গণজাগরণ মঞ্চ শক্তি হারিয়েছে বিভক্তি আর দলীয়করণে

লিখেছেন লিখেছেন শেখ মাহমুদ ১৭ মার্চ, ২০১৩, ০২:৩২:৫০ রাত

আন্দোলন যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, ডা. ইমরান এইচ সরকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা; বর্তমানে তিনি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদেরও নেতা। এ ছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের মিডিয়া সেলের 'সরাসরি কর্মী'। দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য প্রথমে যৌথ নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালনা করার কথা থাকলেও সরকারদলীয় প্রভাবে তা করা যায়নি। আন্দোলনের কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেন, সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ তো করেইনি, বরং তারা আদালতের ওপর বিষয়টি ছেড়ে দিয়ে সুবিধা আদায় করতে চাইছে।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ শক্তি হারিয়ে এখন যেন দিশাহীন। দলীয়করণ, আন্দোলনে বিভক্তি এবং দাবি আদায় না হওয়ার ফলেই আন্দোলনটি পথ হারাতে বসেছে। আর এ সুযোগে আন্দোলন যাদের বিরুদ্ধে সেই জমায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নেমেছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। জামায়াতের পাশাপাশি এ আন্দোলনের বিরোধিতায় নেমেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও। অথচ নব্বই-পরবর্তী সময়ে এমন শক্তিশালী আন্দোলন আর গড়ে ওঠেনি।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনও একইভাবে দলীয়করণের শিকার হওয়ার কারণে অসমাপ্ত রয়ে যায়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দলীয়করণের বৃত্ত থেকে গণজাগরণ মঞ্চ বেরোতে না পারলে তৈরি হবে আরো বড় কোনো হতাশার ইতিহাস। তবে আন্দোলনের দলীয়করণ ও শক্তি নিঃশেষের বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ আন্দোলনের অন্যতম মুখ মারুফ রসুল।

ঘটনার পরম্পরা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের কৌশলে সরিয়ে মঞ্চের নেতৃত্বে চলে এসেছে সরকারদলীয় বিভিন্ন সংগঠন ও তাদের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। শুরুতে আন্দোলনের পুরোভাগে যাঁরা ছিলেন তাঁদের অনেকেই কালের কণ্ঠকে বলেছেন, দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য প্রথমে যৌথ নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালনা করার কথা ছিল। সরকারদলীয় প্রভাবে তা আর সম্ভব হয়নি। সেই সঙ্গে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা, একটি পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেপ্তার করাসহ গণজাগরণ মঞ্চের প্রধান দাবিগুলোও মেনে নেয়নি। আন্দোলনের শুরুতেই মাঠে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীদের প্রবল উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। তবে আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় তাঁদের রাখা হয়নি।

এদিকে হেফাজতে ইসলাম চট্টগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চের মহাসমাবেশ প্রতিহত করতে সক্ষম হলেও শুক্রবার আশুলিয়ায় মঞ্চের কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত সফলই হয়। তবে সাভারের এ কর্মসূচিতেও প্রকটভাবেই দেখা গেছে দলীয়করণের প্রভাব। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা মিছিল নিয়ে সমাবেশে অংশ নেন। শুরুর দিককার উদ্যোক্তারা মনে করেন, দলীয়করণ, দাবি পূরণে সরকারের অনীহাসহ নানা কারণ আন্দোলনের শরিক সাধারণ মানুষকে একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করে। ফলে গণজাগরণ মঞ্চে আসা মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে।

তবে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির মনে করেন না গণজাগরণ মঞ্চ দলীকরণ হয়েছে বা এর জনপ্রিয়তা কমেেেছ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি চারটা উপজেলা থেকে ঘুরে এলাম। মানুষ অংশগ্রহণ করছে। দাবিতে সোচ্চার থাকছে।' আন্দোলন লাগাতার করাও সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা, পড়াশোনা আছে। তবে তিনি মনে করেন, এখন আন্দোলন সপ্তাহে একবার করে হলেও চালু রাখা দরকার। এ প্রসঙ্গে তিনি জাহানারা ইমামকে উদ্ধৃত করে বলেন, 'আমাদের আন্দোলন সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ নয়, এটা বহমান রাখতে হবে।' শাহরিয়ার কবির আরো বলেন, 'আওয়ামী লীগের চেষ্টা থাকবে দলীয়করণের। কোনো রাজনৈতিক দল না থাকলে জামায়াত এদের ছিঁড়ে ফেলবে। আর আমি মনে করি না এটা দলীয়করণ হয়েছে। সরকারও একই সঙ্গে প্রতিপক্ষ। আর এক অবস্থান কর্মসূচিতে সব দাবি আদায়ও করা যায় না।'

দলীয়করণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাধারণত কোনো আন্দোলন একটানা এত দিন চলে নাই। স্বাধীনতার পর আমরা গত ৪০ বছরে এমন আন্দোলন দেখিনি।' কৃষিমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ায় তরুণ প্রজন্মকে সাধুবাদ জানান। তিনি বলেন, 'তারা আন্দোলনে কতটুকু সফল বা সফল না, সে ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। তবে তাদের উদ্দেশ্য যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়া তা বলতে দ্বিধা নেই।'

গণজাগরণ মঞ্চ দলীয়করণ হওয়ার আগ পর্যন্ত শাহবাগে মানুষের ঢল নামতে দেখা যায়। ওই সময় বিএনপি, বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা কেউই সরাসরি শাহবাগের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য-বিবৃতি দেননি। চুপচাপ ছিল জামায়াতপন্থী আলেমসমাজও। আট দিনের মাথায় বিএনপি শাহবাগের আন্দোলনকে প্রকারান্তরে স্বাগতই জানায়। ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিএনপির এক সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে সাদেক হোসেন খোকা বলেন, 'শাহবাগে তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন দাবি তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল হিসেবে আমরা তাদের আবেগের প্রতি সম্মান করি। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিটিও সম্পৃক্ত করার জন্য আহ্বান জানাই।'

দেখা গেছে, শাহবাগে লোক সমাগম কমে যাওয়ার পরই রাতারাতি হেফাজতে ইসলাম নামের একটি সংগঠন আন্দোলনের বিরোধিতা শুরু করে। যাকে তাকে নাস্তিক-মুরতাদ ঘোষণা শুরু হয়। তাদের সঙ্গে সুর মেলায় বিএনপিও। এদিকে সরকার হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদের হাত করার চেষ্টা করার কৌশল নেওয়ায় আন্দোলনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সাদেক হোসেন খোকার অভিমত কী জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে কিছু বলতে রাজি হননি।

আন্দোলন যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, ডা. ইমরান এইচ সরকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা; বর্তমানে তিনি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদেরও নেতা। এ ছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের মিডিয়া সেলের 'সরাসরি কর্মী'। দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য প্রথমে যৌথ নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালনা করার কথা থাকলেও সরকারদলীয় প্রভাবে তা করা যায়নি। আন্দোলনের কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেন, সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ তো করেইনি, বরং তারা আদালতের ওপর বিষয়টি ছেড়ে দিয়ে সুবিধা আদায় করতে চাইছে।

আন্দোলন দলীয়করণ হওয়া ও দিশাহারা হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন না ব্লগার ও আন্দোলনকর্মী মারুফ রসুল। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'কর্মসূচিকে বিভিন্ন ধারায় অগ্রসর করা হচ্ছে। মানুষ এসব কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। আমি মনে করি না আন্দোলন জনগণকে কাছে টানতে পারছে না।' দলীয়করণের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আন্দোলনে ছাত্রলীগ যেমন আছে, তেমনি প্রগতিশীল বাম ছাত্র সংঘটনও আছে। সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য চেষ্টা করছে। আমি নিজেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভোট দিয়েছি। নিশ্চয় এ দাবি পূরণ করার জন্য সরকার উদ্যেগ নেবে। না হয় তারা আমাদের সমর্থন হারাবে।'

এদিকে গত শুক্রবার আশুলিয়ার সমাবেশে বিপুল লোকসমাগম হলেও এর পেছনে ক্ষমতাসীন দলের অবদান ছিল অভিযোগ উঠেছে। সমাবেশে লোক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। দেখা গেছে, আশুলিয়া থানা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কয়েকটি মামলার আসামি সুমন ভুঁইয়ার অনুসারীদের নেতৃত্বে সমাবেশে প্রথম মিছিলটি আসে। 'স্বেচ্ছাসেবক_সৌজন্যে সুমন ভুঁইয়া' লেখা বাহুবন্ধনী (ব্যান্ড) পরা ব্যক্তিদের সমাবেশ সমন্বয় করতেও দেখা যায়। দুপুরের পর থেকেই সমাবেশস্থলের সামনে দিয়ে দফায় দফায় মোটরসাইকেলে মহড়া দেয় স্থানীয় সরকার সমর্থক নেতা-কর্মীরা। অবশ্য প্রথম দিকে আসা মিছিলগুলোতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু-কিশোরের উপস্থিতি ছিল। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য তৌহিদ জং মুরাদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ উদ্দীন খান এসেছিলেন দুপুরের পরই। তবে তাঁরা কেউ বক্তব্য দেননি। আরো জানা গেছে, সমাবেশের কথা জানিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) শ্রমিক সংগঠন 'গার্মেন্ট ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিউসি)' টানা মাইকিং করে।

শুরুর নেতাদের অপসারণ : গত ৫ ফেব্রুয়ারি সাড়ে তিন শ খুন, ধর্ষণ ও যুদ্ধাপরাধের মতো অভিযোগের আসামি কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন সাজা দেওয়ার সূত্র ধরে আন্দোলনটির পত্তন ঘটে। ওই দিন দুপুর ১টার দিকে ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের (বোয়ান, আহ্বায়ক ডা. ইমরান এইচ সরকার) নামে শাহবাগে জাদুঘরের সামনে উপস্থিত হয়ে ট্রাইব্যুনাল ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দিয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেন মো. মাহামুদুল হক মুন্সি, যিনি ফেসবুকে 'বাঁধন স্বপ্নকথক' নামে পরিচিত। এরপর মো. তানজির ইসলাম বৃত্ত (ফেসবুক আইডি 'সিডাটিভ হিপনোটিঙ্'), আজম খান (ফেসবুক আইডি 'মহামান্য কহেন'), ব্লগার শাতিল আহমেদ, সেলিনা মওলা, আনিস রহমান প্রমুখ অনলাইনে সবাইকে শাহবাগে জমায়েত হওয়ার জন্য প্রচার চালান।

সূত্র জানায়, একই দাবিতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আন্দোলনকর্মী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আনহা এফ খান ফেসবুকে প্রচার চালান শাহবাগে আসার জন্য। তাঁদের সবার প্রচারে শাহবাগে ৫০ জনের মতো মানুষ উপস্থিত হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক ও ব্লগার অ্যাক্টিভিস্ট ফারুক ওয়াসিফ। অল্প জমায়েতের কারণে বোয়ান ট্রাইব্যুনাল ঘেরাও না করে মানববন্ধন করে শাহবাগে। এ উভয় দলটি মিলে শাহবাগে সব যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় বিকেল ৫টা নাগাদ। সূত্র মতে, সেদিন যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার কাজটি শুরু করেন আজম খান, আনিস রায়হান, সেলিনা মওলা ও মো. তানজির ইসলাম বৃত্ত। এ সময় প্রথম মিছিল দেন সেলিনা মওলা। তাঁর কণ্ঠেই প্রথম প্রতিবাদ জ্বলে ওঠে, 'আপসের এ রায় জনগণ মানে না, কোনো আপস মানি না, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, জয় বাংলা।' জামায়াত-শিবিরের হরতাল থাকায় সেদিন শাহবাগে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি এই ছোট দলটির। এরই মধ্যে সন্ধ্যায় বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতৃত্বে টিএসসি থেকে মশাল মিছিল বের হয়। প্রায় দেড় শ জনের এ মিছিল রাজধানীর বাংলামোটর ঘুরে আবার শাহবাগে এসে বসে পড়ে। মশাল মিছিলকে ঘিরে বাড়তে থাকে গণজমায়েত। সেখানে যোগ দেয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। দেখতে দেখতে শাহবাগ হয়ে ওঠে জনারণ্য।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রাত সাড়ে ৮টার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের একটি বিশাল মিছিলও এসে যোগ দেয় শাহবাগে অবস্থানকারীদের সঙ্গে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ছাত্রলীগ নেতারা চলেও যান।

৫ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের সূচনা যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা আন্দোলনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্তই সক্রিয় ছিলেন। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের ডাকা হয়নি বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন।

দলীয়করণ নানাভাবে : জানা যায়, ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগের দ্বিতীয় সমাবেশের দিন ঘোষণা করা হয়, এখন থেকে স্থায়ীভাবে শাহবাগ অবরোধ করে রাখা হবে না_তবে প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শাহবাগে স্লোগান, গান চলবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের রায় ঘোষণার আগের দিন শাহবাগে গণজমায়েত হবে। এ ঘোষণার পরই রাত ৮টার দিকে খবর আসে, ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে শিবির খুন করেছে। এ খবর গণজাগরণ মঞ্চে আসার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ আন্দোলনকারীরা মঞ্চ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলে মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বাধ্য হয়ে আবার শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত থাকার ঘোষণা দেন। পুনরায় ২১ ফেব্রুয়ারির সমাবেশে শাহবাগে স্থায়ী মঞ্চ না রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই সমাবেশেই মূলত মঞ্চের দলীয়করণ স্পষ্ট হয়। এদিন গণজাগরণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে ডা. ইমরান এইচ সরকার যখন কর্মসূচি পড়ছিলেন, তখন তাঁর বাঁ পাশে ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, তাঁর পাশে ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ, তারপর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর শরীফ। ডা. ইমরানের ডান পাশে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রকার ও আওয়ামীপন্থী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। এদিন বামপন্থী ছাত্রনেতাদের মঞ্চের পেছনে রাখা হয়েছিল, দেখা যায়নি আন্দোলনের শুরুতে যাঁরা ছিলেন তাঁদের কাউকে।

ওই দিন ডা. ইমরান তিন পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য পাঠ করছিলেন, তখন পাশ থেকে বেশ জোরে জোরে নাজমুল নির্দেশ দিচ্ছিলেন তাঁকে। এমনকি 'একটু আবেগ দিয়ে কর্মসূচি পড়া'র জন্য ডা. ইমরান এইচ সরকারকে নির্দেশ দেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল। বিষয়টি কালের কণ্ঠ 'গণজাগরণ মঞ্চ আওয়ামীকরণ' শিরোনামে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরের সমাবেশে এসে সংহতি জানান আওয়ামী লীগের স্থানীয় তিন সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার, আসলামুল হক ও রিয়াজউদ্দিন মলি্লক। যাত্রাবাড়ী সমাবেশের দিনও দেখা গেছে একই পরিস্থিতি। স্থানীয় সংসদ সদস্য মোল্লা হাবিবুর রহমান গত ৪ মার্চের যাত্রাবাড়ী গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশে বক্তব্য দেন। সর্বশেষ গত শুক্রবার আশুলিয়ার সমাবেশে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতি দেখা যায়।

৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশের পুরো নেতৃত্বই আওয়ামীপন্থী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের হাতে চলে যেতে দেখা গিয়েছিল। জানা যায়, ৬ মার্চ গণজাগরণের সংস্কৃতি মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে ডা. ইমরানসহ অন্য নেতারা বলেছিলেন, মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবে গণজাগরণের সংস্কৃতি মঞ্চ। এর পরই শুরু হবে বক্তব্য। কিন্তু পরদিন অনুষ্ঠানের শুরুতেই আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান আরিফসহ অনেকে সাফ জানিয়ে দেন গণজাগরণের সংস্কৃতি মঞ্চকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হবে। আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার ভয় থেকে সংস্কৃতি মঞ্চের কর্মীরা নেমেও আসেন মঞ্চ থেকে। মূল মঞ্চ দখলে চলে যায় আওয়ামীপন্থী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের হাতে।

সরকারের প্রতি অনাস্থা থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের প্রথম দিকে স্লোগান ছিল সরকারের আপসের বিরুদ্ধেই। এ কারণে গণজাগরণ মঞ্চে বক্তব্য দিতে আসা আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে মঞ্চে ওঠা বা বক্তব্যদানেও বাধা দেওয়া হয়। দু-একটি ক্ষেত্রে নেতাদের লাঞ্ছিতও হতে হয়। আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী শাহবাগের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দিতে এলে তাঁকে লক্ষ্য করে পানির বোতল ছুড়ে মারা হয়। তোফায়েল আহমেদ ও সাহারা খাতুনকেও শাহবাগে গিয়ে বিরূপ ব্যবহার হজম করতে হয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাধা দেওয়ায় ছাত্র ইউনিয়ন নেতা স্লোগানকন্যা লাকী আক্তারের ওপর হামলাও চালানো হয় ১০ ফেব্রুয়ারি। রায়েরবাজার বধ্যভূমি, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চট্টগ্রাম, সাভারের আশুলিয়ায়, যেখানেই গণজাগরণ মঞ্চ সমাবেশ করেছে, সেখানেই আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের প্রকট উপস্থিতি দেখা গেছে।

সংস্কৃতি মঞ্চও হটানো হয় : আন্দোলনের শুরুতেই মাঠে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীদের প্রবল উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। তবে আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় তাদের রাখা হয়নি। আন্দোলনের ২২ দিনের মাথায় ২৭ ফেব্রুয়ারি এ রকম ৩০টি সংগঠন নিয়ে তৈরি হয় 'গণজাগরণ সংস্কৃতি মঞ্চ'। মঞ্চটি মূলত বিকেল ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গান, নাটক, কবিতা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করে শাহবাগে আসা জমায়েত ধরে রাখার কাজ করছিল। তবে মঞ্চটিকে সহজভাবে নেননি আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের চাপের কারণেই চারুকলার সামনে থেকে মঞ্চ তুলে নিতে বাধ্য হন সংস্কৃতি মঞ্চের কর্মীরা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে গণজাগরণ সংস্কৃতি মঞ্চের এক কর্মী কালের কণ্ঠকে বলেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের এক নেতার চাপে মঞ্চ সরিয়ে নিতে হয়। ওই নেতা নানাভাবে ভয়ভীতি ও হয়রানি করেছেন অভিযোগ করে ওই কর্মী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের সঙ্গে ডা. ইমরান দফায় দফায় বসেছেন। ছাত্রলীগের নেতারা এ মঞ্চটি ভেঙে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না।'

সূত্র: কালের কন্ঠ

বিষয়: বিবিধ

১২৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File