য পাঠ করলেই তো আর এ ধরণের উত্তম সৎ চরিত্র বৈশিষ্টের অধিকারী হওয়া যায় না, আমরা বাস্তবেই তা দেখতে পাচ্ছি। আল্লাহ ইচ্ছা করলে রাসুলুল্লাহর (স) নিজ স্বদেশভূমি মক্কা শরীফেই এ আদর্শ রাষ্ট্র কায়েম করার ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন, কিন্তু তা না করে ভিটা বাড়ী, সহায় সম্পদ, আত্মীয় স্বজনদের মায়া সব কিছু ত্যাগ করে তীব্র গরমে পাহাড় মরুভূমি পাড়ি দিয়ে এত কষ্ট করে মক্কা থেকে কয়েক শত মাইল দূরে ভিন দেশে গিয়ে রাষ্ট্র কায়েম করার নির্দেশ দিলেন কেন? আমরা কি তা ভেবে দেখেছি? না কি তা কখনো জানার চেষ্টা করেছি? অনেকগুলো কারনের মধ্যে প্রধান ২ টি কারণ হলঃ
(১) ইসলামে জাতীয়তা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ড কিংবা নির্দিষ্ট কোন ভাষাভিত্তিক নয়, কোন ভূখণ্ডের শাসক কিংবা জনগন ঐ ভুখণ্ডের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক নয়, সারা বিশ্বের ও সমস্ত ভুখণ্ডের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং জনগন আল্লাহর খলিফা (বাংলা অর্থ প্রতিনিধি) যারা তাদের পছন্দমত আল্লাহ ভীরু যোগ্য যে কোন ভাষার ও যে কোন ভূখণ্ডের লোককে নির্বাচিত করে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। নিজের জন্ম ভূমি ছাড়া অন্য কোন ভুখণ্ডে কেহ রাষ্ট্র শাসন পরিচালনা করতে পারবে না এমন সঙ্কীর্ন নিয়ম নীতি আল্লাহর বিধানে নাই, আবার এক ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠি অন্য ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠির উপর কর্তৃত্ব করবে অথবা তাদের মাঝে দন্ধ কলহের কারণে পৃথক হয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করবে এমন নীতিও নাই আল্লাহর বিধানে। আর তাই মানব সৃষ্ট খণ্ড খণ্ড জাতীয়তাবাদ বর্জন করে বিশ্বজনীন জাতীয়তাবাদের এ নীতিকে বাস্তবে রূপ দিয়ে সর্বকালের জন্য একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরী করার জন্য নিজ স্বদেশভূমি মক্কা শরীফ ত্যাগ করে দূর দেশে অন্য ভূখণ্ড মদীনা শরীফে গিয়ে রাষ্ট্র কায়েমের প্রয়োজন দেখা দেয়। [জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অন্য একটি লেখায় বিস্তারিত উল্লেখ করেছি]
(২) যারা মক্কার ইসলাম বিরোধী শাসক ও সমাজ পতিদের ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ ও উপহাস উপেক্ষা করে এবং বর্বরতম যুলুম নির্যাতন সহ্য করে ইসলাম কায়েমের পথে অবিচল থেকেছেন; যারা ইসলাম বিরোধীদের নানারকম প্রলোভন ও সুযোগ সুবিধার লোভ অগ্রাহ্য করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই বেঁছে নিয়েছেন; যারা আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়ে নিজ ভিটা বাড়ী, ধন সম্পদ, আত্মীয় স্বজনদের মায়া সব কিছু ত্যাগ করে শূন্য হাতে কয়েক শত মাইল দূরে অজানা একটি ভিনদেশ মদীনায় যেতে পারে যেখান থেকে নিজ স্বদেশ ভূমি মক্কায় ফিরে আর কোন সম্ভাবনা নেই এমন কঠিন পরীক্ষা যারা দিতে পারে তারাই তো সত্যিকারের সৎ ও মহা আত্মত্যাগী। তাদের দ্বারা কখনো দূর্নীতি করা সম্ভব নয় এবং ক্ষমতাকে চিরস্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করার জন্য অবৈধ পদ্বতি ও পন্থা তালাশ করাও সম্ভব নয়। এ ধরনের সত্যিকারের সৎ ও মহা আত্মত্যাগী লোক তৈরী করার পর ভবিষ্যৎ আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র পরিচালনা করতে যেসব নীতিমালা দরকার তা পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে আগে থেকে বাস্তবে পালন করার অভ্যাস ও যোগ্যতাও গড়ে তোলার প্রয়োজনও দেখা দিয়েছে মদীনায় হিজরতের পূর্বে।
এমনি এক প্রেক্ষাপটে মদীনায় হিজরতের তিন বছর পূর্বে নবুয়তের দশম বর্ষে মহানবীর (স) মিরাজের অলৌকিক ঘটনা ঘটলো এবং মহান আল্লাহ মিরাজের মাধ্যমে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েমের বিধান এবং মানবজাতির জন্য ১৪ টি মূলনীতি প্রকাশ করে পালনীয় নির্দেশ দেন যেগুলোর ভিত্তিতে রাসূল (সা.) যেন একটি আদর্শ সুখী সম্মৃদ্ধীশালী শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্ব প্রস্তুতি হিসবে একটি সার্থক সমাজ বিপ্লবের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। মিরাজের রাতে বিশ্বনেতা মহানবীকে (স) বিশেষ ব্যবস্থায় আল্লাহ তাঁর কাছে নিয়ে যান এবং পৃথিবী থেকে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত ভ্রমন, আল্লাহর পরম সান্নিধ্য অর্জন করে তাঁর সাথে কথা বলা, জান্নাত ও জাহান্নাম সহ বিভিন্ন নিদর্শন দর্শন ইত্যাদিকে ইসলামের পরিভাষায় মিরাজ বলা হয়। মহানবী (স) ‘বোরাক’ নামক যানবাহনে মক্কার মসজিদুল হারাম বাইতুল্লাহ (কাবা শরীফ) থেকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা ভ্রমণ এবং সেখান থেকে ‘রফরফ’ নামক যানবাহনে উর্ধ্বলোকে মহাশূন্য ভ্রমন করেছন।
চলবে ইনশাআল্লাহ >>>>> পর্ব-৩
[পরবর্তি পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন]
বিষয়: বিবিধ
১৯৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন