নীলিমা
লিখেছেন লিখেছেন আত্নসমর্পণ ০৯ মার্চ, ২০১৩, ০৮:০২:২০ সকাল
দু'বার রিং হলো।যখন তৃতীয় বারের মত ফোন বেজে উঠল,তখন:
-হ্যালো, বল
-কিরে হুজুর,সালাম কালাম কি ভুলে গেলি? নাকি নীলিমাকে সালাম দিতে নেই ?
-না, আসল....
-ঘৃণা হয় আমার সাথে কথা বলতে?
-হয়ই তো
- জানিস,খুব জানতে ইচ্ছে করে, তোরা আমাকে কেমন ঘৃণা করিস? শস্যহীন চৌচির প্রান্তর মেঘহীন আকাশকে যেমন ঘৃণা করে-তেমন কি? নাকি অসমাপ্ত জীবন আকস্মিক মৃত্যুকে,না আলো যেমন অন্ধকারকে?
- ....................(নীরবতা)
- তুইবা সবার মনের কথা জানবি কি করে।বাদ দে।কি করছিলি?
-পড়ছিলাম
-ও, তোদের তো এখন পরীক্ষা চলছে।কেমন হচ্ছে পরীক্ষা?
-ভালো
-রিতা, মালা , জয় ওরা সব কেমন দিচ্ছে?
-ওদেরও তো ফোন আছে
-তুই আমাকে ভাল না বাসলেও অন্তত ঘৃণা টুকন করিস-ওরা তাও করে না। ওরা আমার নাম্বার ব্লক করে রেখেছে।কারোর ফোনেই আমি আর ফোন দিতে পারি না।
-তাই নাকি!
-হ্যাঁ রে।আচ্ছা, অনিকের কোন খবর আছে তোর কাছে? কেমন আছে ও?
- হা,আছে।এখন চট্টগ্রামে থাকে।
-যোগাযোগ হয় নিয়মিত?
-যোগাযোগ হলে তো তোর প্রশ্নে আমি নীরব থাকতাম না।তবে, ও যেন কেমন হয়ে গেছে।ঐ ঘটনার পর সেই যে চলে গেল।প্রথম প্রথম কথা হত ফোনে।এখন আর তাও হয় না।ওর পুরানো নাম্বারটা বন্ধ।নতুন নাম্বার জানি না।তবে ইচ্ছে করলেই জোগাড় করা যাবে, লাগবে ওর নাম্বার?
- না থাক।পড় তবে এখন,কথা বলে পড়ার ক্ষতি করে লাভ নেই,আজ রাখি।
-আচ্ছা, আল্লাহ হাফিজ।
এই কথোপকথনের ১ বছর ১৩ দিন পর লিখা একটা চিঠি।
আসসালামু আলাইকুম।
অনিক,কেমন আছিস তুই? আমি ভাল আছি।
আজ বিকেলে বাড়িতে ঢুকতেই এ যেন এক গোপনসূত্রে সফিয়ার কাছে খবর পেলাম তোর ফোন এসেছিল।ফোন ধরেছিল সফিয়া।তুই সফিয়াকে ফোনটা মা'কে দিতে বলেছিলি।তারপর বেশ খানিকক্ষণ নাকি আম্মার সাথে তোর কথা হয়েছে।তোর সাথে কথা বলার পর থেকেই আম্মাকে নাকি বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। আম্মা সফিয়াকে কড়াভাবে আমাকে তোর ফোনের কথা জানাতে নিষেধ করেছেন।কিন্তু বোনেরা ওদের ভাইগুলোকে অসম্ভব ভালবাসে।এ পৃথিবীতে প্রথমে ভালবাসে মা, বাবা- এরপরই ভাইদেরকে সবথেকে বেশি ভালবাসে বোনেরা ।তার উপর জানিস তো ছোট মানুষদের কোন কিছু নিষেধ করলে ঐ কথা প্রচার পাবার সম্ভাবনা ৯৯%।
সফিয়া তো এখনো অনেক ছোট। আম্মাকে কিছু বলব না এই কথা দিয়েই আমার সফীর কাছ থেকে ওর গোপন কথাটা শুনতে হয়েছে;আর না শুনেও উপায় ছিল না।কেননা আমি জানি,আমাকে না বলতে পারলে ওর ঘুম হবে না।তাই আম্মাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি।আম্মাও এখনো আমাকে কিছু বলে নাই।তবে সফীর কথা ঠিক।আম্মা খুব চিন্তিত।
তোর উপর একটা নীরব অভিমান, অভিযোগ কিম্বা রাগ- যাই বল না কেন- ছিল।তাই কখনো আর তোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়নি।এখন অবশ্য আর কারো প্রতি কোন অভিযোগ হয় না,এখন আর কারো প্রতি তেমন রাগ হয় না।জীবনে বেশ খানিকটা পরিবর্তন এসেছে ।
তোকে একটা সংবাদ দেই আজ।এটাকে ঠিক সংবাদও বলা চলে না।এ দুঃসংবাদ।কিন্তু তোর কাছে যে এটা একটা নিছক সংবাদ ছাড়া আর কিছুই হবে না-আমি জানি।
অনিক, প্রস্টেটিউট নীলিমা মারা গেছে। সাত মাস আগে লাশকাটা ঘরে ওর অপবিত্র দেহটাকে কেটে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।অপবিত্র দেহের যথার্থ প্রাপ্তিই ঘটেছে,কি বলিস? কিন্তু কি জানিস,যখন ওর মৃত দেহটাকে চাটাইয়ের হিজাবে ঢেকে আমার সামনে নিয়ে আসা হল তখন আমার সমস্ত শক্তি কোথায় যে মিলিয়ে গেল-শরীরকে ধরে রাখতে পারলাম না।মাটিতে পড়ে গেলাম। অন্ধকার হয়ে এসেছিল চারপাশ।এরপর আর কিছু মনে নেই।যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি হাসপাতালে।মনে পড়ে গেল সব।হয়ত চিৎকার করে কাঁদা উচিত ছিল কিন্তু তেমন কোন কান্না এল না।নিজের ভিতর এক অদ্ভুত শান্ত ভাব অনুভব করলাম।রাতে প্রচণ্ড ঝড়ের শেষে ভোরের স্বচ্ছ প্রকৃতির মত শান্ত। শান্ত অথচ বিপর্যস্ত।ততক্ষণে নীলিমার মাটি হয়ে গিয়েছিল।শেষ বিদায় আর জানাতে পারিনি।
কেন যেন দিন যত যাচ্ছে কষ্ট ততই বাড়ছে।এ শোকের হয়ত এই নিয়ম যে দিন যত যায় কষ্টও তত বেশি হয়।মাঝে মাঝে মনে হয় শহরের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিংটাতে উঠে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদি।
এক কথায়,এখন দিন ভাল যাচ্ছে না।প্রায়ই অসুস্থ থাকি।আমার চোখের সামনে ওরা ওকে মেরে ফেলল।ওর আর ফেরা হলো না সুন্দর জীবনে।এ শোকে হয়ত বাঁচতাম না। কিন্তু একটা সান্ত্বনা কাজ করে যে বন্ধুদের ভেতর অনেক দেরিতে হলেও একমাত্র আমারই কিছুটা জ্ঞান ফিরেছিল।আমি ওকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারলাম না। আমি একা ছিলাম।ওরা সংখ্যায় অনেক।সংঘবদ্ধ।আমার সাধ্যই বা কতটুকো বল?
ময়নাতদন্ত রিপোর্টে এসেছে আত্মহত্যা। ময়নাপাখিকে যেমন কথা শিখানো যায়,বলানো যায় শেখানো কথা-তেমনি হারামিরবাচ্চা ঐ ডাক্তারগুলোকে দিয়েও বলানো যায় 'শেখানো কথা' - ক্ষমতার বলে।
এমনি কত নীলিমা প্রতিদিন মারা যায়,বলি হয় সমাজপতিদের ক্ষমতার;খবরে আসে না।আমি খুব জটিল কথা বুঝিনা অনিক।আচ্ছা , খুব সহজ করে বলতো, সমাজের এই নীলিমারা কি আমাদের কেউই না?কোন মানবীয় সম্পর্কই কি নেই ওদের সাথে আমাদের? ওরা কি আমাদের বোন নয়?যদি কেউ হয়,যদি বোন হয় তাহলে যে ভাইদের চোখের সামনে বোনেরা রূপজীবী হয় তারা পুরুষ হয় কি করে? কিন্তু , আবার খুব পুরুষ হয়েই বা তুই কি করতে পারবি বল? খুব দয়ার্দ্র হয়ে, নিজের প্রভাব খাটিয়ে হয়ত ১০ জন নীলিমাকে মুক্ত করতে পারিস-দিতে পারিস জীবনের সন্ধান।কিন্তু অনিক,তুই যে মুহূর্তে ১০ জন নীলিমাকে মুক্ত করবি ঠিক সেই জায়গায়, সেই মুহূর্তেই এ সমাজ ১০০ জন নীলিমা সৃষ্টি করবে নতুন করে।তাই পচে যাওয়া এ সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না করতে পারলে নীলিমাদের মুক্তি নেই,মুক্তি নেই মানুষের।
সমাজ পরিবর্তনের এ স্বপ্ন তো অনেকেই দেখে কিন্তু শুধু স্বপ্ন দেখাই কি যথেষ্ট? এ স্বপ্ন পূরণে প্রয়োজন প্রচেষ্টার-সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার-প্রয়োজন নির্ভুল দিকনির্দেশনার।তাই তো সংঘবদ্ধ এই কাফেলায় যোগ দিয়েছি।দিকনির্দেশনা নিয়ে চলেছি ঐশী বাণী থেকে। পচন ধরে যাওয়া এ অন্ধকারময় সমাজকে আমরা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তুলব এই আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।
অনিক, পেঁচা দেখেছিস তো-পেঁচা?পেঁচা অন্ধকারকে ভালবাসে।কেননা অন্ধকারে ওর শিকার ধরতে সুবিধা হয়।আমাদের সমাজপতিদের স্বভাবও এই পেঁচার মত।একটু ভাল করে দেখলে দেখবি যে সমাজের যত অন্ধকার তার পৃষ্ঠপোষকতা করে এই পেঁচা সমাজপতির দল।কেননা সমাজ অন্ধকারময় হলেই ওদের হীন স্বার্থগুলি চরিতার্থ করা সম্ভব হয়।সমাজের অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষগুলিকে শিকার বানাতে সুবিধা হয়।তাই যখন আমরা মানুষকে আলোর দিকে ডাকি তখন এই সমাজপতিরা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়,হয়ে যায় আমাদের ঘোর শত্রু।শুরু করে অপপ্রচার,জেল,জুলুম আরো কত কি। কিন্তু ক্ষিপ্ত হয়ে লাভ নেই।এসব করেও লাভ নেই।মানুষ আজ জাগতে শুরু করেছে।চেয়ে দেখ অনিক, আমাদের আলোর মিছিল আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে।সেদিন খুব নিকটে যেদিন জনতা এই আঁধার প্রেমী পেঁচাদেরকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে।পেঁচাদের লম্ফ-ঝম্ফ দেখে বিচলিত হবার কিছু নেই।আমি ভাল আছি।
অনিক,এখন আমি তোকে দোষ দেই না।কোন কিছুতেই না।নীলিমার মৃত্যুর জন্য নয়, নয় বাসায় ফোন দেওয়ার জন্য।আমি জানি, তুই খুবি নিরীহ প্রকৃতির ভাল এক ছেলে। নিরীহ দেখেই তো জীবন থেকে পালিয়েছিস, কিন্তু অনিক জীবন থেকে কি পালানো যায়? পলায়ন কি কোন জীবনের বৈশিষ্ট্য নাকি মৃত্যুর?? তুই ভাল ছেলে।আম্মা তোকে অনেক ভালবাসে।পাছে,আমার কোন অমঙ্গল হয় এই আশংকা থেকেই যে তুই ফোন করেছিস,এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।আর এই আসন্ন অমঙ্গলের অতি সম্ভাবনাময় বার্তা যে জয়,রিফাত,চৈতি-এরাই তোকে সরবারাহ করেছে,তাও আমি বুঝতে পারি।আমাকে আম্মা যেন আমার পথে চলতে বাধা দেন-আম্মার প্রতি,এটাই হয়ত ছিল তোর বিনীত অনুরোধ? তোর কি বিচার,আমি পেঁচাদের আশ্রয়ে শত বছর বেঁচে থাকি; নাকি আলোক পিয়াসী উজ্জ্বল কাফেলায় থেকে এখনি মরে যাই?কোনটা উত্তম? দ্বিতীয়টাই নয়কি? আম্মা সব জানে।হয়ত, তুই জানিস না।তাই আজ লিখতে বসলাম।অন্ধকার আর আলোর কখনো আপোষ হয় না অনিক।সত্য আর মিথ্যার সংঘর্ষ এক অনিবার্য সত্য।এটাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।তুই বরং ওদেরকে বলে দিস যে ওরা যদি পেঁচাদের পিছ না ছাড়তে পারে তাহলে ওরা যেন ভুলে যায় যে আমি কোনদিন ওদের কেউ ছিলাম।ওরা ওদের পথে চলুক,আর আমিও আমার পথে চলতে থাকি।আমাদের পথ এখন আলাদা।গন্তব্যও আলাদা।আমার মনে হয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখন তোর নীরব থাকাটাই ভাল।দুঃশ্চিন্তা করিস না। আমি ভাল আছি।
আর সম্ভব হলে নীলিমার কবরটা একবার যিয়ারত করে যাস।ওর অসহায় ছোট ভাই বোনদের একবার দেখে যাস।তোকে দেখলে ওরা অনেক খুশি হবে।সম্ভব হলে ওর জন্য একটু দোয়া করিস-মনে মনে দুয়া করতে তো আর বাধা নেই;হতভাগিনী তোকে সত্যই অনেক বেশি ভালবাসত।এত ভাল হয়ত কোন নারী তোকে আর বাসতে পারবে না।এই সমাজ ওকে রূপজীবী হতে বাধ্য করেছিল।মানুষ যা চায় জীবনে সব সময় তাই হয় না।অনিক,তুই ভাল থাকিস।
বিষয়: বিবিধ
১৬০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন