স্বপ্ন

লিখেছেন লিখেছেন আত্নসমর্পণ ১৬ আগস্ট, ২০১৩, ০৮:১৬:১৪ রাত

ছেলেটি ওর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো। শুভ্র নীল আকাশ। বিমুক্ত আকাশে উড়ন্ত পাখীর ঝাঁক, ওকে বিমোহিত করতো। পাখীর ডানায় সংকোচন ও প্রসারণ দেখে, শূন্য বাতাসে ভেসে চলা বিহঙ্গের অবয়বে ও স্বাধীনতার স্বাদ নিত। ওর চিন্তার জগতের বিমূর্ত স্বাধীনতা যেন পাখীর ডানায় মূর্ত হয়ে উঠতো।

অতীতকালে এখানে বিশাল এক বাড়ী ছিল। যদিও গল্পে লিখা  ছিল 'বাড়ী'। কিন্তু আমি সব সময় এ বাড়ীকে 'মহল' নামেই উল্লেখ করি।সে বেশ পুরানো দিনের কথা। এই মহলটা ছিল এক সওদাগরের। সওদাগর ছিলেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। মহলের চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা এই সওদাগরই ছিল। এ মহলে সব ছিল। সাথে সুন্দর এক বাগান ছিল। সে বাগানে নাম জানা আর নাম অজানা মনোহারী ফুলেরা ছিল। সওদাগরের সন্তানেরা এ বাগান জুড়ে খেলা করতো। বাগান থেকে খানিক দূরে এক দীঘি ছিল। দীঘির জল ছিল অনেক স্বচ্ছ যেন পরিষ্কার কাচের টুকরো দিয়ে বানানো সে দীঘির জল । দীঘিটির দিকে তাকালে চোখ শীতল হয়ে আসতো । শায়নের খুব ইচ্ছে করতো এ দীঘিতে সাঁতার কাটার। নৌকা নিয়ে ভেসে চলার। বাগানে খেলা করার। কিন্তু শিশু শায়নের সে সুযোগ ছিল না। কেননা শায়নের বাবা কোন সওদাগর ছিলেন না, ছিলেন সওদাগরের কর্মচারী। শায়নদের বাস ছিল, মহলের পেছন দিকটায়। ওদের ঘরটি ছিল ছোট। এ ঘরের সামনে কোন বাগান ছিল না। শুধু মাথার উপরে আকাশ ছিল। শুভ্র নীল আকাশ।

শায়খ, জীবনে অনেক গল্প পড়েছি। অনেক গল্প শুনেছি । কিন্তু এই গল্পের, এই শৈশবের, এ শায়নকে আমার এখনো প্রায়ই মনে পড়ে। আমি যেন এখনো দেখতে পাই যে শায়ন তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।

ছেলেবেলায় ভাবতাম শায়ন যদি আমার যুগের কেউ হতো, হতো আমার দেশের কেউ- তাহলে আমি অবশ্যই ওর খুব ভাল বন্ধু হতাম।

আপনি বলছিলেন স্বাধীনতার কথা। আপনি বললেন, আমরা এমন কেন? এখানে, এদেশে, আমাদের এই মাতৃভূমিতে স্বাধীনতা আছে-আপনি বলেছেন। এদেশের অধিকাংশই আমরা মুসলিম। আর এখানে আমাদের ধর্ম 'ইসলাম' মানার স্বাধীনতাও আছে-আপনি বলেছেন।কিন্ত, সত্যই কি স্বাধীনতা নামের কিছু এখানে আছে?

এই যে আপনি আপনার লাল রঙের এ মটর সাইকেলে করে এলেন। আমি আপনার এই সাইকেলে আপনার পেছন সিটে বসে রাস্তার ডান দিক দিয়ে যেতে চাই- পারবেন আমায় রাস্তার ডান দিক দিয়ে নিয়ে যেতে? কিন্তু,রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলতে পারার অধিকার তো আমার ধর্মীয় অধিকার। আমাদের রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলার শিক্ষা দিয়েছেন। পারবেন আমায় নিয়ে যেতে? কিম্বা নিজে যেতে?

আমার বন্ধু রাহাতেরা আজ না খেয়ে থাকে। ঠিক মত তিনবেলা খাবারও ওদের এখন জোটে না। রাহাতের বাবার অনেক কষ্টের আর ধার দেনার টাকায় কেনা ট্যাক্সিটা যে শয়তান চুরি করে নিয়েছে- আমি তার শাস্তির দাবি করছি। শুধু কিছু জেলের সাজা নয়। ঐ চোরের হাত কেটে দেবার শাস্তি চাই।এটা আমার ধর্মীয় অধিকার। ক্ষুধার জ্বালায় কেউ ভাত চুরি করতে পারে, খাবার চুরি করতে পারে, ছোট খাট জিনিস চুরি করতে পারে; কিন্তু, লক্ষ টাকার ট্যাক্সি নয়। আমি ঐ চোরের হাত কেটা দেবার বিচার চাই।

আমার প্রতিবেশী বোনটাকে যে পশু রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে আমি সেই পশুর মৃত্যুদণ্ড চাই। প্রকাশ্যে জনতার সামনে পাথর মেরে হত্যার মৃত্যুদণ্ড চাই। এটা আমার ধর্মীয় অধিকার। ইসলাম প্রদত্ত, আল্লাহ সুবহানু তা'লা প্রদত্ত অধিকার।

শায়খ, এই যে এই মাত্র যে ছেলেটি হেঁটে গেল আমাদেরকে ছালাম করে আকাশী রঙের শার্ট পড়া ছেলেটি-ওর নাম সেলিম।ওর মা ভাল চিকিৎসার অভাবে ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছেন। আমি এই সেলিমের জন্য ওর বাড়ির পাশেই চারতলা বাড়ির ঐ মালিকের টাকার যাকাত চাই। লোক দেখানো কিছু নিম্ন মানের লুঙ্গি আর শাড়ী বিলবার যাকাত আমি চাই না। সম্পত্তির পাই পাই হিসাব করে মোট সম্পত্তির ২.৫% যাকাত চাই। এ যাকাত তো করুণা নয় বরং সেলিমকে দেয়া আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার।পারবেন শায়েখ, এই অধিকারগুলি এই দেশে আমাদেরকে আদায় করে দিতে?

এই যে রাস্তা দিয়ে কত তরুণ তরুণী হেঁটে যাচ্ছে-এই তরুণ তরুণীদের কত সম্ভাবনাময় জীবন মাদকাসক্তির কারণে অকালে ঝরে পড়ছে, তাই আমি এ দেশ থেকে সমস্ত মাদককে নিষিদ্ধ করতে চাই। আমি এ দেশে সকল অশ্লীলতাকে নিষিদ্ধ করতে চাই। আমি রাষ্ট্রপ্রধানের, বড় ব্যবসায়ীর, রাজনৈতিক নেতার, সব আমলার ছেলেদের অধিকারের কাতারে গরীব রিকশাওয়ালার ছেলেকেও দেখতে চাই, দিন মজুরের ছেলেকে দেখতে চাই। সব মানুষের মর্যাদা সরলরেখায় দেখতে চাই, সাম্য চাই, ইনসাফ চাই- এগুলো আমার ধর্মীয় অধিকার।কুর আন প্রদত্ত,আল্লাহ সুবহানু তা'লা কর্তৃক প্রদত্ত অধিকার।

আমায় ক্ষমা করবেন শায়েখ কিন্তু, পারবেন কি শুধু মসজিদের মেহরাবে আর মাদ্রাসার বারান্দায় বসে বসে আমাদের এই ধর্মীয় অধিকারগুলি আমাদেরকে দিতে ?

"হে আমার রব! আমাকে যেখানেই তুমি নিয়ে যাও(মদীনাতে) সত্যতার সাথে নিয়ে যাও এবং যেখান থেকেই বের করো( মক্কা থেকে) সত্যতার সাথে বের করো। এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাকে সুলতানান নাছিরা তথা রাষ্ট্র শক্তি দান করো।"

[আল কুর আন,সূরা বনী ইসরাঈল, সূরা নং-১৭ আয়াত নং- ৮০]

নবীর দুয়া ব্যর্থ হয় না। এবং আমরা দেখলাম, মদীনাতে গিয়েই নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন। এবং এরপর এ রাষ্ট্র বিশ্ব মানবতাকে একের পর এক কল্যাণ উপহার দিতে থাকলো। সাম্য উপহার দিতে থাকলো। ইনসাফ উপহার দিতে থাকলো। যে ইনসাফের তুলনা মানব ইতিহাসে আর নেই। ভুল বললাম কি? আমি এভাবেই কথা বলি শায়েখ। জালিমের অত্যাচার আমাকে উদ্ধত করেছে, কন্ঠকে করেছে কর্কশ। আপনাকে জ্ঞান দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। আপনি নিজেই একজন শিক্ষক আর আমি ছাত্র। কিন্তু আমার কথাতো আমাকে বলতে হবে। আর আমি এভাবেই কথা বলি। আমি জানি আপনার কাছে আমি প্রশ্রয় পাবো তাই আরো বেপড়োয়া হয়ে বলছি। জ্ঞান দেওয়া নয় শুধু কিছু চিৎকার আপনার কাছে পৌঁছানো আমার লক্ষ্য। অন্য কিছু নয়।

প্রত্যেক রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে চায়।তাই খুব সহজে এভাবেও বলা যেতে পারে যে, রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবার প্রচেষ্টাকেই রাজনীতি বলে। যে রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্য আল্লাহ দুয়া করতে বললেন, যে রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্য আল্লাহর রসূল দুয়া করলেন,যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসলেনও, সে রাষ্ট্র ক্ষমতা চাওয়া তো উম্মতের জন্য অপরিহার্য। অথচ যখন এই আমরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছি তখন অন্তত একাত্নতা ঘোষণা না করে বরং একে পাপ(?) মনে করে উলটো একজন মুসলিম কিভাবে আমাদের বিরুদ্ধে আপত্তি করতে পারেন?? আমি ভেবে পাই না।

অপপ্রচার থাকবেই। যেখানে স্বয়ং আমাদের রসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লাম বিরুদ্ধেও অপপ্রচার ছিল- উনাকে যাদুকর,কবি,নির্বোধ,ক্ষমতা লোভী,ধর্মের আড়ালে স্বার্থোদ্ধারের চেষ্টা, ধর্মের অবমাননা......আরো কত কি বলা হয়েছিল;উম্মুল মুমিনিন রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রিয় সহধর্মিনী আয়েশা (রা) এর চরিত্রের বিরুদ্ধেও তোলা হয়েছিল নিকৃষ্ট অপবাদ -সেখানে আমাদের উপরও অপবাদ আসাটাই স্বাভাবিক বরং না আসাটাই অস্বাভাবিক। এই অপবাদ পাওয়াটাও সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত বলে আমি মনে করি। শায়েখ, আমায় ক্ষমা করবেন। আমি এভাবেই কথা বলি।

প্রথমেই আমি যে গল্পটা আপনায় বললাম। শায়নের গল্প। শুভ্র নীল আকাশের গল্প। আসলে, আমার জীবনের গল্পও শায়নের মতই। গল্পে আকাশের যে নীল, সে নীল যেন ছিল শায়নের বুকের খুব গভীরে জমে ওঠা নীল কষ্ট; আর আকাশের শুভ্রতা ছিল শায়নের সুপ্ত স্বপ্ন। শায়ন স্বপ্ন দেখতো, ওর সক্ষম বাবা, খুব শীঘ্রই গোলামীর এ চাকুরী ছেড়ে দিবেন। ওদের নিজেদের একটি বাড়ী হবে। এক বাগান থাকবে। সে বাগানের দরজা সবার জন্য সব সময় খোলা থাকবে। বাগানের দরজায় লিখা থাকবে- "সবার জন্য উন্মুক্ত"

শায়খ, আমিও স্বপ্ন দেখি, আমাদের অগ্রজগণ, এই আপনারা আমাদেরকে এমন একটি দেশ,এমন একটি জগত বিনির্মাণের দিকে নিয়ে যাবেন- যে জগতের, যে দেশের প্রবেশদ্বারে লিখা থাকবে----

"হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছে যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো।সে ব্যক্তিই তোমাদের ভিতর সবচেয়ে বেশি সম্মানী বলে বিবেচিত হবে যে অধিক মুত্তাকী, যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে চলে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।"

"নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়নীতি, পরোপকার ও আত্মীয় স্বজনদেরকে দান করার হুকুম দেন, এবং অশ্লীলতা-নির্লজ্জতা ও দুষ্কৃতি এবং অত্যাচার-বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা লাভ করতে পারো।"

[আল কুর আন-- সূরা হুজুরাত,সূরা নং ৪৯, আয়াত নং, ১৩ এবং সূরা নাহল,সূরা নং-১৬, আয়াত নং-৯০ ]

বিষয়: বিবিধ

২১৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File