আমরা কি আসলে মুসলমান? [ পর্ব-২]
লিখেছেন লিখেছেন ইঞ্জিঃ আবুল হোসেন রহমতুল্লাহ ১৫ জুন, ২০১৩, ০৯:২৩:৪৯ রাত
[ধারাবাহিকতার জন্য আগের পর্ব পড়ুন]
পর্ব-১ Link: http://www.bdtomorrow.net/blog/blogdetail/detail/2973/rahmatullah/19071#.UbueLucwdhg
সব অবস্থায় একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করা এবং তাগুতের বিরোধিতা করাঃ
যে কলেমা পড়ে আমরা মুসলমান হই সে কলেমা “লা-ইলাহা ইল্লা আল্লাহু” এ বাক্যের প্রথম অংশ “লা-ইলাহা” উচ্চারন করে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সকল প্রকার ইলাহকে আরবীতে ‘লা’ অর্থাৎ বাংলায় ‘না’ বলে ঘোষনা দিতে হবে যার সহজ অর্থ তাদেরকে অস্বীকার, বর্জন ও তাদের বিরোধিতা করতে হবে। যেমন, আল্লাহ কুরআন শরীফে বলেন- “নুহকে আমি (আল্লাহ) তার জাতির কাছে পাঠাই। সে বলেঃ হে আমার জাতি! আল্লাহর ইবাদত (দাসত্ব) করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। আমি তোমাদের জন্য একটি ভয়াবহ দিনের আযাবের আশংকা করছি”। (সূরা আরাফঃ ৫৯)
“আমি (আল্লাহ) সকল জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি এ উদ্দেশ্য যে, আল্লাহর দাসত্ব করো এবং তাগূতকে বর্জন করো”। (সূরা নহলঃ ৩৬)
আরবী “তাগুত” শব্দের অর্থ হল ঐ শক্তি যারা নিজেরা আল্লাহর আইন মানে না এবং অন্যদেরকেও আল্লাহর আইন অমান্য করতে বাধ্য করে। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে বিশ্বাস করে, কিন্তু আল্লাহর কিছু আইন মানে এবং কিছু আইনের বিরোধিতা করে তারাও “তাগুত”। একারনেই আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সকল প্রকার ইলাহকে আরবীতে ‘লা’ অর্থাৎ বাংলায় ‘না’ বলে ঘোষনা দেওয়ার সাথে সাথে সমাজের নেতা, রাজনৈতিক দলের নেতা, রাস্ট্রের শাসক, রাজা বাদশাহ, বিচারক যারাই আল্লাহর আইন অমান্য করে ইসলাম বিরোধী আইনে সমাজ ও দেশ চালায়, যালিম শাসকের পক্ষে অন্যায়ভাবে বিচারের রায় দেয় এবং জনগনকে ইসলাম বিরোধী আইন মানতে বাধ্য করে সেই সব তাগুতী শক্তিকে বর্জন ও বিরোধিতা করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। যদি তা না করা হয় তাহলে আল্লাহর কলেমায় বিশ্বাস করা হল না, বরং আল্লাহর কলেমার বিরোধিতা এবং অস্বীকার করা হল। কারন আল্লাহর উপর ঈমান আনার প্রথম শর্তই হল আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সকল প্রকার ইলাহ এবং তাগুতকে অস্বীকার ও বিরোধিতা করা। কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেনঃ “যে তাগুতকে অস্বীকার ও বিরোধিতা করে এবং আল্লাহর উপর ঈমান (বিশ্বাস) রাখে, সে এমন একটি মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরেছে যা কখনো ছিন্ন হবার নয়”।(সূরা বাক্বারাঃ ২৫৬)
উপরের ঐ আয়াতে আল্লাহ প্রথমে তাগুতকে অস্বীকার ও তাগুতের বিরোধিতা করতে বলেছেন, তারপর আল্লাহর উপর ঈমান (বিশ্বাস) আনতে বললেন। আমরা যখন কলেমা “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” পড়ি তখন প্রথমে ‘লা-ইলাহা’ (কোন ইলাহ নাই) বলে অন্য সব ধরনের মাবুদ ও প্রভু অস্বীকার করে তারপর ‘ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া) এ কথা বলে আল্লাহর উপর ঈমান আনি। তাই তাগুতকে অস্বীকার ও তাগুতের বিরোধিতা করাও ঈমানের একটি শর্ত এবং তাগুতকে অস্বীকার ও বিরোধিতা করলেই আল্লাহ নিশ্চয়তা (guaranty) দিয়ে বলেছেন তার ঈমান এমনভাবে মজবুত হবে যেন সে একটি মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরেছে যা কখনো ছিন্ন হবার নয়। তাগুতকে অস্বীকার ও তাগুতের বিরোধিতা না করলে তার আর ঈমান থাকে না। কেননা আল্লাহ কুরআন শরীফে বলেনঃ “তুমি কি তাদেরকে দেখোনি, যাদেরকে কিতাবের জ্ঞান থেকে কিছু অংশ দেয়া হয়েছে এবং তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা জিব্ত এবং তাগুতকে মানে আর কাফেরদের সম্পর্কে বলে, ঈমানদারদের তুলনায় এরাই তো অধিকতর নির্ভুল পথে চলেছে? এই ধরনের লোকদের ওপর আল্লাহর লানত (অভিশাপ), আর যার উপর আল্লাহ লানত বর্ষণ করেন তোমরা তার কোন সাহায্যকারী পাবে না”। (সুরা নিসাঃ ৫১-৫২) (যাদু, তাবিজ, ভাগ্য গণনা, জ্যোতিষ, তন্ত্রমন্ত্র, মূর্তি পুজা ইত্যাদি কুসংসার ও যাবতীয় কাল্পনিক বানোয়াট ক্রিয়াকর্মকে আরবীতে “জিব্ত” বলা হয়)।
কুরআন শরীফে আল্লাহ আরো বলেনঃ “(হে নবী!) তুমি কি তাদেরকে দেখ নাই, যারা দাবী করে যে, তারা ঈমান এনেছে এই কিতাবের প্রতি যা তোমার ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং সেই সব কিতাবের প্রতি যেগুলো তোমরা পূর্বে নাযিল করা হয়েছিল? কিন্তু তারা নিজেদের বিষয়গুলি ফায়সালার জন্য তাগুতের দিকে ফিরতে চায়, অথচ তাদেরকে তাগুতকে অস্বীকার করার হুকুম দেয়া হয়েছে। শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে সরল সোজা পথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।” (সূরা নিসাঃ ৬০)
পাঠক! উপরে কুরআন শরীফের ঐ আয়াতেগুলি লক্ষ করুন। যারা যাদু, তাবিজ, ভাগ্য গণনা, জ্যোতিষ, তন্ত্রমন্ত্র, মূর্তি পুজা ইত্যাদি কুসংসার ও যাবতীয় কাল্পনিক বানোয়াট কাজে বিশ্বাস করে এবং যারা তাগুতী শক্তিকে মান্য করে চলে ও তাগুতের বিরোধিতা করে না তাদের উপর আল্লাহর লানত (অভিশাপ) বর্ষিত হয়। আরো লক্ষ করুন উপরের ঐ আয়াতে যারা তাগুতকে মান্য করে চলে তারা কাফেরদেরকে ঈমানদারদের তুলনায় উত্তম ও নির্ভুল মনে করে। বাস্তবেও আমরা তাই দেখি- যারা আল্লাহর ফরজ বিধান মেনে চলে, পর্দা পালন করে, কুরআনে আল্লাহর আইন দ্বারা সমাজ ও রাস্ট্র চালাতে চায় তাদেরকে বলে মৌলবাদী, স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধ অপরাধী এবং তারা ভুল পথে আছে এমন উক্তি করে তাদেরকে মিথ্যা মামলায় রিমাণ্ডে নিয়ে যুলুম নির্যাতন করা হচ্ছে, বেশ কয়েকটি স্কুল কলেজে ছাত্রীদেরকে পর্দা করে আসতে দেয়া হচ্ছে না, জোর করে পর্দানশীল মহিলাদের নিকাব ও বোরকা খুলে থানা হাজতে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে, এমন কি ওযু ও নামায পড়তে দেওয়া হয় নাই এবং জোর করে নিকাব ও বোরকা খুলে ফেলে তাদেরকে বেপর্দা অবস্থায় হাজার হাজার লোকের সামনে কোর্টে আনা হয়েছে। রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত এবং আল্লাহর জিকির ও তাহাজ্জুত নামায পড়া অবস্হায় হাজার আলেম ওলামা এবং কুরআনের হাফেজদেরকে নির্দয়ভাবে গনহত্যা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, আলেম ওলামারা হলেন নবীর ওয়ারিশ এবং নবীর অবর্তমানে তাঁরা নায়েবে নবী অর্থাৎ বাংলায় সহকারী নবী। তাদেরকে যারা অসম্মান, নির্যাতন ও হত্যা করে তারা কি করে মুসলমান হতে পারে? এদের কাছে ইসলামের শরীয়া আইন ও রাসুলুল্লাহর (স) আদর্শ ও সুন্নত ভাল লাগে না, কাফির মুশরিকদের আইন ও কাফির মুশরিকদের আদর্শ তাদের ভাল লাগে, সীমান্তে প্রতিদিন বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী মানুষ হত্যা ও উলঙ্গ করে নির্যাতন করলেও এবং ফারাক্কা বাধঁ দিয়ে পদ্মা নদী শুকিয়ে ফেললেও তাদের কাছে মূর্তি পুজারী মুশরিকরা মুমিনদের চেয়েও অতি প্রিয়।
ইবলিশ শয়তান ফেরেশতাদের চেয়েও অনেক বেশী আল্লাহর ইবাদত করে ফেরেশতাদের সর্দার হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর অভিশাপের কারনে তার ঐ সব ইবাদত ও আমল সব বরবাদ হয়ে এখন সে অভিশপ্ত শয়তান। এই যখন অবস্থা তখন আমরা নামায, রোজা, জিকির যা কিছু সামান্য ইবাদত করি সবই তো আল্লাহর অভিশাপের ফলে বরবাদ হয়ে যাবে; যদি আমরা রাজনৈতিক দলের নেতা, রাস্ট্রের শাসক, বিচারক যারা আল্লাহর আইন অমান্য করে ইসলাম বিরোধী আইনে সমাজ ও দেশ চালায়, যালিম শাসকের পক্ষে অন্যায়ভাবে বিচারের রায় দেয় এবং জনগনকে ইসলাম বিরোধী আইন মানতে বাধ্য করে সেই সব তাগুতী শক্তিকে বর্জন ও বিরোধিতা না করি। যার উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষন হয় তার তো আর ঈমান থাকে না, সব ইবাদত ও আমল বরবাদ হয়ে যায়। আর শয়তান তো এটাই চায় যাতে আমরা তাগুতী শক্তিকে বর্জন ও বিরোধিতা না করে পথভ্রষ্ট হয়ে ঈমানহারা হই, একথাও ঐ আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে স্মরন করিয়ে দিলেন। একবারও কি আমরা তা ভেবে দেখেছি? এরপরও কি আমাদের হুশ হবে না? আমাদের কি বোধোদয় হবে না?
এ কারনেই সাহাবা কেরামগন (রা) প্রথমে তাগুতকে অস্বীকার ও তাগুতের বিরোধিতা করে আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহর (স) উপর ঈমান (বিশ্বাস) এনে মুসলমান হয়েছেন বলেই তাঁদের উপর চরম নিষ্ঠুর ও বর্বরতম যুলুম নির্যাতন করা হয়েছে এবং তাঁরা তা সহ্য করেছেন।
সুতরাং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব অবস্থায় ও সব কাজে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করতে হবে এবং এবং আল্লাহর ভয়ে পাপ কাজ থেকে বেচেঁ থাকা ও সাবধান থাকার গুণাবলী অর্জন করে মুত্তাকি হতে হবে। সমাজের নেতা, রাজনৈতিক দলের নেতা, রাস্ট্রের শাসক, রাজা বাদশাহ, বিচারক যারাই আল্লাহর আইন অমান্য করে ইসলাম বিরোধী আইনে সমাজ ও দেশ চালায়, যালিম শাসকের পক্ষে অন্যায়ভাবে বিচারের রায় দেয় এবং জনগনকে ইসলাম বিরোধী আইন মানতে বাধ্য করে সেই সব তাগুতী শক্তিকে বর্জন ও বিরোধিতা করতে হবে। আর অন্যের কাছেও এই দাওয়াত ও তাবলীগ করতে হবে যা প্রত্যেক নবী রাসুলগন করেছেন।
এভাবে কুরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ নিজেই ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। যখন কেউ উচ্চারন করে কলেমা পড়ে “আশহাদু আন লা-ইলাহা ইল্লা আল্লাহু ওয়াদাহু লা-শরীকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ” তখন “আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহু” এ অংশটা পড়ার সময় সে মনে প্রানে বিশ্বাস করে ও শপথ করে বলে, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি (অর্থাৎ ঘোষনা করছি) যে, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে প্রভূ মানি না, আল্লাহ ছাড়া আর কারো আইন ও বিধান মানি না, আল্লাহ ছাড়া আর কারো শাসন কতৃত্ব মানি না, আল্লাহ ছাড়া আর কারো আনুগত্য মানি না, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে রিজিকদাতা মানি না, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভবিষ্যতের অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী মানি না, আল্লাহ ছাড়া আর কারো আদেশ নিষেধ মানি না, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানি না, ………” এইভাবে ‘ইলাহ’ শব্দের সবগুলি অর্থ বুঝার পর সে অনুযায়ী আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে ঈমান আনলে অর্থাৎ বিশ্বাস স্থাপন করলে তবেই আমাদের ঈমান সঠিক ও সুদৃঢ় হবে আশা করা যায়।
ইনশাআল্লাহ চলবে >>> [পরবর্তি পর্ব- ৩]
বিষয়: বিবিধ
১৮০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন