চোখের কোনে এক বিন্দু জল
লিখেছেন লিখেছেন আত্নসমর্পণ ০৪ মার্চ, ২০১৩, ০২:১৫:০৪ রাত
আসসালামু আলাইকুম।
আবির,হয়ত প্রথমেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল,তুই কেমন আছিস? আমাদের ছোট এই দেশ একটা গ্রামের মতন।তাই আমি কেমন আছি এর থেকেই অনেকটা বোঝা যায় তুই কেমন আছিস, তাই জিজ্ঞেস করলাম না 'আছিস কেমন'।আর তাছাড়া কুশল বিনিময়ের মত অতটা ভাল মনের অবস্থা আজ নেই।মনের ভিতর এক এলোমেলো ভাবনা খুব করে জেঁকে বসেছে।আমার সেই ভাবনাকে তোকে জানাবার জন্য লিখতে বসলাম।জেনে,তুই ই জানিয়ে দিস আমার এ ভাবনার শেষ কোথায়?
এখনো কোন কষ্টের উপন্যাস, নাটক,কবিতা, সাহিত্য পড়লে কিম্বা খুব কষ্টের কোন সিনেমা যেখানে মানুষের জীবনের করুণ পরিণতি ঘটে- দেখলে চোখে জল এসে যায়।অশ্রু ঝরে।চোখ হতে ঝরে পড়া আমার এ অশ্রু দেখে আমি ভাবতাম,আহা! মানুষের কষ্ট আমি সইতে পারিনা।বড় নরম দিল আমার। কিন্তু সত্যই কি তাই? যদি তাই হয় তবে পত্রিকায় তো কত খবরই পড়ছি -জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যায় শত শ্রমিক, ধর্ষিতা হয়ে আত্মহত্যা করছে কলেজ তরুণী, ফেলানীর লাশ ঝুলছে কাঁটাতারে,বুলেটের তপ্ত সীসায় চির বন্ধ হয়ে গেছে কিশোরের মুখের হাসি-ওরা আর হাসবে না কখনো-ছেলে হারা মায়ের কান্নার স্পষ্ট ছবি তো কতই দেখছি।কিন্তু আবির,এই ছবিগুলো দেখে, খবরের কাগজে এই সংবাদগুলো পড়ে চোখে জল আসে না;অথচ কষ্টের উপন্যাস পড়ে , দুঃখের সিনেমা দেখে চোখে জল এসে যায়।যে ফেলানীর খবর পড়ে আমার যে দুচোখে এক বিন্দু জলও এলো না-এই ফেলানীকে নিয়েই যদি কোন দক্ষ নির্মাতা কোন ফিল্ম বানায় কিম্বা কোন দক্ষ সাহিত্যিক লিখে ফেলেন কোন উপন্যাস 'কাঁটাতারে ফেলানী'-তাহলে দেখবি ঐ ফিল্ম দেখে কিম্বা 'কাঁটাতারে ফেলানী' শিরোনামের লিখনি পড়ে আমার সেই দুচোখেই ঝরঝর করে অশ্রু ঝরে পড়বে। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই কিন্তু সত্য-অন্তত আমার বেলায় ।
একসময় আমি ভাবতাম উপন্যাস পড়ে আমার যে অশ্রু ঝরে এ অশ্রুর উৎস মানুষের প্রতি আমার ভালবাসা।কিন্তু এখন ভাবি সত্যই কি এই অশ্রুর উৎস মানুষের প্রতি ভালবাসা?
আসলে সাহিত্য পাঠে, সিনেমায় চোখে যে জল আসে তা আসে সাহিত্যিকের আর সিনেমা নির্মাতাদের 'সৃষ্টি কৌশলে'র কারণে।সাহিত্যিকগণ ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে, শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে- সিনেমা নির্মাতারা ক্যামেরা, সাউন্ড, মিউজিক সব মিলিয়ে আমাদের ভিতর কৃত্রিম এক ভাবের সৃষ্টি করে যার ফলে আমাদের চোখে জল চলে আসে।উপন্যাসের যে চরিত্রটির ঘটে গেল কষ্টের পরিণতি,সিনেমার ঐ চরিত্রের জীবনের যে কষ্ট- সেই কষ্টের কারণে আমাদের চোখে জল আসে না বরং সাহিত্যিকের বা নির্মাতার ঐ চরিত্রের জীবনের কষ্টকে ফুটিয়ে তোলার যে দক্ষতা-সেই দক্ষতার কাছে নতি স্বীকার করে আমরা কাঁদি।হয়ত অনেকটা সম্মোহনের মত।
তুই তো বিজ্ঞানের ছাত্র।তাই লাফিং গ্যাসের কথা তো অবশ্যই জানিস।নাইট্রাস অক্সাইড (N2O)।এই গ্যাস মানুষের নিঃশ্বাসের ভিতর দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঢুকে পড়লে মানুষ হাসতে শুরু করে-হেসে ওঠে।মানুষের হাসির উদ্রেক করে তাই এই গ্যাস এর নাম রাখা হয়েছে লাফিং গ্যাস ( laughing gas)। এই যে লাফিং গ্যাস মানুষকে হাসায় এ হাসি কিন্তু কৃত্রিম।এ গ্যাস মানুষের ভিতর এক কৃত্রিম আবেশের সৃষ্টি করে ফলে মানুষ হেসে উঠে।অথচ হেসে উঠবার মত কোন বাস্তব ঘটনা কিন্তু ঘটেনি। কিম্বা দেখবি, বাঁশির করুন সুর শুনলে মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়-অথচ মন বিষণ্ণ হবার মত কোন ঘটনা তখন প্রকৃত জীবনে ঘটেনি।
আসলে এমনি হয়-দুঃখের উপন্যাস,কষ্টের চলচ্চিত্রে আমাদের অশ্রু বিসর্জন এমনি করে হয়।মানুষ মারা গেছে-মানুষষ-ভয়াবহ আগুনে পুড়ে! মালিক পক্ষের অবহেলায়।বুলেটের আঘাতে নিরীহ মানুষের লাশকে মৃত কুকুরের মত টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।এসব ছবি দেখছি,এসব খবর পড়ছি কিন্তু চোখ অশ্রুবিহীন কেননা এখানে সাংবাদিক সাহিত্যিক নয়।
হৃদয় আজ কঠিন হয়ে গেছে।পাথরের মত।হয়ত পাথরের চেয়েও কঠিন।মন মরে গেছে জীবনের ভুল পর্দার আড়ালে।আমি তোর কাছে দোয়া চাই রে।এখন দোয়ার খুব বেশি দরকার।আমি এ বলছি না যে, তুই দোয়া কর , যেন আমি অনেক বড় প্রকৌশলী হতে পারি একদিন; বিত্ত,বৈভব,পতিপত্তি পাই এ জীবনে।এমন দোয়ার আমার আজ দরকার নেই।
তুই শুধু দোয়া করিস, আমি যেন এমন এক মানুষ হতে পারি, যে মানুষটির মানুষের কষ্ট দেখলে,মানুষের নির্মম মৃত্যুর খবর শুনলে চোখের কোনে এক বিন্দু জল এসে জমা হয়। তুই শুধু আমার জন্য এই একবিন্দু জলের দোয়া করিস। ভাল থাকিস।
বিষয়: বিবিধ
৩৮৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন