বিকাল

লিখেছেন লিখেছেন আত্নসমর্পণ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৯:০৮:৩১ রাত



প্রায় বৎসর পার হয়ে গেছে জ্বর হয় না। এমনি নিত্য ছোট খাট সমস্যা যেমন মাথাধরা,গ্যাস্ট্রিক এগুলো যথারীতি ছিল। কিন্তু জ্বর হয়ে সারা দিন বিছানায় শুয়ে থাকা এমনটা হয়নি। কাল হঠাৎ করেই শরীরে জ্বর করে এলো। লম্বা ঘুম দিয়ে উঠে দেখি আসরের আযান হয়ে গেছে । বিকেল হয়েছে। আজ বিকেলে আমার করার কিছুই নেই-বিশ্রাম ছাড়া।জ্বর হলে এই এক সুবিধা যে কেউ কিছু করতে বলে না।নিজেরও কিছু করার ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে করলেও করার শক্তি শরীরে থাকে না। তাই এমন জ্বরের পরিণতি অখণ্ড বিশ্রাম।আজ বিকেল জুড়ে ভাবছিলাম আমার বিকেলগুলোর কথা।

বিকেল ছিল অন্য রকম আনন্দের।এই সময় ছিল না কোন শাসন।আসরের আযান হলেই খেলতে বের হতাম। অনেক বড় মাঠে বড় ভাইয়ারা ক্রিকেট খেলতেন, একপাশে আমারাও খেলতাম-উনারা খেলতেন কাঠের বল দিয়ে আমরা খেলতাম টেনিস বল দিয়ে।

আমার বাসার কয়েকটা বাড়ি পরেই সুন্দর এক দো'তলা বাড়ি।সাদা রঙের এ বাড়িটা অনেক সুন্দর।ছবির মত। মনে হয় বারে বারে চেয়ে দেখি।কোন এক ধনকুবেরকে নাকি তার শ্যালিকা এই বাড়িটা উপহার দিয়েছেন।মালিক পক্ষের কেউ থাকে না এই বাড়িতে।একজন সিকিউরিটি গার্ড থাকে শুধু। এ বাড়িটি তখন ছিল না।এখানে ছিল কবরস্থান। আমরা ভুলেও এখানে আসতাম না।এখানে কার সাথে নাকি কবে কবরের মরা খুলি কথা বলেছিল।এই ভয়ে ভয়ে আমরা কবরকে এড়িয়ে চলতাম।কবরের পাশে ছোট একটা পুকুর ছিল।পুকুরের পাশে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা ।এই খোলা জায়গায় আমরা বিকেলে ঘুড়ি উড়াতাম।

এরপর সরদার চাচা এই পুকুরটাকে ভরাট করে ফেললেন,কবরকে সমান করে দিলেন, এখানে ওখানে মাটি ফেলে ছোট ছোট রাস্তা করে রীতিমত প্লট করে ফেললেন-ভাল দামে বিক্রির জন্য। সরদার চাচা যখন কবরকে সমান করে দিলেন-আমরা বলা বলি করলাম এবার সরদারের মুক্তি নেই।মরা খুলি সরদারের যে কি করবে ভাবতেই মনে ভয় ধরে যেত।কিন্তু দিন তো কতই গেল।সরদারের কিছুই হলো না। তাই আমরাও প্রথমে ভয়ে ভয়ে তারপরে রীতিমত নির্ভয়ে সমান করা কবরের উপর ফুটবল খেলা শুরু করে দিলাম।বিকেল হলেই হাজির হয়ে যেতাম আমি,তন্ময়,শিশির,রুহুল আরও অনেকে।শীত আসলে ওখানে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম।

এটা এই ব্যাডমিন্টন খেলা বয়সের বেশ আগের বিকেলের কথা।আমাদের এলাকায় তখন বেশ সুন্দর একটা বিল্ডিং হচ্ছে।এত পরিপাটি করে দালান করার কারণ ওখানে নাকি কোরিয়ানরা থাকবেন।কোরিয়ান থাকুক আর চাইনিজ থাকুক এতে আমাদের কিছু যায় আসে না।তখন আমরা ঝাপ খেলতে মজা পাচ্ছি এটাই বড় কথা।দালান করার জন্য ট্রাকে করে করে বালু এনে জমা করা হচ্ছিল রাস্তার পাশে।কেবল একতলা হয়েছে-দালান আরও উপরে উঠবে । আমরা সেদিন বিকেলে ঐ একতলা থেকে রাস্তায় রাখা বালুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলাম ।বিল্ডিং থেকে কে কত দূরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এটাই ছিল ঝাপ খেলা।প্রথমে ঝাপ দিতে ভয় লাগে।তারপর আর ভয় থাকে না।আমি ঝাপ দিয়ে বসে বসে আর ছেলেদের ঝাপের দূরত্ব আমার দেওয়া ঝাপের সাথে মেপে দেখছিলাম।এমন সময় দেখি,রাস্তা দিয়ে বেনু ফুফু যাচ্ছেন।ফুফুই প্রথমে কথা বল্লেনঃ 'কি সব লাফালাফি করছ, তোমাকে তো সন্ধ্যায় গিয়ে গোসল করতে হবে।এর থেকে চল আমার সাথে আমরা বাগানে লুকোচুরি খেলি।' আমি যেখানে ঝাপাঝাপি করছিলাম তার ঠিক উল্টো পাশেই ছিল এক বিশাল বাউন্ডারি ঘেরা এস্টেটের মত ।ওখানে বাগান ছিল।এই বাগানেই বেনু ফুফুরা লুকোচুরি খেলতেন।সেদিন থেকে আমিও যোগ দিলাম খেলায়।এরপর প্রতিদিন বিকেলে চলে যেতাম বাগানে।লুকোচুরি খেলতাম। আমি বেনু ফুফু, মুস্তাফিজ কাকা, সোহেলী আপা আরও বেশ কয়েকজন।

এরপর মুস্তাফিজ কাকা বেশ বড় হয়েছেন-ক্লাস টেনে পড়েন।আর আমিও খানিকটা বড় হয়েছি।তখন আমরা ক্রিকেট খেলতাম বাঁশ ঝাড়ের ভিতর।দুদিকে বাঁশ ঝাড় মাঝখানটায় চলাচলের পথ আর বেশ খানিকটা বৃত্তের মত ফাকা জায়গা।

এলাকায় এক ৮০ বৎসর বয়সের রসিক বুড়া ছিলেন।রসিক বুড়া ঐ বয়সেই একটা বিয়ে করেছিলেন।সেই বৌ এর দুটি সন্তানও হয়েছিল।সন্তান দুটি এখনো বেঁচে আছে,স্ত্রীও বেঁচে আছে কিন্তু বছির বুড়া এখন আর নেই। এই বছির বুড়ার ছোট ছেলের নাম রাকিব। কিন্তু আমাদের গ্রামে বিবর্তনবাদ চালু ছিল।নাম বিবর্তিত হয়ে যেত। যেমন রতন হয়ে যেত অতন, রবিউল হয়ে যেত ওবুল। ঠিক এই ভাবেই রাকিব হয়ে গিয়েছিল আকিব।এই আকিব তখন খুব ছোট।আমরা বাঁশ ঝাড়ের ভিতর সেদিন বিকেলে খেলছি আর আকিব বাঁশের মুড়ার উপরে বসে বসে আমাদের খেলা দেখছে।মির্জা বল করছিল।এমন সময় আকিব এসে মির্জাকে জিজ্ঞেস করল: ক্যা মির্জা ভাই,একন ( এখন) আত না দিন? মির্জা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল: দিন বে, দেখছিস না? আকিবঃ তালে মনে হয় আত (রাত) হচ্ছে, না? মির্জাঃ হু, রাত তো হচ্ছেই ,কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আযান দিবে। আকিবঃ তাই তো আমাক মশা কামড়াচ্ছে! আমরা ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে পড়ি কি মরি।রাত হলে যে ওকে মশা কামড়ায় এটা ওর মনে আছে।যেহেতু এখন মশা কামড়াচ্ছে তাই এখন রাত। আমরা এখনো দিনে মশা কামড়ালে একে অন্যকে জিজ্ঞেস করি: আচ্ছা একন আত না দিন?

এই বাঁশের আড়ার ভিতর আমরা ক্রিকেট খেলেছি অনেকদিন।আঞ্চলিক ভাষায় বাঁশের ঝাড়কে আমরা বাঁশের আড়া বলি। সেবার একটা ক্রিকেট লীগ খেলতে গেলাম।মুস্তাফিজ কাকা হলেন টিমের ক্যাপ্টেন।যখন লীগে টিমের নাম এন্ট্রি করাতে গেলাম তখন লীগের আয়োজকরা জিজ্ঞেস করলেন: আপনাদের টিমের নাম কি? মুস্তাফিজ কাকা এক মুহূর্তও না ভেবে উত্তর দিলেন: বি এ সি সি(BACC) ।আমরা বললাম, ক্যাপ্টেন টিমের নামটা সুন্দর দিলেন কিন্তু এই বি এ সি সি (BACC) অর্থ কি? কাকা বল্লেনঃ বাঁশের আড়া ক্রিকেট ক্লাব। এরপর থেকে আমরা বি এ সি সি (BACC)।এই নামটা হাস্যকর হোক- লীগ চ্যাম্পিয়ন কিন্তু আমরাই হয়েছিলাম।

বিকেল বেলা আকাশে অনেক ঘুড়ি উড়ত। ঘুড়ি কাটাকাটি খেলা হতো।একজন আর একজনের ঘুড়ির সুতার সাথে প্যাচ লাগিয়ে কাটাকাটি খেলা হতো-কার ঘুড়ি শেষ পর্যন্ত আকাশে উড়ে।দুই, তিন, চার কখনো অনেক ঘুড়ি এক সাথে কাটাকাটি লেগে যেত।কিছুক্ষণ পরপরই একটা করে ঘুড়ি কাটা যেত।এই সুতা কাটা ঘুড়ি গুলি আকাশে ঢেউ খেতে খেতে অনেক দূরে চলে যেত।আমার এক শখ ছিল এই কাটা ঘুড়ি ধরা । অনেক সময় ঘুড়ির পেছনে ছুটতে ছুটতে কয়েক গ্রাম পার হয়ে যেতাম।

মাঝে মাঝে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম। অচেনা এলাকাতে চলে যেতাম চালাতে চালাতে।কখনো রেল লাইন ধরে হেঁটে যেতাম অনেক দূর একা একা।



বিষয়: বিবিধ

১৪৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File